মুঘল আমলের রাজকীয় রীতি থেকে আজকের বিয়ে
লাইফস্টাইল ডেস্ক
প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০২:২৯ পিএম
শীত নামলেই আমাদের সমাজে বিয়ের মৌসুম যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়। গাঁয়ের মেঠোপথ থেকে শহরের ঝলমলে কমিউনিটি সেন্টার সব জায়গাই তখন আলো, রং আর নাচগানের আমেজে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। ধূপ-ধুনোর সুগন্ধ, হলুদের ছোঁয়া, বরযাত্রার আগমন সবকিছু মিলিয়ে শীতের বিয়ে বাংলাদেশে আলাদা আনন্দময় উৎসব তৈরি করে। বহু যুগ ধরে মানুষের জীবনে বিয়ে শুধু সামাজিক বন্ধন হিসেবে নয়, সঙ্গে একেকটি সময়ের সাংস্কৃতিক পরিচয়-ও বহন করে চলেছে।
এই পরিচয়ের শেকড় ছুঁয়ে যায় মধ্যযুগের মুঘল আমলেও। আজ আমরা বিয়ে বলতেই ভাবি সাজসজ্জা, নাচগান আর সামাজিক বৈধতা। কিন্তু মুঘল যুগে বিয়ে ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন এক আনুষ্ঠানিকতা। বিশেষ করে সম্রাট ও রাজপরিবারে বিবাহ মানেই ছিল রাজনীতি, সংস্কৃতি, ধর্ম, আচার আর ক্ষমতার এক অনন্য মিশ্রণ।
মুঘল আমলে বিয়ে শুধু দুইজন মানুষের সম্পর্কই ছিল না! ছিল দুই পরিবারের দুই রাজশক্তির, কখনো দুই সংস্কৃতির মিলন। বিশেষ করে মুঘল সম্রাটদের সঙ্গে রাজপুত কন্যাদের বিবাহ ছিল রাষ্ট্র পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
মুঘলরা বিশেষ করে আকবর বিবাহকে দেখেছিলেন সমন্বয়ের সেতু হিসেবে। তাই তিনি রাজপুত রাজাদের সঙ্গে যে বিবাহ জোট করেছিলেন, সেগুলো ছিল রাজনৈতিক শান্তি, সামরিক সহযোগিতা ও সাংস্কৃতিক মিলনের পথ।
মুঘল দরবারে বিয়ের প্রস্তুতি শুরু হতো মাসখানেক কিংবা আরও আগে থেকে। দরবারে পাঠানো হতো বিশেষ দূত, যারা উভয় পরিবারের রীতি-নীতি ও শর্ত ঠিক করতো। বরপক্ষের পক্ষ থেকে পাঠানো নিশান, উপহার, মেহেদি, গয়না, রেশমি পোশাক, মোতি, মসলা, এমনকি সুগন্ধি তেল পর্যন্ত লিখিত তালিকা আকারে পাঠানো হতো।
বিয়ের আগেই ঠিক হতো কন্যা তার ধর্ম পালন করতে পারবেন কি না। কন্যাকে কী মর্যাদা দেওয়া হবে! পণের বদলে কী ‘উপহার’ পাঠানো হবে কিংবা বিবাহের দিন ‘শাহী বরযাত্রা’ কেমন হবে!
রাজপুত কন্যার ক্ষেত্রে আকবর সবসময়ই ধর্মীয় স্বাধীনতা দিয়েছেন। বিয়ে হতো হিন্দু রীতিতে, আর দরবারে প্রবেশের পর আলাদাভাবে নিকাহ বা শাহী ঘোষণার মাধ্যমে বিবাহকে রাজনৈতিক বৈধতা দেওয়া হতো।
মুঘল বরযাত্রা ছিল যেন এক চলমান সাম্রাজ্য! মশালবাহী সৈনিক, ঘোড়সওয়ার বীর, হাতিতে সোনার হাওদা, ঘোড়াতে রেশমি গদি, সুর ও বাজনার ঢল সবকিছুই দেখিয়ে দিত সম্রাটের মহিমা কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত।
বর তখন সজ্জিত থাকতেন দামি পোশাকে, হীরের তুর্বান অলংকার, রত্নখচিত তলোয়ারে। রাজপুত রাজবাড়ির পথে শাহী বরযাত্রা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে এগোত। মানুষ দাঁড়িয়ে দেখত মুঘল রাজসৌন্দর্যকে।
মুঘল-রাজপুত বিবাহের সবচেয়ে অনন্য অংশ ছিল দুই ধারার রীতির সমন্বয়। রাজপুত রীতিতে অগ্নি সাক্ষী বিবাহ, হলুদ, সংগীত, কঙ্কণ বাঁধা, কুলদেবীর আশীর্বাদ সবই হতো। অন্যদিকে আবারো মুঘল রীতিতে নিকাহ ঘোষণা, মোহরানা নির্ধারণ, শাহী ফারমান ও উপাধি প্রদান করা হতো।
রাজকন্যারা মুঘল প্রাসাদেও নিজের ধর্ম পালন করতেন। তাদের আলাদা মন্দির, পুরোহিত, এমনকি উৎসবের জন্য বরাদ্দ থাকতো বিশেষ সামগ্রী। হীরকুমারী/মরিয়ম-উজ-জামানি এর অন্যতম উদাহরণ...তিনি হিন্দু রীতিনীতি পালন করতেন বলে ইতিহাসবিদদের মধ্যে সাধারণ মত আছে। কুলদেবীর মূর্তি নিজের সঙ্গে রাখতেন বলেও জানা যায়।
মুঘল আমলের বিয়ের ভোজ-ও ছিল চোখধাঁধানো। ছিল অনেক পদের খাবার, পরিবেশন হতো সোনা-রুপার বাসনে। জাফরানি পোলাও, কেশরি খিচড়া, বাদামি কোর্মা, শাহী টুকড়া, দুধ-নেহারী, ফালুদা-শিরা। এছাড়া আতিথেয়তার জন্য অতিথিদের দেওয়া হতো কাপড়, সুগন্ধি, রেশম, ফল-মসলা।
বর্তমানে আমরা যে আলো ঝলমলে শীতের বিয়ে দেখি যেমন রঙিন আলো, সানাই, সাজসজ্জা এগুলো অনেকটাই মধ্যযুগের সেই রাজকীয় আচার-অনুষ্ঠানের রেশ বহন করে। মেহেদি থেকে হলুদ, বরযাত্রা থেকে বিয়ের ভোজ অনেক বিষয়ই সময়ের পালাবদলে রূপ বদলে আজও টিকে আছে।
মুঘল আমলে বিয়ে ছিল রাজনীতি আর সভ্যতার মিলন। আজ তা আমাদের সমাজে ভালোবাসা, পরিবার ও উৎসবের মিলনে রূপ নিয়েছে। তবু একটি জিনিস অপরিবর্তিত বিয়ে এখনো মানুষের জীবনের অন্যতম মহিমান্বিত, আনন্দময় মুহূর্ত।