যেসব আসনে প্রার্থী বদল হতে পারে বিএনপির
জাগো বাংলা প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৫, ০৩:১০ পিএম
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে মনোনয়ন নিয়ে বিভেদ তীব্র হচ্ছে। এ নিয়ে বিব্রত দলটির নীতিনির্ধারকরাও। বিদ্রোহীদের গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে ডেকে বিরোধ মেটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে আসনগুলোয় বিরোধ দ্রুত সমাধান না হলে পরিস্থিতি আরও অস্বস্তিকর হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
তবে প্রাথমিক মনোনয়ন নিয়ে কিছু আসনে দলটির তৃণমূলে বিভেদ এখনো কাটেনি। প্রাথমিক মনোনয়ন পাওয়া নেতারা এলাকায় প্রচারে অর্থ খরচ করছেন। আবার মনোনয়নবঞ্চিতরাও খরচ করছেন মনোনয়ন পাওয়ার আশায়। এই আশাবাদী নেতাদের সমর্থকরা প্রার্থিতা বদলের দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি পালন করছেন। কয়েকটি আসনে ঘোষিত সম্ভাব্য একক প্রার্থীর সমর্থকরাও পালটা কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকছেন। সব মিলিয়ে এতে দলটির ক্ষতি হচ্ছে। পক্ষান্তরে লাভবান হচ্ছে নির্বাচনে বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যরা।
বিএনপির একাধিক সূত্র জানায়, আসনভিত্তিক কোন্দলের সঠিক কারণ, প্রার্থীদের দুর্বলতা, মনোনয়নবঞ্চিত নেতার অবস্থান পুনর্মূল্যায়নে কাজ করছে দলের একটি টিম। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রার্থী তালিকা পুনর্মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বলছেন, প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে দলের ভেতরে ক্ষোভ থাকলেও ঐক্য রক্ষায় গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিক্ষোভ ঠেকাতে বঞ্চিতদের পর্যায়ক্রমে ডেকে বোঝানো হচ্ছে। তারা আশা করছেন, দ্রুতই এই সমস্যার সমাধান হবে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, দল আগেই বলেছে, এটা চূড়ান্ত তালিকা নয়, সম্ভাব্য তালিকা। কোনো এলাকায় পরিবর্তন দরকার মনে করলে, অবশ্যই তা করা হবে। সবকিছু বিশ্লেষণ করেই তালিকা করা হয়।
তিনি বলেন, মনোনয়ন ঘোষণার পর কিছু জায়গায় ক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। কারণ, অনেক জায়গায়ই মনোনয়ন পাওয়ার যোগ্য দু-তিনজন করে নেতা আছেন। আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলে ক্ষোভ মিটিয়ে নিচ্ছি।
বিরোধ মিটছে না, প্রার্থী বদলের দাবি
জানা যায়, যেসব আসনে এখনো বিরোধ মেটেনি, সেসব আসনের বেশকিছু ঘোষিত প্রার্থীর অবস্থান স্থানীয় পর্যায়ে অনেক দুর্বল। অপরদিকে মনোনয়নবঞ্চিতরা স্থানীয়ভাবে কিছুটা শক্ত অবস্থানে। অনেকের জনপ্রিয়তাও রয়েছে। গুলশান কার্যালয়ে তাদের ডেকে বিরোধ সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।
সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণার পর থেকেই চাঁদপুর-২ আসনে মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে বিক্ষোভ ও সমাবেশ চলছে। এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে চাঁদপুর জেলা বিএনপির যুগ্মসাধারণ সম্পাদক তানভীর হুদার সমর্থকরা নানা কর্মসূচি পালন করছেন।
কুষ্টিয়া-১ আসনের মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে শরিফ উদ্দিন জুয়েলের সমর্থকরাও মানববন্ধন, গণমিছিল ও সমাবেশ করেছেন। কুষ্টিয়া-৪ আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমিকে। এ আসনে জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক শেখ সাদী মনোনয়ন চাইছেন। শেখ সাদী স্থানীয়ভাবে নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় নেতা হিসাবে পরিচিত। এখানে মনোনয়নে পরিবর্তন না হলে অঘটন ঘটতে পারে বলে মনে করছেন খোকসা উপজেলা বিএনপির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দিন খান।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (কসবা-আখাউড়া) আসনে সাবেক সংসদ-সদস্য মুশফিকুর রহমানকে সম্ভাব্য প্রার্থী করা হয়েছে। এই আসনে অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী কবির আহমদ ভুঁইয়ার পক্ষে দুই উপজেলার নেতাকর্মীরা প্রতিদিনই কর্মসূচি পালন করছেন।
