অ্যালকালাইন ওয়াটার নিয়ে নানা রকম স্বাস্থ্য- দাবি শোনা যায়। কেউ বলেন এটি নাকি দীর্ঘমেয়াদি রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে, আবার কেউ বলেন নারীদের মেনোপজের উপসর্গ কমাতেও এটি কার্যকর। তবে এসব দাবি সবসময় বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়।
অ্যালকালাইন ওয়াটার সাধারণ পানির তুলনায় একটু কম অ্যাসিডিক এবং এতে কিছু অ্যালকালাইন খনিজ থাকে। অনেকে মনে করেন এটি শরীরের pH ব্যালান্স ঠিক রাখতে সাহায্য করে, বার্ধক্য কমায় এবং ক্যানসারের মতো রোগ প্রতিরোধেও ভূমিকা রাখে।
কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- খাদ্য বা পানি দিয়ে আপনার রক্তের pH খুব একটা পরিবর্তন করা যায় না। আমাদের কিডনি এবং ফুসফুস রক্তের pH সবসময় ৭.৩৫ থেকে ৭.৪৫-এর মধ্যে ধরে রাখে, যা সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য জরুরি।
তাহলে কি অ্যালকালাইন ওয়াটার সত্যিই উপকারী? চলুন বিস্তারিত জেনে নিই।
প্রথমেই জেনে নিই অ্যালকালাইন ওয়াটার কী? ‘অ্যালকালাইন’ শব্দটি আসছে পানির pH মাত্রা থেকে। pH স্কেল ০ থেকে ১৪ পর্যন্ত হয়। ০ মানে খুব অ্যাসিডিক, আর ১৪ মানে খুব অ্যালকালাইন।
অ্যালকালাইন ওয়াটারে সাধারণত ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম বা আয়রনের মতো খনিজ থাকে, যা পানির pH বাড়ায়।
অ্যালকালাইন ওয়াটার বনাম সাধারণ পানি
সাধারণ পানির pH প্রায় ৭, অর্থাৎ নিরপেক্ষ। অ্যালকালাইন ওয়াটারের pH সাধারণত ৮ বা ৯ হয়। তবে শুধু pH বেশি হলেই পানি ‘স্বাস্থ্যকর’ হয়ে যায় না। এতে থাকতে হয় - অ্যালকালাইন খনিজ ও নেগেটিভ ORP (Oxidation-Reduction Potential), যা পানির অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্ষমতা মাপা হয়।
অ্যালকালাইন ওয়াটার কি আসলেই ভালো?
এ নিয়ে এখনও বিতর্ক আছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এর উপকারিতা নিয়ে যে সব দাবি করা হয়, তার অনেকটাই এখনো প্রমাণিত নয়। তবে কিছু ছোটখাটো গবেষণায় কিছু ইতিবাচক দিক দেখা গেছে। ২০২০ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ইঁদুরের শরীরে অ্যালকালাইন ওয়াটার DNA-এর বয়স–সংক্রান্ত কিছু সূচক উন্নত করেছে।
২০১৮ সালের জাপানের এক ছোট গবেষণা ৬০ জন মানুষের মলত্যাগ কিছুটা উন্নত হয়েছে বলে জানায়। ২০২১ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, মেনোপজ-পরবর্তী অস্টিওপোরোসিস রোগীদের হাড়ের ঘনত্ব কিছুটা উন্নত হতে পারে। তবে এসব ফল প্রমাণ করতে এখনও বড় পরিসরের মানব-গবেষণা প্রয়োজন।
কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে?
সাধারণভাবে অ্যালকালাইন পানি নিরাপদ বলে ধরা হয়। এখন পর্যন্ত ক্ষতিকর প্রভাবের বড় প্রমাণ নেই।
তবে মনে রাখতে হবে, যদিও এর pH সাধারণ পানির তুলনায় বেশি, তবুও শরীর নিজে থেকেই পেটের অ্যাসিড তৈরি করে pH ব্যালান্স ঠিক রাখে।
প্রাকৃতিক নাকি কৃত্রিম?
