আসনভিত্তিক নির্বাচনি প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি
জাগো বাংলা প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৫:২৭ এএম
বিএনপি ২৩৭টি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা দেওয়ার পর এখন কেন্দ্রীয়ভাবে নির্বাচনি প্রস্তুতি শুরু করেছে। ইতিমধ্যে নির্বাচনি ইশতেহার তৈরির কাজ প্রায় শেষ করেছেন দায়িত্বশীল নেতারা। পাশাপাশি আসনভিত্তিক নির্বাচনি প্রস্তুতি গ্রহণ করতে প্রার্থীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হবে, সেই লক্ষ্যে নিজেদের পরিকল্পনাও ঢেলে সাজাচ্ছে দলটি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ সুসংহত করতে ইতিমধ্যে ৭টি টিম গঠন করা হয়েছে। যদিও নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন প্রক্রিয়া এখনও শুরু করেনি দলটি। তফসিল ঘোষণার পর এ কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত রয়েছে। দলীয় নির্দেশানুযায়ী ঘোষিত বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা পোলিং এজেন্ট নির্ধারণ, প্রশিক্ষণ, এলাকাভিত্তিক নির্বাচনি ইশতেহার তৈরি করছেন।
ইতিমধ্যে নির্বাচনে দায়িত্ব পালনের জন্য ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির নেতৃবৃন্দের আসনভিত্তিক তালিকা করা হয়েছে। দলের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিএনপি নেতাকর্মীরা বলছেন, দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির মনোনয়ন প্রক্রিয়াই সবচেয়ে জটিল কাজ। সেটা অনেকটা গুছিয়ে আনা হয়েছে। এরই মধ্যে ২৩৭টি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীও ঘোষণা করেছেন দলের হাইকমান্ড। এখন অন্যান্য প্রস্তুতিও নেওয়া হচ্ছে। তবে সবকিছুর গতি আসবে তফসিল ঘোষণা এবং দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে আসার পরে। এর আগে টিমওয়ার্ক হিসেবে মাঠ জরিপে বিভিন্ন অসঙ্গতি দূর করার কার্যক্রম নেওয়া হবে। সেখানে আসনভিত্তিক জটিলতা, প্রার্থীর দুর্বলতা, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সক্ষমতা ও দুর্বলতা চিহ্নিত করার কাজ রয়েছে। এটা সম্পন্ন করে সমন্বিতভাবে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করবেন দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম।
শতাধিক আসনে প্রস্তুতিতে ঘাটতি : তবে সবকিছু ছাপিয়ে আসনভিত্তিক দলীয় কোন্দল ভোগাচ্ছে দলটিকে। গত ৩ নভেম্বর ২৩৭ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণার পর থেকে অর্ধশতাধিক আসনে বিদ্রোহ শুরু হয়। সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা আহত-নিহতের ঘটনাও ঘটছে। এতে বেকায়দায় পড়েছে দল ঘোষিত প্রার্থী ও পুরো দল। দলের হাইকমান্ডের কঠোর বার্তার পরও থামানো যাচ্ছে না অভ্যন্তরীণ কোন্দল। ফলে সেসব আসনে নির্বিঘ্নে নির্বাচনি কার্যক্রমও শুরু করা যায়নি তেমন।
অন্যদিকে অঘোষিত ৬৩ আসনে প্রার্থী ঘোষণা না করায় সেসব আসনেও প্রস্তুতিপর্ব শুরু করা যায়নি। এই আসনের মধ্যে বেশিরভাগ সমমনা ও মিত্র দলের জন্য ছাড় দেওয়া হতে পারে। তবে সেটা এখনও না করায় জোটের নেতারাও নির্বাচনের প্রস্তুতি থেকে পিছিয়ে পড়ছেন। সব মিলিয়ে দেশের শতাধিক আসন এখনও অপ্রস্তুত থাকায় আগামী নির্বাচনে এর প্রভাব পড়তে পারে বলে শঙ্কা করছেন দলটির নেতাকর্মীরা।
তারা বলেন, কোন্দলপূর্ণ আসনগুলোতে বিতর্কিতদের সরিয়ে যোগ্য আর ত্যাগীদের মনোনয়ন দেওয়া না হলে সেসব আসনে ফলাফল বিপর্যয় ঘটতে পারে। বিক্ষুব্ধ তৃণমূল ও মনোনয়নবঞ্চিত নেতাদের অভিযোগ শুনতে হবে। তথ্য-প্রমণন সঠিক হলে সেভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে। আর তথ্য-প্রমাণ ঠিক না থাকলে বঞ্চিতদের অন্যভাবে মূল্যায়নের আশ্বাস দিয়ে কোন্দল নিরসন করতে হবে। কিন্তু যদি জোরজবরদস্তি করার মতো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় তা হলে হিতে বিপরীত হতে পারে বলেও মনে করছেন নেতাকর্মীরা।
