Logo
Logo
×

রাজনীতি

প্রার্থিতা নিয়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব : উদ্বিগ্ন বিএনপি

Icon

জাগো বাংলা প্রতিবেদন

প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৪:২৩ পিএম

প্রার্থিতা নিয়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব : উদ্বিগ্ন বিএনপি

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ২৩৭ আসনে প্রার্থী ঘোষণার পর থেকেই কিছু আসনে বিএনপির মনোনয়নবঞ্চিতদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ বেড়েছে। অর্ধশতাধিক আসনে প্রার্থী নিয়ে অসন্তোষ চরম পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। নেতা-কর্মীদের মধ্যেও বিভাজন তৈরি হয়েছে। প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে প্রতিদিনই বিক্ষোভ-মিছিল, সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি পালন করছেন নেতা-কর্মীরা। প্রার্থিতা নিয়ে অভ্যন্তরীণ এই দ্বন্দ্ব নতুন করে ভাবনায় ফেলেছে বিএনপির হাইকমান্ডকে। প্রার্থী ঘোষণাকে কেন্দ্র করে অনেক জায়গায় সাড়ে ১৫ বছরে গড়ে ওঠা ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্যও নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। আবার মনোনয়নবঞ্চিতদের মধ্যে কেউ কেউ দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারেন এমন আশঙ্কাও বিএনপির হাইকমান্ডকে ভাবনায় ফেলেছে।

নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, এমন পরিস্থিতিতে প্রার্থী নিয়ে অভ্যন্তরীণ বিরোধ মেটাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যদের পৃথকভাবে দায়িত্ব দিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে মনোনয়নবঞ্চিতদের সঙ্গে কথা বলছেন। এ ছাড়া বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ স্থায়ী কমিটির সদস্যরা বিরোধপূর্ণ প্রতিটি আসনের সব পক্ষকে ঢাকায় ডেকে কথা বলছেন। আলোচনায় মনোনয়নবঞ্চিতদের দলের ঐক্য ধরে রাখা, দলীয় সিদ্ধান্ত মানা এবং দলের নীতিও মেনে চলার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া ভায়োলেন্সপূর্ণ কর্মসূচি থেকে যেমন সড়ক অবরোধ, মশাল মিছিল করা থেকে বিরত থাকাসহ হাইকমান্ডের বিশেষ বার্তা মনোনয়নবঞ্চিতদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন মির্জা ফখরুল। আলোচনায় ভবিষ্যতে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়, এমন কর্মকাণ্ড থেকে নেতা-কর্মীদের বিরত থাকার পাশাপাশি লিখিতভাবে আবেদন জমা দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সব পক্ষের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিছু কিছু আসনে প্রার্থী পুনর্বিবেচনার সম্ভাবনা আছে। নতুন করে প্রার্থীদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে বলেও জানা গেছে। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, ২৩৭ আসনে প্রার্থী ঘোষণার পর ২০-২৫টি আসনে অভ্যন্তরীণ সমস্যা বা সংকট তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে আবার ১০ থেকে ১৫টি আসনে গুরুতর সংকট। এসব আসনের বিরোধ মেটাতে বিশেষভাবে কাজ করা হচ্ছে। এ ছাড়া ওই সব আসনের প্রার্থীদের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি আসনের প্রার্থী পরিবর্তনের কথাও ভাবছেন শীর্ষ নেতারা। এর বাইরে এখনো যেসব আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়নি, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর দল, জোট ও সমমনাদের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে সেসব আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে। শেষ পর্যন্ত প্রার্থী তালিকায় কিছু পরিবর্তন আসতে পারে। 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘মনোনয়ন ঘোষণার পর কিছু আসনে বিভেদ দেখা দিয়েছিল। বড় দলে মনোনয়ন ঘিরে বিরোধ হবে- এটা স্বাভাবিক। আশা করি, এই বিরোধ মিটে যাবে। অনেক জায়গায় মনোনয়নবঞ্চিতদের সঙ্গে আমরা কথা বলে ক্ষোভ মিটিয়ে নিচ্ছি। তবে তফসিল ঘোষণার পর যারা দলীয় সিদ্ধান্ত মানবেন না, তাদের ব্যাপারে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ 

তিনি বলেন, দল আগেই বলেছে এটা চূড়ান্ত তালিকা নয়, সম্ভাব্য তালিকা। কোনো এলাকায় পরিবর্তন দরকার মনে করলে অবশ্যই তা করা হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য বলেন, ‘মনোনয়ন ঘিরে দলীয় বিরোধ মেটানোর জন্য আলোচনা চলছে। তফসিল ঘোষণার পর হয়তো দলের চূড়ান্ত মনোনয়নে কিছু আসনে প্রার্থী পরিবর্তন হতে পারে। এ ছাড়া দলের হেভিওয়েট যেসব প্রার্থী বাদ পড়েছেন তাদের কথা বিবেচনায় রাখা হচ্ছে। স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা করে তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

