আসন্ন সংসদ নির্বাচনে দু’দফায় ২৭২টি আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি। বাকি ২৮টি আসন এখনো ফাঁকা রেখেছে দলটি। এসব আসন নিয়ে নানা হিসাবনিকাশ চলছে। মূলত যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দল ও জোটের জন্য ফাঁকা রাখা হয়েছে আসনগুলো। ইতিমধ্যে আসন সমঝোতা নিয়ে সমমনাদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলাপ-আলোচনা করছেন দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। তবে এখনো কোনো সমঝোতা হয়নি। অল্প সময়ের ভেতরে আসন নিয়ে চূড়ান্ত সমঝোতা হবে বলে জানা গেছে। যদিও দ্বিতীয় ধাপে ঘোষিত ৩৬ আসনের মধ্যে সমমনা দল ও জোটের তিন নেতার আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি। বিষয়টি নিয়ে সমমনাদের অনেক নেতা হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ওদিকে সমমনাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই দুই দফা দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে বলে দাবি করেছে বিএনপি। তবে বিষয়টি নাকচ করেছেন সমমনা দলের নেতারা। তারা বলছেন, প্রথম দফার ২৩৬টি আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণার আগে বিএনপি সমমনা দল ও জোটের কাছ থেকে তাদের প্রার্থী তালিকা চেয়েছিল। সেটা তারা দিয়েছে। পরে দলীয় প্রার্থী ঘোষণার আগে তারা সমমনা দল ও জোটের সঙ্গে কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনা করেনি।
বিএনপি’র একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, ঢাকায় কয়েকটি আসনে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টার জন্য সমঝোতা সাপেক্ষে আসন ফাঁকা রাখা হয়েছিল। দ্বিতীয় ধাপে ঢাকায় ৪টি আসনে প্রার্থী ঘোষণার পর সেই সমঝোতার সম্ভাবনার অবসান ঘটে। সূত্রটি জানায়, দ্বিতীয় ধাপে অনেক বিচার-বিশ্লেষণ করে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছে বিএনপি। যাদের দিলে বিজয় নিশ্চিত হবে, এমন নেতাদের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। আবেগে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। যদিও সমমনাদের তিন নেতার আসনে বিএনপি দলীয় প্রার্থী দিয়েছে, সেসব নিয়ে সামনে তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করবে বলে জানা গেছে।
বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, সমমনাদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। আমরা তাদের সমর্থন দেবো। তারা যেসব আসনে প্রার্থী দেবে, আমরা সেখানে প্রার্থী দেবো না। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
ঢাকার ২০টি আসনের মধ্যে প্রথম দফায় ১৩টিতে প্রার্থী ঘোষণা করেছিল বিএনপি। ৭টি আসন ফাঁকা রাখা হয়েছিল। দ্বিতীয় ধাপে ৪টিতে প্রার্থী ঘোষণা করেছে দলটি। ঢাকা-৭, ঢাকা-৯, ঢাকা-১০ এবং ঢাকা-১৮ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। ঢাকা-১৩, ঢাকা-১৭ ও ঢাকা-২০ আসনে এখনো ফাঁকা রেখেছে বিএনপি। এর মধ্যে ঢাকা-১৩ আসনে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ এবং ঢাকা-১৭ আসনে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিভ রহমান পার্থকে বিএনপি সমর্থন দিচ্ছে। তারা দু’জন ইতিমধ্যে বিএনপি’র গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে নির্বাচনী এলাকায় প্রচার-প্রচারণাও শুরু করেছেন। অন্যদিকে ঢাকা-২০ আসনে বিএনপি’র মনোনয়নপ্রত্যাশী ৪ জন। তারা হলেন- বিএনপি’র নির্বাহী কমিটির সদস্য তমিজ উদ্দিন, ঢাকা জেলা যুবদলের সভাপতি ইয়াসিন ফেরদৌস (মুরাদ), মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমেদ এবং ঢাকা জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক নাজমুল হাসান (অভি)।