সাত কমিটি গঠন : বিএনপি মূলধারার মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ সুসংহত করার লক্ষ্যে একটি সমন্বিত কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এই সমন্বিত কার্যক্রমের আহ্বায়ক হিসেবে সার্বিক তত্ত্বাবধায়ন করবেন দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। সাত সদস্যের টিমের সদস্যরা টিমপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। এর মধ্যে প্রেসের টিমপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন সালেহ শিবলী। স্পোকসপারসন হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন মাহদী আমিন।
অন্যান্য টিমপ্রধান হলেন—টিভি-রেডিও : অধ্যাপক মওদুদ হোসেন আলমগীর পাভেল, বিএনপি গ্রাসরুট নেটওয়ার্ক : জিয়াউদ্দিন হায়দার, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক : একেএম ওয়াহিদুজ্জামান, কনটেন্ট জেনারেশন টিম : সাইমুম পারভেজ এবং রিসার্চ ও মনিটরিং টিম : রেহান আসাদ।
আসনভিত্তিক নির্বাচনি প্রস্তুতি : অন্যদিকে যেসব আসনে কোন্দলের মাত্রা কম সেসব আসনে প্রার্থীরা গণসংযোগের পাশাপাশি নির্বাচনের সব আয়োজন সম্পন্ন করছেন। ইতিমধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন আসনে পোলিং এজেন্ট নির্ধারণ, তাদের প্রশিক্ষণ, বিকল্প এজেন্ট প্রস্তুত করার মতো কাজও করছেন তারা। অনেকে নিজ এলাকার সুবিধা-অসুবিধা আর জনগণের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে নির্বাচনি ইশতেহারও তৈরি করছেন। প্রার্থীদের নিয়ে ব্যানার, ফেস্টুনসহ বড় বড় বিলবোর্ড তৈরি করে নির্বাচনি ঢেউ তোলার সব আয়োজন করছেন নেতারা। সেখানে দেশ গঠনে বিএনপির কর্মপরিকল্পনা, রাষ্ট্র মেরামতে ৩১ দফাসহ নানাবিধ প্রতিশ্রুতি সংবলিত এসব ব্যানার, পোস্টার দিয়ে ভোটারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা।
এ ছাড়া উঠান বৈঠক থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশাজীবীদের সঙ্গেও তারা মতবিনিময় সভা করছেন। সেখানে এলাকার উন্নয়নে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কী কী পদক্ষেপ নেবেন সেসব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন প্রার্থীরা। পাশাপাশি জেন-জি ও নারী ভোটারদের কাছে টানতে নিয়েছেন নানা উদ্যোগ।
তরুণদের ভাবনা শীর্ষক আলোচনা সভা, মতবিনিময় সভার পাশাপাশি তাদের খেলাধুলা, সংস্কৃতিতে আকৃষ্ট করতে কাজ করছেন বিএনপির প্রার্থীরা। মাদকের ভয়াবহতা থেকে দূরে রাখতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এখান থেকে বেরিয়ে আসতে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা হচ্ছে। নারীদের জন্য দল ঘোষিত বিভিন্ন প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি কর্মসংস্থান বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার কথাও বলছেন বিএনপি নেতারা। আবার নির্বাচন পরিচালনার জন্য আসনভিত্তিক বিভিন্ন কমিটি, উপকমিটি গঠনের কাজও প্রায় শেষ করেছেন বিএনপির মনোনীত প্রার্থীরা।
ঢাকা-১২ আসনের প্রার্থী সাইফুল আলম নীরব বলেন, ধানের শীষকে জয়ী করতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এই আসনের নেতাকর্মী, সমর্থক ও জনগণ ধানের শীষে ভোট দিতে উদগ্রীব হয়ে আছেন। জয়ী হলে জনসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তিনি।
ঢাকা ১৬ আসনে বিএনপির প্রার্থী আমিনুল হক বলেন, নির্বাচনের সব প্রস্তুতি নিয়ে তারা কাজ করছেন। আওয়ামী লীগ আমলে এলাকার উন্নয়ন হয়নি, তাদের নেতাকর্মীদের পকেটের উন্নতি হয়েছে। এখন তারা উন্নয়নবঞ্চিত জনগণের মতামত নিচ্ছেন। জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসলে তার দেওয়া সব প্রতিশ্রুতি তিনি বাস্তবায়ন করবেন।
প্রতিপক্ষের দিকে নজর : একই সঙ্গে প্রতিপক্ষ প্রার্থীদের কার্যক্রমেও নজর রাখছেন তারা। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর মনোনীত প্রার্থীদের প্রচার কৌশল, ধর্মকে ব্যবহার করার প্রবণতার বিপরীতে নিজস্ব কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে বিএনপির প্রার্থীরা।
