বিএনপি জামায়াতকে ঘিরে জোটের বলয়, কারা কার সঙ্গে যাচ্ছে?
জাগো বাংলা প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২৫, ০২:৪৫ পিএম
ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার আগেই নির্বাচনি জোটের রাজনৈতিক মেরুকরণ স্পষ্ট হচ্ছে। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর বাইরে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), আমার বাংলাদেশ পার্টিসহ (এবি পার্টি) সাতটি দল নতুন জোট গঠন করতে যাচ্ছে। মোটা অঙ্কে বলা যায়, বর্তমান সময়ের বড় দুটি দল বিএনপি-জামায়াতকে ঘিরেই জোটের বলয় তৈরি হচ্ছে। জোটকে ঘিরে চলছে আসন ভাগাভাগিও। তবে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে কোন দল কার সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করছে। সবকিছু মিলিয়ে তফশিলের আগেই নতুন জোট দৃশ্যমান হচ্ছে।
এককথায়-ভোট যতই ঘনিয়ে আসছে, পৃথক পৃথক নির্বাচনি জোট গঠনের তৎপরতা ধীরে ধীরে ততই দৃশ্যমান হচ্ছে।
অন্যদিকে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আলোচনা ছিল, জামায়াতে ইসলামীকে আসন ছাড় দিতে পারে সবচেয়ে বড় দল বিএনপি। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী পরিস্থিতিতে এখন বিএনপির বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে জামায়াত। এমন বাস্তবতায় যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত থাকা মিত্র দল ও জোটের বাইরেও বাম-ডান, মধ্যম ও ইসলামপন্থি অনেক দল নিয়ে ‘বৃহত্তর জোট’ গঠনে তৎপর হয়েছে বিএনপি। জামায়াতও সাতটি ইসলামি দল নিয়ে ‘নির্বাচনি সমঝোতার’ পথে হাঁটছে। এর বাইরেও যুক্তফ্রন্টের আদলে বাম ঘরানার কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে নতুন একটি জোট গঠন হতে পারে শিগগিরই।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এবারের নির্বাচনে জোটই হতে পারে ফল নির্ধারণের বড় উপাদান। কয়েকটি ছোট দলের ভোটই অনেক প্রার্থীর জয়-পরাজয় নির্ধারণ করে দিতে পারে। তাই আসন্ন ভোটে জোটের সমীকরণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারা কার সঙ্গে যাবে, কত আসনে ছাড় পাওয়া যাবে, আর শেষ পর্যন্ত কে কাকে ভরসা করবে-সেই হিসাবনিকাশই এখন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
জানতে চাইলে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির নেতৃত্বে একটি বৃহৎ জোট গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। এ নিয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দল ও জোট ছাড়াও যুগপতের বাইরে হাসিনা সরকারবিরোধী মনোভাবাপন্ন দলগুলোর সঙ্গেও আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে। ফ্যাসিবাদবিরোধী ও গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক যেসব রাজনৈতিক দল নির্বাচনি জোটে আসতে চাইবে, তাদের সবাইকেই এর অন্তর্ভুক্ত করা হবে।’
এদিকে তরুণদের দল এনসিপির সঙ্গে বিএনপির নির্বাচনি জোট বা আসন সমঝোতা আলোচনার মধ্যেই সম্প্রতি এনসিপি ও এবি পার্টির নেতৃত্বে একটি জোট গঠনেরও আলোচনা সামনে এসেছে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে তফশিলের আগেই এই জোটের আত্মপ্রকাশ হবে। আবার পর্দার আড়ালে এনসিপির কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে আসন ছাড়ের বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত রেখেছে বিএনপি। এ নিয়ে বিএনপি ও এনসিপির মধ্যে কয়েকবার বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে বিষয়টি আদৌ নিষ্পত্তি হবে কি না, তা এখন পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না। যদিও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছিল এমন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জোট গঠনকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি। এর বাইরেও গণ-অভ্যুত্থানে সমর্থন দেওয়া বেশকিছু দল জোট গঠন করতে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ে যোগাযোগ রাখছে। যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত থাকা মিত্র দল ও জোটের বাইরেও বাম-ডান, মধ্যম ও ইসলামপন্থি অনেক দল এই জোটে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে ফিরে দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করবেন। তফশিল ঘোষণার পর আনুষ্ঠানিকভাবে জোটের ঘোষণা আসবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে।