অ্যালকালাইন পানি দুভাবে পাওয়া যায়—
প্রাকৃতিক অ্যালকালাইন পানি
পাহাড়ি ঝরনা বা পাথরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলে পানি প্রাকৃতিকভাবে খনিজ সংগ্রহ করে।
এটি তুলনামূলক নিরাপদ।
কৃত্রিম অ্যালকালাইন পানি
‘ইলেক্ট্রোলাইসিস’ নামে একটি প্রক্রিয়ায় সাধারণ পানির pH বাড়ানো হয়।
এর জন্য ‘ওয়াটার আয়নাইজার’ ব্যবহার করা হয়।
সমস্যা হলো, অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এর সব দাবির পেছনে মানসম্মত গবেষণা নেই। আবার পানির উৎস যদি ভালো না হয়, তাহলে এতে ক্ষতিকর উপাদানও থাকতে পারে।
এ ছাড়া অতিরিক্ত pH (৯.৮-এর বেশি) হলে কিছু ঝুঁকি দেখা দিতে পারে, যেমন-
- হাইপারক্যালেমিয়া (রক্তে পটাশিয়াম বেড়ে যাওয়া)
- শরীর থেকে ভিটামিন-খনিজ কমে যাওয়া
- শিশুদের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হওয়া
- পেটের মিউকাস লেয়ারে ক্ষতি
- অতিরিক্ত পিপাসা
কোথায় পাবেন অ্যালকালাইন পানি?
সুপারশপ, হেলথ স্টোর এবং অনলাইনে সহজেই পাওয়া যায়। বাড়িতেও বানানো যায়—pH ড্রপস বা বেকিং সোডা দিয়ে পানি একটু অ্যালকালাইন করা যায়।
তবে পানি যেন ভালোভাবে ফিল্টার করা, ক্ষতিকর উপাদানমুক্ত ও নিরাপদ উৎস থেকে সংগ্রহ করা হয়, এটা নিশ্চিত করতে হবে।
এর সুবিধা-অসুবিধা কী?
সুবিধা
- কিছু খনিজ সরবরাহ করতে পারে
- হজম বা হাড়ের সমস্যাসংক্রান্ত কিছু সম্ভাব্য উপকার থাকতে পারে
অসুবিধা
- অধিকাংশ দাবি এখনো গবেষণায় প্রমাণিত নয়
- দীর্ঘমেয়াদে কৃত্রিম অ্যালকালাইন পানি ঝুঁকি তৈরি করতে পারে
কারা পান করা এড়াবেন?
- কিডনি রোগী বা দুর্বল কিডনি ফাংশন থাকা মানুষ
- বিশেষ করে আয়নাইজড অ্যালকালাইন ওয়াটার
অ্যালকালাইন পানি নিয়ে সমস্যাটি এর নিরাপত্তা নয়, বরং এর উপকারিতা নিয়ে অতিরঞ্জিত দাবি। কিছু সীমিত গবেষণায় উপকার পাওয়া গেলেও রোগের চিকিৎসায় এটি ব্যবহারের মতো যথেষ্ট প্রমাণ নেই। প্রাকৃতিক অ্যালকালাইন পানি সাধারণত নিরাপদ, কারণ এতে প্রাকৃতিক খনিজ থাকে।
তবে কৃত্রিম অ্যালকালাইন পানি ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা উচিত, এতে খনিজ কম থাকতে পারে এবং উৎস ভালো না হলে দূষিত হওয়ার ঝুঁকিও থাকে।
সুতরাং, অ্যালকালাইন পানি পান করা ক্ষতিকর নয়, তবে এটি ‘অলৌকিক স্বাস্থ্য সমাধান’ এমন ভাবা ঠিক নয়। পর্যাপ্ত পানি পান, সুষম খাদ্য ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনই বেশি কার্যকর।
সূত্র: হেলথলাইন