ভাইরাল ‘শাড়ি পোর্ট্রেট’, ট্রেন্ডের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক গভীর সংকট
লাইফস্টাইল ডেস্ক
প্রকাশ: ০৭ নভেম্বর ২০২৫, ০৫:৩২ পিএম
দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়া এক ভাইরাল ট্রেন্ড, নাম ‘শাড়ি পোর্ট্রেট’। পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার নারীরা নিজেদের ছবি এআই অ্যাপে আপলোড করে ডিজিটাল শাড়ি পোর্ট্রেট বানাচ্ছিলেন—দ্যুতিময় মুখ, নরম পটভূমি, নিখুঁতভাবে আঁটা শাড়ির ভাঁজ।
অনেকের জন্য এটি ছিল মজার, আত্মপ্রকাশের বা সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের দেখা এক সুন্দর উপায়। কিন্তু এক পাকিস্তানি নারীর জন্য এই অভিজ্ঞতা রূপ নেয় অস্বস্তিতে।
তিনি যখন নিজের ছবি গুগলের জেমিনি এআই-তে জমা দেন, ফেরত পাওয়া ছবিতে দেখা যায় তার হাতে একটি তিল—যা বাস্তবে ছিল, কিন্তু ছবিতে দৃশ্যমান ছিল না।
বিষয়টি তার মনে প্রশ্ন তোলে—এআই কি এমন কিছু ‘জানতে’ পারে যা সে দেখেনি? নাকি এটি এমন কোনো নিদর্শন বিশ্লেষণ করছে যা তিনি কখনও শেয়ার করেননি?
এটি কেবল এক নারীর গল্প নয়; এটি দেখায় কীভাবে নিয়ন্ত্রণহীন প্রযুক্তি ভয় ও নিপীড়নের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে—বিশেষ করে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীদের জন্য।
ডেটা সুরক্ষা
জেমিনি ও মিডজার্নির মতো জেনারেটিভ এআই সিস্টেম বিশাল অনলাইন ছবি, ভিডিও ও টেক্সটের ডেটাসেট থেকে শেখে। তারা মানুষের মতো ‘দেখে’ না, বরং নিদর্শন বিশ্লেষণ করে মুখাবয়ব, শরীরের গঠন ও সাংস্কৃতিক ইঙ্গিত চিনে নেয় এবং সেখান থেকে নতুন কিছু অনুমান বা পুনর্নির্মাণ করতে পারে—এমনকি ছবিতে দৃশ্যমান না থাকলেও।

যেসব দেশে কঠোর ডেটা সুরক্ষা আইন আছে, সেখানে বিষয়টি ইতোমধ্যেই উদ্বেগজনক। কিন্তু পাকিস্তানে, যেখানে ডেটা প্রটেকশন আইন এখনো খসড়া অবস্থায়, এটি এক অনিবার্য সংকটের পূর্বাভাস। ইউরোপের জিডিপিআর মডেল অনুসারে তৈরি পার্সোনাল ডেটা প্রোটেকশন বিল নাগরিকদের অধিকার ও স্বচ্ছতার প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু বছর কেটে গেলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।
ফলে নারীরা রয়েছেন এক আইনি শূন্যতায়—যেখানে না সিনথেটিক ছবি সৃষ্টির, না এআই অনুমানভিত্তিক বিশ্লেষণের কোনো আইনি কাঠামো আছে।
ডিজিটাল অধিকারকর্মী সদাফ খান বলেন, ‘এআই-নির্দিষ্ট নীতি না থাকলেও পেকা (পিইসিএ) আইন ডিপফেক বা ডিজিটাল অপব্যবহার মোকাবিলা করতে পারে, কিন্তু ডেটা প্রটেকশন আইনগুলো এখনো এআই-সম্পর্কিত বিষয়গুলো পুরোপুরি কাভার করে না। যেহেতু বেশিরভাগ এআই প্ল্যাটফর্ম বিদেশে অবস্থিত, তাই তাদের দায়বদ্ধ করা কঠিন। তবে পাকিস্তানের ভেতরে কেউ এআই অপব্যবহার করলে তাকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব।’
