শক্তিশালী ভূমিকম্পে চলন্ত লিফটে কী ঘটে, জানালেন বুয়েটের অধ্যাপক
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৩৭ পিএম
ভূমিকম্পের সময় মানুষ সাধারণত ভবন ছেড়ে খোলা জায়গায় যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। অনেকে কলাম বা বিমের নিচে আশ্রয় নেন। কিন্তু সেই মুহূর্তে কেউ যদি চলন্ত লিফটের ভেতরে থাকেন তবে কয়েক সেকেন্ডের তীব্র কম্পন রূপ নিতে পারে মৃত্যুফাঁদে। বিশেষজ্ঞরা জানান, ভূমিকম্পের সময় চলন্ত লিফটে অবস্থান হতে পারে জীবনে সবচেয়ে বিপজ্জনক পরিস্থিতিগুলোর একটি। দেশে অধিকাংশ বাণিজ্যিক ভবন ও সেই সঙ্গে আবাসিক ভবনগুলো বহুতল হওয়ায় লিফটের ব্যবহার বেড়ে গেছে বহুগুণে। সম্প্রতি বাংলাদেশে কয়েকটি তীব্র ভূমিকম্প আঘাত হানায় লিফটে উঠা নিয়ে নতুন আতঙ্ক দেখা গেছে।
ভূমিকম্প শুরু হলে প্রথম যে বিষয়টি ঘটতে পারে তা হচ্ছে বিদ্যুৎ বিভ্রাট। অনেক সময় ভবনের প্রধান বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। ফলে লিফট মাঝপথেই আটকে যায়। আধুনিক লিফটে ‘সিসমিক সেন্সর’ থাকলেও দেশের অধিকাংশ ভবনের লিফটে এই প্রযুক্তি কার্যকর আছে কী না তা জানা নেই অনেকেরই।
ভূকম্পনের সময় ভবন যখন দুলতে থাকে, তখন লিফটের লোহার ক্যাবল, শ্যাফট (যে লম্বা খাঁচার ভেতরে লিফট উঠা-নামা করে) এবং গাইড রেলগুলো হঠাৎ চাপের মুখে পড়ে। অতিরিক্ত দোলনে লিফটের কেবিন আটকে যেতে পারে। এ সময় তীব্র ঝাঁকুনি হতে পারে বা বিরল ক্ষেত্রে হঠাৎ নিচের দিকে দ্রুত নেমে গিয়ে তলায় সজোরে ধাক্কা খেতে পারে।
চলন্ত লিফটের ভেতরে থাকা মানুষ তখন অনুভব করেন-হঠাৎ তীব্র ঝাঁকুনি, আলো নিভে যাওয়া, কেবিন আটকে যাওয়ার বিকট শব্দ, দম বন্ধ হওয়া তীব্র আতঙ্ক। এ অবস্থায় সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয়টি হলো বিপজ্জনক উচ্চতায় ছোট কেবিনে হঠাৎ আটকে যাওয়ার মানসিক ধাক্কা-যা অনেক সময় হার্ট অ্যাটাক, প্যানিক অ্যাটাক বা তীব্র শ্বাসকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, ভূমিকম্পের সময় গোটা ভবনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অংশ হয়ে উঠতে পারে লিফট। কারণ এটি একদিকে বিদ্যুৎনির্ভর, অন্যদিকে এটি একটি সম্পূর্ণ আবদ্ধ ধাতব-নির্মীত খাঁচা।লিফটে আটকে পড়লে অধিকাংশ মানুষ ভুল সিদ্ধান্ত নেয়-যেমন দরজার স্লাইড জোর করে খোলার চেষ্টা করা, ছাদের বা উপরের ঢাকনা খোলা বা লাফ দিয়ে নামার চেষ্টা করা। এগুলো সবচেয়ে মারাত্মক ভুল।
