দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি। তিনশ সংসদীয় আসনের প্রতিটিতেই তাদের একাধিক যোগ্য প্রার্থী রয়েছে। কিন্তু নির্বাচনে দলের পক্ষ থেকে মনোনয়নের জন্য একজন প্রার্থীকেই বেছে নিতে হয়েছে। আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণার পর এরই মধ্যে অন্তত অর্ধশত আসনে প্রার্থিতা নিয়ে টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। মনোনয়নবঞ্চিতদের সমর্থকরা অনেক স্থানে বিক্ষোভসহ নানা কর্মসূচি পালন করছেন। আবার অনেক সংসদীয় আসন থেকে দলের নীতিনির্ধারকদের কাছে প্রার্থিতা পুনর্বিবেচনার আবেদন করা হয়েছে।
গত ৩ নভেম্বর ২৩৭ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করে বিএনপি। এর আগে প্রতিটি আসনে একাধিক প্রার্থীর সঙ্গে কথা বলেছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দলের পক্ষ থেকে যাঁকেই মনোনয়ন দেওয়া হোক না কেন, তাঁর পক্ষে ঐক্যবদ্ধ থাকতে নির্দেশনা দিয়েছিলেন তিনি। সে সময় সবাই সেটি মেনে নিলেও বর্তমানে মাঠ পর্যায়ে ভিন্ন চিত্র চোখে পড়ছে। কিছু আসনে দলের মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন না অনেক নেতাকর্মী। তাঁরা প্রার্থী পরিবর্তন চাইছেন।
মনোনয়নবঞ্চিত নেতারা বলছেন, কিছু আসনে মনোনয়নপ্রাপ্তদের সঙ্গে এলাকার ভোটার বা জনগণের খুব বেশি সম্পৃক্ততা নেই। উপজেলা, ইউনিয়ন বা ওয়ার্ড পর্যায়ের বেশির ভাগ নেতাকর্মী মনোনয়ন পাওয়া নেতার সঙ্গে নেই। এমনকি কোনো কোনো মনোনয়ন প্রার্থী অনেক দিন পর এলাকায় আসায় তাঁদের জনপ্রিয়তাও কম। এ অবস্থায় তাঁরা চূড়ান্ত মনোনয়ন পেলে আসনটি হারাতে পারে বিএনপি। এ জন্যই জনপ্রিয় নেতাদের কর্মী-সমর্থকরা পুনর্বিবেচনা দাবি করছেন। আর দলের নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে কোথাও কোথাও বিক্ষোভসহ নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘যেসব আসনে অসন্তোষ রয়েছে তা মেটানোর জন্য দল থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে। তাদের সঙ্গে আলোচনা করা হচ্ছে। আশা করছি সবাই ব্যাপারটি বুঝবেন। সবাই ঐক্যবদ্ধ থেকেই দলের মনোনীত প্রার্থীকে বিজয়ী করতে হবে।’
গত সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সেখানে গণভোট, জোটের প্রার্থীসহ কিছু আসনে নিজ দলের নেতাকর্মীদের টানাপড়েন নিয়েও আলোচনা হয়। স্থায়ী কমিটির সদস্যরা বলছেন, মনোনয়নের ক্ষেত্রে কাউকে না-কাউকে বঞ্চিত হতেই হবে। এখন কিছু নেতার মধ্যে অসন্তোষ থাকলেও নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে তা ঠিক হয়ে যাবে। এ ছাড়া যেসব আসনে টানাপড়েন রয়েছে, সেখানকার নেতাদের ডেকে আলাপ-আলোচনা করা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় নেতারা ঢাকার বাইরে কিছু জেলায় গিয়েও সব প্রার্থী ও নেতার সঙ্গে আলোচনা করছেন। আর দল যদি ক্ষমতায় যায়, তাহলে যেসব নেতা বঞ্চিত হয়েছেন, তাঁদের নিশ্চয়ই কোনো না কোনোভাবে কাজে লাগানো হবে। তবে সার্বিক অবস্থা বিবেচনা ও নানা কারণে অল্প কিছু আসনে প্রার্থিতা পরিবর্তনের সম্ভাবনাও রয়েছে। যদিও সে সংখ্যা খুব বেশি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদ বলেন, ‘বিএনপি বড় রাজনৈতিক দল। ফলে প্রতিটি আসনেই একাধিক প্রার্থী থাকবে—এটাই স্বাভাবিক। তবে দল যাকে মনোনয়ন দেবে তার প্রতি সবার সমর্থন থাকতে হবে। কিছু আসনে যেটা হচ্ছে তা আস্তে আস্তে হয়তো থেমে যাবে। দলের পক্ষ থেকে সবার সঙ্গে কথা হচ্ছে। আমাদের মূল কথা, ব্যক্তি নয়, দলকে জেতাতে হবে। এ জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।’