ডিজিটাল সহিংসতা
তবুও, লিঙ্গভিত্তিক ডিজিটাল সহিংসতায় ন্যায়বিচার এখনো অনেক দূরের বিষয়। পাকিস্তানসহ গোটা অঞ্চলে নারীদের ছবি এখন ভয়াবহভাবে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এক সময় প্রান্তিক হুমকি বলে বিবেচিত ডিপফেক পর্নোগ্রাফি এখন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক নারী ঘুম থেকে জেগে দেখেন, টেলিগ্রাম গ্রুপে বা সামাজিক মাধ্যমে তাদের নামে বিকৃত ছবি ছড়িয়ে পড়েছে, কখনো ব্ল্যাকমেইলের অস্ত্র হিসেবে।
চলতি বছরের শুরুতে এক তরুণ পাকিস্তানি কনটেন্ট ক্রিয়েটরের ইনস্টাগ্রাম ছবিগুলো বিকৃত করে ফেক নগ্ন ছবি বানানো হয়। মুহূর্তেই সেগুলো ভাইরাল হয়, শুরু হয় ট্রলিং ও হয়রানি। ভুক্তভোগী হয়েও তিনি সমাজের দোষারোপের শিকার হন—প্রমাণ করে, প্রযুক্তিনির্ভর নিপীড়ন এখানে শুধু ডিজিটাল নয়, সাংস্কৃতিকও।
ভারতেও একই ধরণের ঘটনা ঘটে, যখন নারী সাংবাদিক, কর্মী ও শিক্ষার্থীদের ছবি এক অ্যাপে পর্নোগ্রাফিক ছবির সঙ্গে মিশিয়ে ‘ভুয়া নিলামে’ তোলা হয়। সৃষ্টিকারীরা দাবি করে এটি ছিল ‘একটি মজা’, কিন্তু ভুক্তভোগীদের জন্য এটি ছিল এক গভীর আঘাত—যা তাদের ঘর, পরিবার ও নিরাপত্তা পর্যন্ত ছুঁয়ে যায়।
রক্ষণশীল সমাজে, যেখানে নারীর মর্যাদা সামাজিক পুঁজি, সেখানে এমন ডিজিটাল আক্রমণ শুধু অনলাইনেই সীমাবদ্ধ থাকে না—তা তাদের পেশাগত জীবন, সামাজিক অবস্থান এমনকি শারীরিক নিরাপত্তাও বিপন্ন করে।
সদাফ খান, যিনি মিডিয়া ম্যাটারস ফর ডেমোক্রেসির প্রতিষ্ঠাতা, বলেন, ‘ডিপফেক বাস্তব ও মিথ্যের সীমারেখা ঘোলা করে দেয়, নারীদের নিরাপত্তা ও মর্যাদাকে ঝুঁকির মুখে ফেলে। যদিও পেকা আইন এ ধরনের অপরাধকে শাস্তিযোগ্য করে, তবুও সামাজিক কলঙ্ক ও ভয়ের কারণে ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার থেকে দূরে থাকে। এটি প্রমাণ করে, আইনি সমাধানের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতারও প্রয়োজন।’
ডিপফেক
ডিপফেক একবার ছড়িয়ে পড়লে সত্য আর তত দ্রুত পেরে ওঠে না। অ্যালগরিদম ভাইরাল কন্টেন্টকেই পুরস্কৃত করে, নির্ভুলতাকে নয়। ফলে ভুক্তভোগীকেই প্রমাণ করতে হয়—যা মানুষ দেখছে, তা আসল নয়। এই মনস্তাত্ত্বিক চাপ ভয়াবহ।
যদিও পুরুষেরাও ডিজিটাল প্রতারণার শিকার হন, এর ক্ষতি লিঙ্গ-নিরপেক্ষ নয়। দক্ষিণ এশীয় সমাজে নারীর মর্যাদা ও গোপনীয়তা সামাজিকভাবে নিয়ন্ত্রিত, ফলে এ ধরনের আক্রমণ তাদের ভয় দেখানোর ও নীরব রাখার অস্ত্র হয়ে ওঠে। নারীরা অনলাইনে পোস্ট করা, কথা বলা—সব বন্ধ করে দেন। এই নীরবতা শুধু ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, রাজনৈতিকও। এটি জনপরিসর থেকে নারীর কণ্ঠ মুছে দেয়।