ঢাকা-৫, ১২ ও ১৫; নারায়ণগঞ্জ-২ ও ৩; সুনামগঞ্জ-১, ৩ ও ৫; চাঁদপুর-২ ও ৪; ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ ও ৫; মাগুরা-২; কুষ্টিয়া-২, ৩ ও ৪; টাঙ্গাইল-১ ও ৩; নেত্রকোনা-৩ ও ৫; সিরাজগঞ্জ-৩; চট্টগ্রাম-২, ৪, ১২, ১৩ ও ১৬; ফেনী-২; গাইবান্ধা-৪; দিনাজপুর-১, ২ ও ৪; নরসিংদী-৪; সাতক্ষীরা-২ ও ৩; নাটোর-১; জামালপুর-২; নীলফামারী-৪; বান্দরবান; শেরপুর-২; হবিগঞ্জ-৪, জয়পুরহাট-১ ও ২; ময়মনসিংহ- ৩, ৬, ৯ ও ১১, মুন্সীগঞ্জ–১; কিশোরগঞ্জ-৫; কুমিল্লা-৫, ৬ ও ১০; কুড়িগ্রাম-১ ও ৩; রাজশাহী-১, ৩ ও ৪; রাজবাড়ী-১; নওগাঁ-১, ৩ ও ৪; পাবনা-৩ ও ৪ এবং মৌলভীবাজার-২- এসব আসনে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে মানববন্ধন, বিক্ষোভ ও মশাল মিছিল করেছেন বিএনপির একাংশের নেতা-কর্মীরা। 

জানা গেছে, এসব আসনের বিক্ষোভ নতুন করে ভাবনা ফেলেছে বিএনপির হাইকমান্ডকে। বিরোধ মেটাতে কাজ করছে হাইকমান্ড। 

জানা গেছে, নির্বাচন ঘনিয়ে আসায় প্রার্থিতা নিয়ে এসব আসনে বিভেদ তীব্র হচ্ছে। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন, তাদের ব্যাপারে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবে হাইকমান্ড। এবার যদি কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হন, তাহলে তাকে বহিষ্কার করা হবে। তাদের আগামী দিনে দলে ফেরার পথ কঠিন হয়ে পড়বে। এ ছাড়া শরিকদের আসনে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে চাইলে তাদের ব্যাপারেও একই বার্তা দেওয়া হবে। তবে শরিকদের সঙ্গে আসন সমঝোতাসহ কিছু আসনে বিরোধ দ্রুত সমাধান না হলে সামনে পরিস্থিতি আরও অস্বস্তিকর হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন দলটির তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে এরই মধ্যে জয়পুরহাট, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিলেট, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহের কয়েকটি আসনের মনোনয়নবঞ্চিতদের ডেকে কথা বলেছেন বিএনপি মহাসচিব। পর্যায়ক্রমে বিরোধপূর্ণ সব আসনের মনোনয়নবঞ্চিতদের নিয়ে বৈঠক করার কথা রয়েছে।

এসব আলোচনায় মনোনয়নপ্রত্যাশীরা দলের দায়িত্বশীল নেতাদের জানিয়েছেন, প্রার্থিতা পুনর্বিবেচনা না করলে বিজয় কঠিন হবে। প্রয়োজনে নিরপেক্ষ কাউকে দিয়ে নতুন করে জরিপ বা প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ করার অনুরোধও করেছেন কেউ কেউ। তবে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে এমন কোনো কর্মকাণ্ড করবেন না বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তারা। 

নাটোর-১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া) আসনে প্রাথমিক মনোনয়ন পেয়েছেন বিএনপির প্রয়াত নেতা ফজলুর রহমান পটলের মেয়ে ফারজানা শারমিন (পুতুল)। তবে প্রার্থী পুনর্বিবেচনার দাবিতে বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম (টিপু) ও প্রার্থী ফারজানা শারমিনের আপন ভাই ইয়াছির আরশাদ (রাজন) এলাকায় সমর্থকদের নিয়ে মিছিল-সমাবেশ করছেন। 

তাইফুল ইসলাম টিপু বলেন, ‘রাস্তাঘাট অবরোধ, মশাল মিছিল না করার জন্য আমাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর পরিবর্তে লিখিত আবেদন জমা দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমার কাজ হচ্ছে মানুষের সঙ্গে থাকা। এটা প্রাথমিক মনোনয়ন। এখনো সময় আছে। নিশ্চয়ই দল যোগ্য ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের মূল্যায়ন করবে।’

বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা মনে করছেন, কিছু আসনে প্রভাবশালীদের পছন্দের প্রার্থী দেওয়াই মাঠের ক্ষোভের একটা বড় কারণ। নব্য, হাইব্রিড, বিগত দিনে আওয়ামী সুবিধাভোগী, আন্দোলন-সংগ্রামে নিষ্ক্রিয় এবং দীর্ঘদিন প্রবাস ছিলেন এমন অনেক নেতা মনোনয়ন পেয়েছেন। পক্ষান্তরে তালিকায় ত্যাগী, যোগ্য ও জনপ্রিয় নেতাদের নাম নেই। এসব কারণে অনেকে বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারেন। তাতে বিএনপির ভোট ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আবার অনেকে জায়গায় মনোনয়নপ্রাপ্ত এখন পর্যন্ত নিজ এলাকার মনোনয়নবঞ্চিতদের সঙ্গে কথা বলেননি। এমনকি সহযোগিতা চেয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার বিষয়ে বঞ্চিতদের কাছে ফোনে কল পর্যন্ত দেননি প্রার্থীরা। ফলে বিভাজন-বিভেদ আরও তীব্র হয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। 

বিএনপির একাধিক সূত্র জানায়, আসনভিত্তিক কোন্দলের মূল কারণ প্রার্থীদের দুর্বলতা, মনোনয়নবঞ্চিত নেতার অবস্থান পুনর্মূল্যায়নে কাজ করছে দলের একটি টিম। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রার্থী তালিকা পুনর্মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা বলছেন, প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে দলের ভেতরে ক্ষোভ থাকলেও ঐক্য রক্ষায় গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিক্ষোভ ঠেকাতে বঞ্চিতদের পর্যায়ক্রমে ডেকে বোঝানো হচ্ছে। তারা আশা করছেন, দ্রুতই এই সমস্যার সমাধান হবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: মহিউদ্দিন সরকার