গত ৩ নভেম্বর বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণার দিন চট্টগ্রামের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীর অনুসারীরা সড়ক ও রেলপথ অবরোধ এবং বিক্ষোভ করে মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবি জানান। এরপর দেশের বিভিন্ন জায়গায় দলের মনোনয়নপ্রাপ্তদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে দলের কর্মী-সমর্থকরা বিক্ষোভ করে এসব মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবি করতে শুরু করেন। যদিও এখন পর্যন্ত শুধু মাদারীপুর-১ আসনে কামাল জামান মোল্লার প্রার্থিতা স্থগিত করেছে বিএনপি।
ঢাকা-১৪ আসনে বিএনপির সম্ভাব্য মনোনয়ন প্রার্থী সানজিদা ইসলাম তুলির বিপক্ষে মশাল মিছিল করেছেন এস এ সিদ্দিক সাজুর সমর্থকরা। প্রথমে তুলির মনোনয়ন বাতিলের দাবি তোলা হলেও পরে তাঁকে ‘বয়কটের’ ঘোষণা দেয় মিছিলকারীরা।
ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর) আসনে দলটির দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষে একজন নিহত হওয়ার পর স্থানীয় কয়েকজন নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করেছে কেন্দ্রীয় বিএনপি। মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলায় বিএনপির দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের জেরে একজনকে গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। মুন্সীগঞ্জের একটি আসনে মনোনয়ন ঘোষণার পর দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে কয়েকজন আহত হয়েছেন।
ময়মনসিংহ-৯ আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে ইয়াসের খান চৌধুরীকে। সেখানে তাঁর মনোনয়ন বাতিল করে পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করেছেন বঞ্চিত ও বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে ত্যাগী চারজন প্রার্থী। তাঁদের মধ্য থেকে যাঁকেই মনোনয়ন দেওয়া হবে, তাঁর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন তাঁরা।
ময়মনসিংহ-৯ আসনের সম্ভাব্য মনোনয়ন প্রার্থী মো. মামুন বিন আবদুল মান্নান বলেন, ‘বর্তমানে যিনি দলের মনোনয়ন পেয়েছেন, বিগত দিনে তাঁর দেখা-সাক্ষাৎ পায়নি এলাকাবাসী। আমি দুর্দিনে এলাকার মানুষের পাশে থেকেছি। বিপদে-আপদে-সমস্যায় পাশে দাঁড়িয়েছি। তাই ভোটাররা চান, দল যেন মনোনয়ন পুনর্বিবেচনা করে।’
ফেনী-২ আসনে সাবেক এমপি জয়নাল আবদীনকে মনোনয়ন দেওয়া হলেও তিনি বয়সের ভারে ন্যুব্জ বলে জানিয়েছেন জেলার নেতারা। ওই আসনের প্রার্থী পরিবর্তনের জন্য ক্রিকেটীয় স্টাইলে ‘রিভিউ’ আবেদন করে আলোচনায় এসেছেন ফেনী জেলা বিএনপির সদস্যসচিব আলাল উদ্দিন আলাল।
সিরাজগঞ্জ-৬ আসনে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন এম এ মুহিত। এই আসনে প্রার্থিতা পরিবর্তন চান এলাকাবাসী। এই আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী গোলাম সারোয়ার বলেন, ‘ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে ভোটটা হবে তা শুধু মার্কার ভোট নয়। ভোট দেওয়ার আগে ভোটাররা মনে করবেন ওই প্রার্থীর কাছে তাঁরা নিরাপদ কি না। কিন্তু আমাকে মনোনয়ন না দেওয়ায় এলাকাবাসী নীরব-নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। মানুষ মনে করে, প্রার্থিতা পুনর্বিবেচনা করা হোক।’
নোয়াখালী-৫ আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম এর আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী থেকে প্রার্থী হয়েছিলেন। সেই আসনটিতে প্রার্থী পরিবর্তন করা হতে পারে—এমন আলোচনা আছে বিএনপির ভেতরে। হবিগঞ্জ-৪ আসনের প্রার্থী এস এম ফয়সাল বার্ধক্যজনিত সমস্যায় ভুগছেন। কুষ্টিয়া ও বরিশালের দুজন প্রার্থীও বয়সজনিত অসুস্থতায় ভুগছেন দাবি করা হচ্ছে দলের ভেতর থেকেই।
