রায়ান্স কম্পিউটারসের পণ্যে গ্রাহক ভোগান্তি
ওয়ারেন্টি সেবার নামে মাসের পর মাস হয়রানি
আইটি ডেস্ক
প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৬:৩৩ পিএম
বিক্রয়োত্তর সেবা এবং ওয়ারেন্টি প্রক্রিয়া নিয়ে চরম অনিয়ম ‘রায়ান্স কম্পিউটারস লিমিটেডে। পণ্য ক্রয়ের পর গ্রাহক ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসংখ্য ক্রেতা তাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন, যেখানে ওয়ারেন্টি ক্লেইমের নামে দীর্ঘসূত্রিতা, বারবার মেরামত সত্ত্বেও সমস্যার পুনরাবৃত্তি এবং পণ্য রিপ্লেসমেন্ট না করার মতো গুরুতর অভিযোগ উঠে এসেছে।
সূত্রমতে, ত্রুটিপূর্ণ পণ্য বদলে দেওয়ার পরিবর্তে বারবার মেরামত করে দেওয়ার চেষ্টা করছে প্রতিষ্ঠানটি, যা ভোগান্তির মূল কারণ।
রায়ান্স থেকে একটি পিসি বিল্ড করেছিলেন মোহাম্মদ তায়েব নামে এক গ্রাহক। তিনি পিসি বিল্ডার্স অব বাংলাদেশ গ্রুপে অভিযোগ করেন, কেনার মাত্র দুই দিন পরই মাদারবোর্ডে সমস্যা দেখা দেয়। ওয়ারেন্টির আওতায় যাওয়া প্রথম মেরামত করতে ১২ দিন লেগে যায়। কিন্তু সমস্যার পুনরাবৃত্তি ঘটলে, বারবার অনুরোধ করার পরও প্রতিষ্ঠানটি নতুন মাদারবোর্ডের বদলে দ্বিতীয়বারও মেরামত করেই দেয়। হতাশ মোহাম্মদ তায়েব বলেছেন, ‘তারপর থেকে রায়ান্সকে বয়কট করছি, আর সেখান থেকে কিছুই কিনি না।’
রায়ান্স কম্পিউটারসের নিজস্ব নীতিমালা অনুযায়ীও, ওয়ারেন্টির পণ্য মেরামত করতে চার-পাঁচ দিন থেকে শুরু করে ৪৫ দিনের বেশি সময় লাগতে পারে, যা আধুনিক দ্রুতগতির জীবনে গ্রাহকদের জন্য চরম ভোগান্তির কারণ। ওয়ারেন্টি সেবার পাশাপাশি, কাস্টমার সার্ভিস ও পণ্যের গুণমান নিয়েও উঠেছে গুরুতর অভিযোগ। সাব্বির হোসেন নামের একজন গ্রাহক যুগান্তরকে বলেন, আমি ভুল করে একটা রাউটার কিনছিলাম রায়ান্স থেকে। দফায় দফায় আমার ৫ বার সার্ভিসিং এ দেওয়া লাগছে। কিন্তু কোনো সমাধান দিতে পারেনি। তাই রাগে বাসায় ফেলে রেখেছি।
ওয়ারেন্টি ক্লেইম করার পর পণ্য মেরামত বা প্রতিস্থাপন থেকে অস্বাভাবিক সময় নেয় রায়ান্স। জাহিদুল হক জাহিদ নামে এক গ্রাহক অভিযোগ করেন, গত মাসের ৬ তারিখে আমার মনিটর পিক্সেল ডেড হয়ে যায়। ওয়ারেন্টি থাকায় আমি রায়ান্সের ময়মনসিংহ ব্রাঞ্চে দিয়ে আসি। তারা জানিয়েছে ৩ সপ্তাহ লাগবে বা তার আগেই পেয়ে যাব। প্রায় ২ মাস পার হতে চলল, মনিটরের কোনো খবর নেই। সার্ভিস সেন্টারে ফোন করে কোনো সদুত্তর পাননি বলেও জানান জাহিদ।
এক গ্রাহক অভিযোগ করেন, তিনি ওয়ারেন্টিতে জমা দেওয়া এসএসআই মনিটরের বদলে রিপ্লেসমেন্ট হিসাবে আসুস মনিটর পেয়েছেন। ফেসবুক ব্যবহারকারী শেখ জামাল জানান, এমএসআই মনিটর কিনে অল্পদিনেই নষ্ট হলে রায়ান্স তাকে আসুস মনিটর দেয়। তার দাবি, রায়ান্সের বিক্রয়োত্তর সেবা অত্যন্ত নিম্নমানের।
কিছু ক্রেতা রায়ান্স থেকে নকল চার্জার ও হার্ড ডিস্ক কেনার অভিযোগ তুলেছেন। ওয়ারেন্টি সেবার সময় পুরোনো বা রিফার্বিশড পণ্য দেওয়ার চেষ্টার কথাও সামনে এসেছে। লামিয়া তারান্নুম ঐশী জানান, প্রায় ১৬ হাজার টাকা দিয়ে স্যামসাং এসএসডি কেনেন। পরে দেখতে পান এটি আসল নয় বরং রিফারবিশড। ক্ষোভে তিনি এসএসডিটি দোকানে ছুড়ে দিয়ে বের হয়ে আসেন।
বগুড়া শাখার গ্রাহক এমডি ফারদিন রহমান ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রায়ান্স কম্পিউটারসের বিরুদ্ধে প্রতারণা, হয়রানি ও ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন। তিনি জানান, প্রায় এক বছর আগে বগুড়া রায়ান্স থেকে সিলমারা বক্সসহ নতুন MSI RTX ৩০৬০ গ্রাফিক্স কার্ড কেনার পর মাত্র দুই মাসের মধ্যেই সমস্যার শুরু হয়। সাত মাস ধরে সমস্যা নিয়ে ব্যবহার করার পর নো-ডিসপ্লে ত্রুটি দেখা দিলে তিনি ওয়ারেন্টিতে জমা দেন। ১৫ দিনে কাজ হওয়ার কথা বলা হলেও ৩০ দিন পর একই জিপিইউ মেরামত করে ফেরত দেওয়া হয়। কিন্তু দুই সপ্তাহের মধ্যেই আবারও একই সমস্যা দেখা দিলে তিনি নতুন ইউনিট দাবি করেন। দ্বিতীয়বার জমা দেওয়ার সাত দিন পর তাকে বক্সবিহীন ব্যবহৃত একটি জিপিইউ দেওয়া হয়। বক্স চাইলে কর্মীরা জানান, ‘এই ইউনিট এভাবেই আসে।’ বিষয়টি নিয়ে ফারদিন ফেসবুকে পোস্ট করলে রায়ান্স কর্তৃপক্ষ তা গ্রুপ থেকে মুছে দেয়, যা স্পষ্টভাবে অভিযোগ চাপা দেওয়ার চেষ্টা। পরে চাপের মুখে তারা একটি ক্ষতিগ্রস্ত, পুরোনো বক্স সরবরাহ করে। যা পুরো বা অন্য ব্যবহারকারীর একটি জিপিইউয়ের বক্স।
গ্রাহকদের অভিযোগ, শুধু সেবার মান নয় ব্যবহার ও মনোভাবেও গভীর সমস্যা রয়েছে রায়ান্সের সংশ্লিষ্টদের। ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরে অভিযোগ বা আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললে, রায়ান্সের কর্মীরা ঠাট্টার ছলে উড়িয়ে দেন। ফারদিন রহমানকে জানান, ‘মামলা করেন, দেখি কতদিন লাগে।’
প্রযুক্তি পণ্যের বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্রেতা সন্তুষ্টির জন্য কেবল কম দামই যথেষ্ট নয়, বিক্রয়োত্তর সেবার মান বজায় রাখা এবং ওয়ারেন্টি প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যে কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য অপরিহার্য।
জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমপিসিএ) সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ওয়ারেন্টি কোনো দয়া নয়, এটি গ্রাহকের অধিকার।’ তিনি বলেন, রায়ান্সসহ এমন অনেক প্রতিষ্ঠান পণ্য বিক্রির সময় লাভ ঠিকই করে নেয়, কিন্তু ওয়ারেন্টি সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে নানা অজুহাত দাঁড় করায়। গ্রাহকের ন্যায্য দাবি উপেক্ষা করা এবং হয়রানি করা এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইনের আওতায় এনে কঠোরভাবে জবাবদিহির মধ্যে আনা জরুরি, না হলে ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘন বন্ধ হবে না।
এ বিষয়ে জানতে রায়ান্স কম্পিউটারসের ওয়ারেন্টি বিভাগের প্রধান সাজ্জাদ হোসেনের সঙ্গে বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কোনো উত্তর দেয়নি। হোয়াটস অ্যাপে প্রশ্ন পাঠানো হলেও দশ মিনিট পরে জানাচ্ছি বলে তিনি সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করেন এবং এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোনো উত্তর দেননি।