নরসিংদী-৪ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী পরিবর্তন চায় স্থানীয় নেতাকর্মীদের একাংশ। এ আসনে তারা ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদির ভুঁইয়া জুয়েলকে প্রার্থী হিসাবে দেখতে চাইছেন। তার অনুসারীরা বলছেন, ১৭ বছর মামলা-হামলায় জর্জরিত ছিলেন তারা।
নাটোর-১ আসনে বিএনপির কেন্দ্রীয় সহদপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু বিগত বছরগুলোয় আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা, দলের সাংগঠনিক তৎপরতা কিংবা নেতাকর্মীদের সংগঠিত করতে কাজ করেছেন। প্রার্থিতা বদল করে তাইফুল ইসলাম টিপুকে মনোনয়ন দেওয়ার জন্য সেখানে সমাবেশসহ বিক্ষোভ হয়েছে।
বিক্ষোভ, সমাবেশ ও মশাল মিছিল হয়েছে নারায়ণগঞ্জ-২ আসনেও। সেখানে মনোনয়নবঞ্চিত সব প্রার্থী একট্টা হয়েছেন। তারা কেন্দ্রীয় নেতা মাহমুদুর রহমান সুমনকে প্রার্থী হিসাবে চান।
গাইবান্ধা-২ আসনেও প্রার্থী বদল করে সাবেক সচিব আমিনুল ইসলামকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবি জানিয়েছে স্থানীয় নেতাকর্মীদের বড় একটি অংশ। চট্টগ্রাম-১২ আসনে এনামুল হককে মনোনয়ন দেওয়ার পর থেকে সেখানে চলছে বিক্ষোভ।
চট্টগ্রাম-১৩ আসনে সরওয়ার জামাল নিজাম প্রাথমিক মনোনয়ন পেয়েছেন। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-আহ্বায়ক আলী আব্বাস জানান, দলের দুঃসময়ে আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলেন-এমন কাউকে প্রার্থী দেওয়ার জন্য হাইকমান্ডের কাছে আবেদন করা হয়েছে।
এছাড়া চট্টগ্রাম-৪ ও ১৬, সিলেট-৬, রংপুর-৩, সাতক্ষীরা-২ ও ৩, গাইবান্ধা-৪, ঠাকুরগাঁও-৩, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২, কুড়িগ্রাম-২, নোয়াখালী-৫, নীলফামারী-৪, দিনাজপুর-২, হবিগঞ্জ-৪, জয়পুরহাট-১ ও ২, ময়মনসিংহ-৩, ৬, ৯ ও ১১, মুন্সীগঞ্জ-২, কুমিল্লা-৫, ৬ ও ১০, রাজশাহী-৪ ও ৫, রাজবাড়ী-২, নওগাঁ-১, ৩ ও ৪, পাবনা-৪, মৌলভীবাজার-২ আসনসহ আরও কয়েকটিতে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে আন্দোলন চলছে।
এদিকে ঘোষিত সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্রতি স্পষ্ট নির্দেশনা ছিল মনোনয়নবঞ্চিতের সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে গণসংযোগ চালানোর।
কিন্তু মাঠপর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাইকমান্ডের নির্দেশনা মানছেন না কিছু প্রার্থী। ক্ষোভ প্রকাশ করে মনোনয়নবঞ্চিত একাধিক নেতা জানান, মনোনয়ন পাওয়ার পর কিছু আসনের প্রার্থী মনে করছেন তাদের জয় নিশ্চিত। এজন্য ওইসব প্রার্থীর আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। তারা নিজেদের অনুসারী নেতাকর্মীদের নিয়ে গণসংযোগ চালাচ্ছেন। মনোনয়নবঞ্চিত নেতার অনুসারীদের ওপর হামলা ও হয়রানির ঘটনাও ঘটছে দু-এক জায়গায়।
একই অভিযোগ বরিশাল-২ আসনের মনোনয়নবঞ্চিতদেরও। এ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন সাবেক ছাত্রনেতা দুলাল হোসেন ও সাইফ মাহমুদ জুয়েল। কিন্তু তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেননি প্রাথমিক মনোনয়ন পাওয়া সরফুদ্দিন আহমেদ (সান্টু)। উলটো জুয়েলের পোস্টার ও সাইনবোর্ড ছিঁড়ে ফেলার অভিযোগ উঠেছে।
তবে উল্টো চিত্রও দেখা গেছে। ঘোষিত অনেক আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী আবার দলের হাইকমান্ডের নির্দেশনা মেনে নির্বাচনি কাজ করছেন। যেমন—গাজীপুর-২ আসনের এম মঞ্জুরুল করিম রনিকে প্রার্থী ঘোষণার পরপরই তিনি মনোনয়নবঞ্চিতদের বাসায় গিয়ে দেখা করেছেন। ধানের শীষের প্রচারণাসহ দলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নেমেছেন রনি।
স্থানীয় একাধিক নেতা জানান, সরোয়ার মনোনয়ন পাওয়ার পর বঞ্চিত নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, দেখা করেছেন। অতীতের সব বিভেদ মিটিয়ে সবাইকে তিনি ঐক্যবদ্ধ করেছেন।
ঘোষিত আসনগুলোতে প্রার্থী বদলের একক এখতিয়ার বিএনপির হাইকমান্ড ও মনোনয়ন বোর্ডের। এগুলোতে প্রার্থী বদলের বিষয়ে বিএনপি কী সিদ্ধান্ত নেয় সেটি জানতে অপেক্ষা করতে হবে দলের নেতাকর্মীদের।