ওদিকে আসন ইস্যুতে গতকাল ১২ দলীয় জোট বৈঠক করেছে। সেখানে শরিক দলের নেতাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে প্রার্থী ঘোষণায় বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ তারা। বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান শরিকদের সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচন ও সরকার গঠনের যে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এই ২৭২টি আসনে মনোনয়ন ঘোষণার মাধ্যমে প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ করা হয়েছে বলেও বৈঠকে আলোচনা করেন নেতারা। অন্যদিকে বিএনপি’র সঙ্গে দীর্ঘ ২০ বছরের রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ লেবার পার্টি। ২০০৬ সাল থেকে বিএনপি’র শরিক হিসেবে সমমনা দল, ১৮ দলীয় জোট এবং পরবর্তীতে ২০ দলীয় জোট, যুগপৎভাবে ছিল লেবার পার্টি।
গতকাল লেবার পার্টির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বলে এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, আসন নিয়ে বিএনপির সঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চের চূড়ান্ত কোনো কিছু এখনো হয়নি। অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলছে। চূড়ান্ত আলোচনা এখনো হয়নি। আর প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে প্রার্থী তালিকা ঘোষণার আগে বিএনপি’র সঙ্গে আমাদের কোনো আলোচনা হয়নি। আমার জানা মতে, অন্য শরিকদের সঙ্গেও আলোচনা হয়নি।
জোটের তিন নেতা বঞ্চিত : ঘোষিত ৩৬ আসনের মধ্যে বিএনপি’র দীর্ঘদিনের মিত্র তিন দলের তিন নেতাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ১২ দলীয় জোটের শরিক ও জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা কিশোরগঞ্জ-৫ আসন থেকে নির্বাচন করার জন্য কাজ করছিলেন। এর আগে ওই আসনে তাকে কাজ করার জন্য চিঠিও দেয়া হয়েছিল বিএনপি থেকে। নড়াইল-২ আসনে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে এই আসন থেকে তিনি ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করেছিলেন। এবারো এই আসনে তিনি মনোনয়ন পাবেন বলে মনে করেছিলেন এনপিপির নেতাকর্মীরা। তবে এই আসনে বিএনপি নেতা মনিরুল ইসলামকেই বেছে নিয়েছে দলটি। একইভাবে বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান ঝালকাঠি-১ আসন থেকে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। যদিও ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি পিরোজপুর-২ আসন থেকে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করেছিলেন। তার বাড়িও এই জেলায়। তবে এবার তিনি ঝালকাঠি-১ আসন থেকে মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।
ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, বিএনপি তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি, তারা প্রতিশ্রুতি থেকে দূরে সরে গিয়েছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে শিগগিরই নিজেরা বসবো। এরপরে বিএনপি’র সঙ্গে বসে আমাদের সিদ্ধান্ত জানাবো।
যেসব আসনে লড়তে চান জোটের প্রার্থীরা: পিরোজপুর-১ আসনে জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার, বগুড়া-২ আসনে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, লক্ষ্মীপুর-১ আসনে বাংলাদেশ এলডিপি’র চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব অসুস্থ হওয়ায় লক্ষ্মীপুর-৪ আসনে তার স্ত্রী তানিয়া রব লড়তে পারেন। এ ছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ আসনে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, চট্টগ্রাম-১৪ আসনে এলডিপি’র চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদের ছেলে অধ্যাপক ওমর ফারুক, কুমিল্লা-৭ আসনে দলটির মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ, পটুয়াখালী-৩ আসনে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর এবং ঝিনাইদহ-২ আসনে দলটির সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খানের নাম আলোচনা আছে। ওদিকে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর উবায়দুল্লাহ ফারুক সিলেট-৫, মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী নীলফামারী-১, কেন্দ্রীয় নেতা মোহাম্মদ আলী সিলেট-৪, জুনায়েদ আল হাবিব, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২, মনির হোসেন কাসেমী নারায়ণগঞ্জ-৪, মোখলেছুর রহমান চৌধুরী কিশোরগঞ্জ-১, শোয়ায়েব আহমদ সুনামগঞ্জ-২ আসনে মনোনয়ন চাইছেন।