এই বাস্তবতায় ‘শাড়ি পোর্ট্রেট’ ট্রেন্ডটিও আর নির্দোষ মনে হয় না। প্রতিটি আপলোড, প্রতিটি ভাইরাল চ্যালেঞ্জ আসলে বিশ্বব্যাপী এআই সিস্টেমের জন্য উচ্চমানের নারী-চিত্রভাণ্ডার বাড়ায়। বেশিরভাগ প্ল্যাটফর্ম দাবি করে তারা তথ্য মুছে ফেলে বা গোপন রাখে, কিন্তু বাস্তবে স্বচ্ছতা দুর্লভ এবং দায়বদ্ধতা প্রায় নেই।
সদাফ খান বলেন, ‘বড় প্রযুক্তি ও এআই প্ল্যাটফর্মকে দায়বদ্ধ করা এক বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ। জাতিসংঘের হাই-লেভেল বডি অন এআই ও গ্লোবাল ডিজিটাল কমপ্যাক্টের মতো উদ্যোগগুলো দেখাচ্ছে—নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এআই-এর নকশাতেই নিরাপত্তা ও জবাবদিহি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।’

তবুও, যতই বড় প্রতিষ্ঠান দায়িত্বশীল হোক, তাদের ডেটাসেট বিচ্ছিন্ন নয়। একবার ব্যক্তিগত ছবি ইন্টারনেটে এলে তা স্ক্র্যাপ, বেচাকেনা বা কম নিয়ন্ত্রিত মডেল প্রশিক্ষণে ব্যবহার হতে পারে। ভবিষ্যতের ডিপফেক তৈরি করতে আর হ্যাকিংয়ের প্রয়োজন হবে না—শুধু কল্পনাই যথেষ্ট।
নারীদের জানতে হবে এআই কীভাবে শেখে
প্রতিরক্ষার প্রথম ধাপ শিক্ষা। নারীদের জানতে হবে এআই কীভাবে শেখে, অনুমান করে ও বিভ্রান্ত করে—যাতে তারা নিজেদের ভালোভাবে সুরক্ষিত রাখতে পারেন।
আইনি সংস্কারও জরুরি। পাকিস্তানকে দ্রুত পার্সোনাল ডেটা প্রোটেকশন বিল পাস করে এআই-সম্পর্কিত অপরাধের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দিতে হবে, কারণ পুরোনো পেকা আইন আর পর্যাপ্ত নয়। একইসঙ্গে আঞ্চলিক সহযোগিতা—যৌথ প্রটোকল, হটলাইন ও প্রযুক্তিগত অংশীদারিত্বের মাধ্যমেও সীমান্তপারের ডিপফেক মোকাবিলা করতে হবে।
সবশেষে, ব্যক্তিগত সচেতনতা অপরিহার্য। নারীদের এআই-ভিত্তিক ট্রেন্ডে অংশ নেওয়ার আগে ভাবতে হবে; উচ্চমানের বা সহজে শনাক্তযোগ্য ছবি শেয়ার না করাই উত্তম। প্রয়োজনে ব্লার বা ক্রপ করা সংস্করণ ব্যবহার করতে পারেন। কোনো বিকৃত বা ডিপফেক ছবি দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে রিপোর্ট করুন, এবং স্ক্রিনশট, সময় ও লিংক সংরক্ষণ করুন।
‘শাড়ি পোর্ট্রেট’ ট্রেন্ড হয়তো এক সময় হারিয়ে যাবে, কিন্তু এর সতর্কতা রয়ে যাবে—যে সমাজে নারীর ছবিই তার ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারে, সেখানে এআই-এর ‘অতিরিক্ত দেখা’ বিপজ্জনক।
আসল প্রশ্ন হলো, এআই কতটা জানে তা নয়—আমরা কতটা প্রস্তুত সেই জ্ঞানকে সামলানোর জন্য।
--------------------------------------------------------------------------
লেখক: বাতুল মুফতি
পাকিস্তানের একজন গণমাধ্যম, গবেষণা ও সৃজনশীল সেবা বিশেষজ্ঞ, বর্তমানে কাজ করছেন পাকিস্তান টিভি ডিজিটালের সঙ্গে। মূল নিবন্ধ জিও নিউজ থেকে নেওয়া।