সূত্রমতে, ইসলামী আন্দোলনসহ সমমনা সাতটি দল নিয়ে অভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সরকারের ওপর একধরনের চাপ বজায় রেখে নির্বাচনি কৌশল সাজাচ্ছে দলটি। পাশাপাশি ‘এক আসনে এক প্রার্থী’-এই নীতির ওপর ভিত্তি করে দলগুলো আসনভিত্তিক জরিপ চালাচ্ছে। জরিপের ফলের ভিত্তিতে প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে। সম্ভাব্য এই নির্বাচনি সমঝোতায় আরও কয়েকটি দলকে কাছে টানার চেষ্টা চলছে।
জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা কোনো জোট করার সিদ্ধান্ত নিইনি, জোট করবও না। আমরা নির্বাচনি সমঝোতা করব। শুধু ইসলামি দল নয়, দেশপ্রেমিক প্রতিশ্রুতিশীল যারা আছেন, তারা সংযুক্ত হচ্ছেন। আগামী দিনে আরও অনেক দল এই নির্বাচনি সমঝোতায় যুক্ত হবে। আমরা সবাইকে নিয়ে দেশ গড়তে চাই।’
দলটির সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে অনেকেই যোগাযোগ করছেন। অনেকে অফিসে এসছেন, অনেকে ফোনে যোগাযোগ করছেন। বিষয়গুলো আমরা ইতিবাচকভাবে দেখছি। বর্তমানে আট দল থাকলেও এটি সম্প্রসারণ হয়ে দশ বা এর বেশি হতে পারে।’
সংশ্লিষ্ট আরেকটি সূত্র জানায়, এবি পার্টি, এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদ, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, আপ বাংলাদেশসহ আরও দুটি দল নিয়ে নির্বাচনি জোট গঠনের সম্ভাব্যতা নিয়ে পর্দার আড়ালে আলোচনা চলছে। প্রাথমিকভাবে ২৭ নভেম্বর এই জোট ঘোষণার কথা রয়েছে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে দলগুলোর চূড়ান্ত সম্মতির ওপর।
গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা ও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘জোট গঠনের আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে। দেখা যাক সেটি কীভাবে গঠিত হয়। তবে আমরা বিএনপির সঙ্গে শুরু থেকেই আছি।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছয়টি বাম দল নিয়ে গঠিত বাম গণতান্ত্রিক জোট এবং শরীফ নূরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাসদ বৃহত্তর একটি জোট গঠনের চেষ্টা করছে। বাম গণতান্ত্রিক জোটের শরিক দলগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন এবং বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ (মার্কসবাদী)। এছাড়া দলিত ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর একাধিক সংগঠন এবং গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক ঐক্যসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক গণসংগঠন ও পেশাজীবী সংগঠন নতুন এই জোটে শরিক হতে সম্মতি দিয়েছে। এর বাইরে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম, ঐক্য ন্যাপ, জাতীয় গণফ্রন্ট, বামপন্থিদের আরেকটি জোট ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চা’র শরিক দলগুলোর সঙ্গেও জোট গঠন নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। ফ্যাসিবাদবিরোধী বাম মোর্চার শরিক দলের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের সাম্যবাদী আন্দোলন, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ (মাহবুব) ও গণমুক্তি ইউনিয়ন।
এছাড়া এনসিপিসহ কয়েকটি দল ও বাম ঘরানার দলগুলোর আরও দুটি পৃথক জোট হওয়ার সম্ভাবনা দেখছি।’ তিনি বলেন, এবার জোট যাই হোক, যেহেতু নিজের প্রতীক নিয়ে সব দলের নির্বাচন করতে হবে, সেজন্য বড় দলগুলো ভেবেচিন্তেই শরিকদের আসন ছাড় দেবে। এজন্য হয়তো বড় দলগুলোর জোট গঠন এবং শরিকদের আসন ছাড়ের বিষয়ে আরও সময় নিতে চাইবে।