দিনাজপুর-২ আসনে সাদিক রিয়াজ চৌধুরীর মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে মশালমিছিল, কাফনের কাপড় পরিধান করে মানববন্ধন, ফাঁসির মঞ্চ তৈরি করে মানববন্ধন, সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে এলাকাবাসী। দিনাজপুর-১ ও দিনাজপুর-৪ আসনেও মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে মিছিল ও মানববন্ধন করা হয়েছে।
বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে কোনো ভূমিকা না থাকায় গাইবান্ধা-৪ (গোবিন্দগঞ্জ) আসনে বিএনপি ঘোষিত প্রার্থী শামীম কায়সার লিংকনের মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীরা মশাল মিছিলসহ ধারাবাহিক আন্দোলন করছেন। শামীম কায়সারকে বাদ দিয়ে অন্য যেকোনো নেতাকে প্রার্থী হিসেবে চান ওই এলাকার নেতা-কর্মীরা।
রংপুর-২ আসনে মোহাম্মদ আলী সরকারের মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় উপজেলা বিএনপির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ ইউনিয়নের নেতারা।
কুড়িগ্রাম-৪ আসনে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী থেকে আপন দুই ভাই মনোনয়ন পাওয়ায় নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী পরিবর্তনের দাবি তুলেছেন দলের একটি অংশ।
ঝিনাইদহ-৩ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন মোহাম্মদ মেহেদী হাসান। ওই আসনে প্রার্থিতা পরিবর্তন চান এলাকাবাসী। ওই আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী আমিরুজ্জামান খান শিমুল বলেন, ‘দল থেকে বলা হয়েছিল, যিনি এলাকার সমস্যা সমাধানে সক্ষম, নিবিড় যোগাযোগ আছে, তাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হবে। কিন্তু আমাদের আসনে এর প্রতিফলন দেখা যায়নি। তাই এলাকাবাসী পুনর্বিবেচনার দাবি তুলেছেন।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ (নবীনগর) আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন মো. আবদুল মান্নান। তাঁর বিপক্ষে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন কর্মসূচির মাধ্যমে প্রার্থিতা পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছেন কাজী নাজমুল হোসেনের অনুসারীরা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনের প্রার্থী এম এ হান্নানের প্রার্থিতা বাতিলের দাবি তুলেছেন স্থানীয় নেতাকর্মীরা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের আমিনুল ইসলামের প্রার্থিতা পরিবর্তন চান স্থানীয় নেতাকর্মীরা। নাটোর-১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া) আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন বিএনপির মরহুম নেতা ফজলুর রহমান পটলের মেয়ে ফারজানা শারমিন (পুতুল)। ওই এলাকায় প্রার্থিতা পরিবর্তনের দাবিতে মিছিল হয়েছে।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম-৪ ও ১৬, সিলেট-৬, সাতক্ষীরা-২ ও ৩, ঠাকুরগাঁও-৩, জয়পুরহাট-১ ও ২, ময়মনসিংহ-৩, ৬ ও ১১, কুমিল্লা-৫, ৬ ও ১০, রাজশাহী-৪ ও ৫, রাজবাড়ী-২, নওগাঁ-১, ৩ ও ৪, পাবনা-৪, গোপালঞ্জ-২, নীলফামারী-৪, মৌলভীবাজার-২ আসনসহ আরো কয়েকটি আসনে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে আন্দোলন চলছে।
চট্টগ্রাম-২ আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী সরওয়ার আলমগীরের মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন কর্নেল (অব.) আজিম উল্লাহ বাহারের অনুসারীরা। খাগড়াছড়ি আঞ্চলিক মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে আগুন জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন তাঁরা।