এ প্রসঙ্গে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ‘কম্পন শুরু হলে চলন্ত লিফটি কোন একটি ফ্লোরে/লেভেলে থেমে যাবে। সেখান থেকে বের হয়ে কোন একটি দেয়াল বা কলাম ঘেঁষে দাঁড়াতে হবে। এমন বিশেষ সিস্টেম অধিকাংশ লিফটেই থাকে। কম্পন অনুভূত হলে সিসমিক সেন্সর সব লিফট/এলিভেটরে সংক্রিয় হয়ে উঠে। এটি সংযোজনের বিষয়টি ভবন/ইমারত নির্মাণ বিধিতেই উল্লেখ করা থাকে। তবে আশঙ্কা থেকেই যায়। সেই শক্তিশালী ভূমিকম্পের আঘাত ভবনটি সইতে পারবে কী না। যদি গোটা ভবন বিধ্বস্ত হয়ে যায় তবে এসব কিছুই কার্যকর থাকবে না।’
বুয়েটের এই অধ্যাপক আরও জানান, বাংলাদেশে অধিকাংশ লিফটে এমন সিসমিক সেন্সর কার্যকর আছে কি না তা এখনও স্পষ্ট করে জানা যায়নি।
ভূমিকম্পের সময় লিফট যদি ঠিক মতো না খোলে সেক্ষেত্রে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে হবে এবং ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। হঠাৎ ঝাঁকুনিতে শরীর সামলে রাখতে দেয়ালে বা রেলিংয়ে হালকা ভর দিতে হবে। দরজা খুলতে বা জোর করে বের হওয়ার চেষ্টা করা উচিত হবে না। লিফট-শ্যাফটের ভেতর দীর্ঘ ফাঁকা জায়গা থাকে। ভুল পদক্ষেপে যে কেউ প্রাণঘাতী উচ্চতা থেকে পড়ে যেতে পারে।
এ সময় ইমার্জেন্সি বাটন চাপতে হবে। অধিকাংশ লিফটে জরুরি ফোন বা অ্যালার্ম থাকে। সেটি চাপলে নিরাপত্তাকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে। স্পিকার বা মোবাইল সংযোগ থাকলে সাহায্য চাইতে হবে এবং তাদেরকে নিজের অবস্থান জানাতে হবে এবং শান্ত থাকতে হবে। কেবিনের ভেতরে অক্সিজেন বাঁচিয়ে রাখতে অহেতুক চিৎকার, আতঙ্ক বা দৌড়াদৌড়ি করা উচিত হবে না। ধীরে ধীরে শ্বাস নিতে হবে। কম্পন থেমে যাওয়ার পরেও নিজে থেকে বের হওয়া উচিত হবে না। উদ্ধারকারী দল এসে দরজা নিরাপদভাবে না খোলা পর্যন্ত অপেক্ষা করা ভালো।
যে কাজগুলো কখনোই করা উচিত নয় এদের মধ্যে রয়েছে লিফটের দরজায় লাথি মারা বা জোর করে তা খুলতে চেষ্টা করা, লিফটের ছাদের হ্যাচ (ঢাকনা) খোলার চেষ্টা করা, লাফ দিয়ে নিচে বা পাশে নামার চেষ্টা করা, ছোট জায়গায় ধাক্কাধাক্কি করা। এসব কাজ মৃত্যুর ঝুঁকি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে।
ভূমিকম্প পূর্বাভাসহীন এমনই একটি দুর্যোগ যা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, কিন্তু এটি মোকাবিলা করা ও জীবন বাঁচাতে ধৈর্য সবচেয়ে বড় সহায়ক হতে পারে। চলন্ত লিফটে আটকে পড়া নিঃসন্দেহে আতঙ্কের, কিন্তু বিশেষজ্ঞরা একমত-সবচেয়ে বিপজ্জনক কাজ হলো আতঙ্কিত হয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া।
শান্ত থাকা, দরজা না খোলা, জরুরি সাহায্যের সংকেত দেয়া-এই তিনটি আচরণই লিফটে আটকে পড়লে জীবন বাঁচাতে সবচেয়ে কার্যকর হতে পারে। দুর্যোগের মুহূর্তে সচেতনতা ও ধৈর্য মানুষকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারে।