বিএনপির ইশতেহারে গুরুত্ব পাচ্ছে আট প্রতিশ্রুতি
পরিবর্তনের রাজনীতি নিয়ে ভোটের মাঠে
জাগো বাংলা প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৫:১৮ এএম
পরিবর্তনের রাজনীতি নিয়ে ভোটের মাঠে নামছে বিএনপি। সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে নির্বাচনি ইশতেহার চূড়ান্ত করছে দলটি। ঘোষিত রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফা এবং জুলাই জাতীয় সনদের সমন্বয়ে এবারের ইশতেহার তৈরি হবে। এছাড়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাম্প্রতিক নানা বক্তব্যের মূল দিকনির্দেশনাও এতে প্রতিফলিত হবে। বিশেষ করে ৮টি খাতে সবচেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে দলটি। সেগুলো হলো-ফ্যামিলি কার্ড, কৃষক কার্ড, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ক্রীড়া, পরিবেশ, কর্মসংস্থান ও ধর্মীয় নেতাদের জন্য উন্নয়ন সেবা।
এজন্য মূল দল এবং অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের কর্মীদের নিয়ে বৃহৎ তথ্য-প্রচার কর্মসূচি শুরু করেছে দলটি। যেখানে ৮ নীতির প্রতিটির বিষয়ে বিস্তারিতভাবে তাদের জানানো হচ্ছে। এই কর্মীরা এলাকায় এলাকায়, ঘরে-ঘরে গিয়ে ভোটারদের কাছে প্রকৃত তথ্য পৌঁছে দেবেন। ফলে মানুষ আগেভাগেই জানতে পারবে বিএনপি তাদের জন্য কী পরিকল্পনা করেছে। এতে ভুল তথ্যের সুযোগ কমবে, ভোটাররা নিজেদের ভবিষ্যৎ ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। বিএনপির সংশ্লিষ্ট নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
নির্বাচনি প্রচারের দায়িত্বে থাকা একাধিক নেতা জানান, এটি নির্বাচনি প্রচারণায় একটি গুণগত পরিবর্তন আনবে, যেখানে ভোট বৈজ্ঞানিক যুক্তি, সমাধানের পরিকল্পনা এবং ভবিষ্যৎ জীবনের প্রত্যাশার ওপর ভিত্তি করে হবে। ভোট দিলে কী পরিবর্তন আসবে-এই প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর এখন ভোটারদের সামনে থাকবে। আর সেই উত্তর হলো-বিএনপির ধানের শীষে ভোট মানে জীবনে পরিবর্তন, জীবিকায় উন্নতি।
বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক অধ্যাপক মওদুদ হোসেন আলমগীর পাভেল বলেন, বাংলাদেশের মানুষকে আর আগের মতো ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেওয়া যাবে না। এখন প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা ও নেতৃত্ব। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি সেই পথেই হাঁটছে। তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারির নির্বাচন হবে পরিবর্তনের সুযোগ। এই পরিবর্তন হতে পারে দায়িত্বশীল রাজনীতি, জনগণের অধিকার এবং একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের পথে যাত্রা। সময় এসেছে নীতিনির্ভর রাজনীতির। সময় এসেছে জনগণের জীবনে সত্যিকার পরিবর্তনের। আট খাতে প্রতিশ্রুতিই সেই সত্যিকার পরিবর্তন আনবে বলে আশা করি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, আট খাতে প্রতিশ্রুতি ভোটের মাঠে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। কারণ, বাংলাদেশে আগে কার্ড দেওয়া হয়েছে। এখন বিএনপি কার্ডের ক্ষেত্রে যে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, সেখানে কতগুলো নতুন খাত, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। এর মধ্যে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের সুযোগ কিন্তু ইউরোপে আছে। এগুলো যদি বাংলাদেশে প্রবর্তন করা যায় এবং তা যদি সামাজিক খাতে এক ধরনের অগ্রগতি অর্জন হয়, তাহলে সামাজিক ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য এক বিরাট সুযোগ তৈরি করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান মনে করেন, সাধারণ মানুষ যারা বিপদগ্রস্ত, তারা তো আসলে এ ধরনের সুযোগ-সুবিধা রাষ্ট্রের কাছ থেকে পাবে, তা কল্পনা করে না। এখন যদি কোনো রাজনৈতিক দল, যারা ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা আছে, তারা যদি এ ধরনের কার্ড নাগরিকদের দিতে চায়, তখন তাদের মধ্যে একধরনের উচ্ছ্বাস তৈরি হবে। তারা (নাগরিক) মনে করবে, যে দল ক্ষমতায় যাবে, সেই দলকে ভোট দিলে হয়তো এই কার্ডটা পাবে। স্বাস্থ্য বা শিক্ষা খাতে যে সুবিধাগুলো পাচ্ছে না, তা তারা পাবে। সুতরাং এক্ষেত্রে একটা আস্থার জায়গা তৈরি হতে পারে।
জানা যায়, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, শাসনব্যবস্থা পুনর্গঠন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ, মানবাধিকার রক্ষা ও দুর্নীতিবিরোধী কাঠামো শক্তিশালীকরণ ইশতেহারের কেন্দ্রীয় বিষয় হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। দলের নীতিনির্ধারকরা জানিয়েছেন, জনগণকে রাষ্ট্রের মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়া এবং দলীয় প্রভাবমুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলাই হবে বিএনপির অঙ্গীকার।
ইশতেহারে বিএনপির ৩১ দফার মূল বিষয়-নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা, মানবাধিকার সুরক্ষা, বাক্স্বাধীনতা, স্বচ্ছ প্রশাসন ও জাতীয় অর্থনীতি পুনরুদ্ধার বিশদভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এছাড়া জুলাই সনদের আলোকে মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে পূর্ণ স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা দেওয়ার পরিকল্পনাও ইশতেহারে গুরুত্ব পাবে।
জানা যায়, সর্বশেষ স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দলীয় প্রচারের কৌশল নিয়ে আলোচনা হয়েছে। নির্বাচনি প্রচারে কী কী বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে, তা নিয়ে নেতারা মতামত দেন। কৌশল অনুযায়ী নির্বাচনি প্রচারে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশাকে আলাদাভাবে টার্গেট করবে বিএনপি।
দলটির দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারেক রহমানের নেতৃত্বে পরিবর্তনের রাজনীতির আলোকেই বিএনপির এই ৮ খাতে প্রতিশ্রুতি। এর মধ্যে রয়েছে ফ্যামিলি কার্ড। সেখানে বলা হয়েছে, বিএনপি প্রতিটি পরিবারে প্রাপ্তবয়স্ক নারীর নামে ফ্যামিলি কার্ড চালু করবে, যাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সাশ্রয়ী দামে পাওয়া যায়। প্রতিটি পরিবার মাসে ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা সমমূল্যের খাদ্য ও জরুরি পণ্য পাবে। এর ফলে পরিবারগুলোর কিছু টাকা সঞ্চয় হবে। সেই সঞ্চয়ের মাধ্যমে নারী সদস্যের নেতৃত্বে আয়ের ছোট উদ্যোগ শুরু করা সম্ভব হবে, যা হবে নারীর ক্ষমতায়ন ও সামাজিক সুরক্ষার একটি স্থায়ী পথ। কৃষক কার্ডের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে-কৃষক কার্ড চালু হলে কৃষক স্বল্পমূল্যে সার, উন্নত বীজ ও কৃষিপ্রযুক্তি পাবেন। পাশাপাশি সহজে ঋণ এবং বাজারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত হবে। এতে কৃষি উৎপাদন বাড়বে, কৃষকের আয় বাড়বে এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা আরও শক্তিশালী হবে। কৃষক বাঁচলে দেশও বাঁচবে।
স্বাস্থ্যসেবা খাত নিয়ে বলা আছে, বিএনপি প্রতিটি মানুষের দোরগোড়ায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেবে এবং সারা দেশে শক্তিশালী প্রাইমারি হেলথ কেয়ার নেটওয়ার্ক গড়ে তুলবে। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ধরনের অন্তত ১ লাখ দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেওয়া হবে, যার ৮০ শতাংশই নারী হবেন। যাতে নারী ও শিশুর সেবা আরও সহজে পাওয়া যায়। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা হবে সবার অধিকার, আর তা পৌঁছে যাবে প্রতিটি গ্রাম, শহরের ওয়ার্ড ও মানুষের ঘরের খুব কাছে।
শিক্ষায় মুখস্থ বিদ্যায় নয়, চাহিদাভিত্তিক শিক্ষা এবং দক্ষতা ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার মাধ্যমে তরুণদের ভবিষ্যৎ উন্নত করা হবে। প্রাথমিক শিক্ষায় বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে এবং শিক্ষকদের অবস্থান ও আর্থিক সুরক্ষা করা হবে উন্নত। পাঠ্যক্রমের সঙ্গে শিল্প ও কর্মক্ষেত্রের বাস্তব যোগসূত্র তৈরি করা হবে, যেন শিক্ষার ফল বাস্তব চাকরি ও উদ্যোগে কাজে লাগে। শুধু সার্টিফিকেট নয়, কাজের দক্ষতা বাড়ানোই হবে বিএনপির মূল লক্ষ্য।
ক্রীড়ার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে-ক্রীড়াকে শুধু শখ নয়, পেশা হিসাবেও গ্রহণযোগ্য করতে বিএনপি সব স্তরে খেলাধুলার উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেবে। স্কুল ও কলেজে খেলাধুলাকে বাধ্যতামূলক করা হবে এবং পর্যাপ্ত ক্রীড়া শিক্ষক ও প্রশিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে। এতে নতুন প্রতিভা তৈরি হবে, তরুণরা কর্মসংস্থানের নতুন ক্ষেত্র পাবে এবং সামাজিক ক্ষতি কমবে।
পরিবেশে বলা আছে, বিএনপি নবায়নযোগ্য শক্তি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও রিসাইক্লিং বাড়িয়ে প্রকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করবে। পাশাপাশি কৃষি উৎপাদন বাড়াতে এবং মৌসুমি বন্যা থেকে মানুষকে রক্ষা করতে সারা দেশে ২৫ হাজার কিলোমিটার খাল-নদী খনন ও পুনঃখনন করা হবে।
কর্মসংস্থানে এসএমই, ব্লু ইকোনমি, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও আইসিটি খাতে ব্যাপক নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি করা হবে। যাতে পরিবারে আয় বাড়ে ও অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হয়। বিএনপি তথ্যপ্রযুক্তি, ই-কমার্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সাইবার নিরাপত্তা, গেমিং ও স্টার্টআপ খাতকে কর্মসংস্থানের প্রধান উৎসে পরিণত করবে। একই সঙ্গে বিদেশি শ্রমবাজারে নতুন সুযোগ খুঁজে বের করে এবং দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে আরও বেশি তরুণকে ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্টে পাঠানো হবে।
ধর্মীয় নেতাদের সেবায় বলা হয়েছে, বিএনপির পরিকল্পনা প্রতিটি খতিব, ইমাম, মুয়াজ্জিন এবং অন্যান্য ধর্মের পুরোহিত, পাদরিসহ ধর্মীয় নেতারা মাসিক সম্মানি পাবেন, যাতে তাদের জীবনমান উন্নত হয়। ধর্মীয় উৎসব ও বিশেষ অনুষ্ঠানে আর্থিক সুবিধা ও সহায়তা প্রদান করা হবে।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন বলেন, মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে, কৃষক ন্যায্য দাম পান না, তরুণরা বেকার হয়ে ঘুরছেন, স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় মানসম্মত সেবা পাওয়া কঠিন। গত দেড় যুগেরও বেশি রাজনীতি শুধু প্রতিশ্রুতি আর স্লোগানে ভরা ছিল; কিন্তু মানুষের জীবনে তা তেমন কোনো সুখবর বয়ে আনেনি। এখন সময় এসেছে এমন রাজনীতির, যা কথার চেয়ে কাজে বিশ্বাস করবে। বিএনপি সেই প্রস্তুতি নিয়েই এগোচ্ছে। বিএনপি এখনই জনগণের জীবনোদ্ধারমূলক কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছে, যাতে ক্ষমতায় গেলে সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু করা যায়।
তিনি আরও বলেন, এটি নির্বাচনি প্রচারণায় একটি গুণগত পরিবর্তন আনবে, যেখানে ভোট বৈজ্ঞানিক যুক্তি, সমাধানের পরিকল্পনা এবং ভবিষ্যৎ জীবনের প্রত্যাশার ওপর ভিত্তি করে হবে। ভোট দিলে কী পরিবর্তন আসবে-এই প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর এখন ভোটারদের সামনে থাকবে।