এর মধ্যে মসজিদ-মাদরাসা আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে টার্গেট করে যাতে জামায়াতের প্রার্থীরা নির্বাচনি প্রচার করতে না পারে সে বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করছেন বলেও অনেক প্রার্থী জানিয়েছেন। জামায়াতের নারী কর্মীদের প্রচারের দিকেও খেয়াল রাখছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। ধর্মীয় তালিমের নামে যাতে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি না ছড়াতে পারে সেদিকেও নজর রাখা হচ্ছে বলে বিএনপির অনেক প্রার্থী জানিয়েছেন।
ভোলার চরফ্যাশন আসনে বিএনপির প্রার্থী নুরুল ইসলাম নয়ন বলেন, রাজনীতি হবে সামনাসামনি। গুপ্তভাবে কোনো রাজনীতি হয় না। আবার ধর্মকে ব্যবহার করেও প্রকৃত রাজনীতি হয় না। যারা ধর্মকে ব্যবহার করে মসজিদকে ব্যবহার করার চেষ্টা করবে তাদের জনগণই রুখে দেবে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয়তা বাড়ানোর উদ্যোগ : পিছিয়ে পড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব প্রমাণে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয়ভাবে নানাবিধ উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। এর মধ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে দলটির তৃণমূলের শক্তিকে সুসংগঠিত করে অনলাইন প্রচারকে আরও জোরদার করতে এবং ‘বট বাহিনী’র অপপ্রচারের মোকাবিলায় গঠন করা হচ্ছে নতুন প্ল্যাটফর্ম। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার এই প্ল্যাটফর্মের ১৫ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃত্ব দেবেন। তাদের একেকজন ২০ আসনে কো-অর্ডিনেশন করবেন। এই প্ল্যাটফর্মের অধীনে প্রত্যেক নির্বাচনি আসনে দুজন করে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট থাকবেন বলে জানা গেছে।
এই উদ্যোগ শুধু তৃণমূল স্তরে দলের সাংগঠনিক শক্তিকেই মজবুত করবে না, একই সঙ্গে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেও কথিত ‘বট বাহিনী’কে কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করার কৌশল নিয়েছে দলটি। বিএনপির এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য হচ্ছে—নির্বাচনি প্রচারের আগে থেকেই দলের বার্তা দেশের প্রতিটি প্রান্তে এবং অনলাইনে সক্রিয়ভাবে পৌঁছে দেওয়া। মাঠপর্যায়ে কার্যক্রম বিস্তার করতে দেশের প্রতিটি সংসদীয় আসনে ২ জন করে ‘অ্যাক্টিভিস্ট’ নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে। এই অ্যাক্টিভিস্টরাই হবেন তৃণমূল পর্যায়ে বিজিএনর মূল চালিকাশক্তি। অ্যাক্টিভিস্টদের সম্মানী দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এর মূল লক্ষ্য ‘বট বাহিনীকে প্রতিরোধ করা’। এতে একদিকে যেমন অনলাইন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব হবে তেমনি শিক্ষিত গ্র্যাজুয়েটদের যুক্ত করে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিজেদের অবস্থানকে আরও মজবুত করতে পারবে এবং অনলাইন অপপ্রচারের বিরুদ্ধে লড়তে পারবে।
একইভাবে স্থানীয়ভাবেও এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রার্থীর নিজস্ব যোগাযোগমাধ্যমে সরব উপস্থিতি ছাড়াও নেতাকর্মীদের সক্রিয় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে এর সুফল আসতে শুরু করেছে বলে অনেকে জানিয়েছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বিএনপি সবসময় একটি নির্বাচনমুখী দল এবং যেকোনো সময় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত থাকেন। বিগত ১৬ বছর এ দেশের জনগণ ভোট দিতে পারেনি। নতুন প্রজন্ম তাদের অধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। ফ্যাসিবাদমুক্ত পরিবেশে উৎসবমুখর ভোট আয়োজনে বিএনপি সব প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। এর মধ্যে ২৩৭ আসনে প্রাথমিক মনোনয়ন ঘোষণা করেছে। ধাপে ধাপে অন্যান্য প্রক্রিয়াও সামনে আনা হবে বলে জানান তিনি।