ছাত্র উপদেষ্টারা চান বিএনপির সঙ্গে যেতে, দোটানায় এনসিপি
অন্তত ২০টি আসন, সাংগঠনিক সহায়তা এবং বিদ্রোহী প্রার্থী না থাকার নিশ্চয়তা চায় এনসিপি
জাগো বাংলা প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২৫, ০১:০০ পিএম
ছাত্র উপদেষ্টারা চান এনসিপি আগামী নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির সঙ্গে জোট করুক। তবে এনসিপির শীর্ষ নেতৃত্বসহ অধিকাংশ নেতা এর জন্য অন্তত ২০টি আসন, নির্বাচনের মাঠে সাংগঠনিক সহায়তা এবং দলের বিদ্রোহী প্রার্থী না থাকার নিশ্চয়তা চান। এই নিশ্চয়তা না পেলে তারা বিএনপির সঙ্গে জোট করতে রাজি নন। বিকল্প হিসেবে তারা জামায়াতের সঙ্গে বিএনপিবিরোধী বৃহত্তর নির্বাচনী সমঝোতায় যেতে চান। ফলে দোটানায় পড়েছে জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতাদের গঠিত এনসিপি।
গত ১৩ নভেম্বর মন্ত্রিপাড়ায় একজন ছাত্র উপদেষ্টার সরকারি বাসভবনে এনসিপির ৩০ জনের বেশি নেতার বৈঠক হয়। পরের দিন দলীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সাধারণ সভা হয়।
সভায় অংশ নেয়া কয়েকজন নেতা জানান, দুই উপদেষ্টা ছাড়াও এনসিপির শীর্ষ ১০ নেতার অন্তত দুজন বিএনপির সঙ্গে জোট চান। তাদের একজন ঢাকায়, আরেকজন উত্তরবঙ্গে বিএনপি জোটের প্রার্থী হতে চান। দুই ছাত্র উপদেষ্টার একজন জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতায় আগ্রহী নন। অন্য উপদেষ্টার অভিমত, আগামী নির্বাচনের পর রাজনৈতিক সরকারের সময়ে নিরাপত্তার কারণে বিএনপির সঙ্গে থাকা উচিত।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রনেতৃত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্তর্বর্তী সরকারের একাধিক উপদেষ্টাও চান বিএনপির সঙ্গে জোট করুক এনসিপি। তবে দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও সদস্য সচিব আখতার হোসেন এনসিপির চাহিদা পূরণ ছাড়া বিএনপির সঙ্গে জোটে যেতে রাজি নন।
উপদেষ্টার বাসায় বৈঠকের সত্যতা স্বীকার না করলেও গত সাধারণ সভার কথা নিশ্চিত করেছেন এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব। জোটের বিষয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আলোচনা হয়েছে, জুলাই সনদে এবং সংস্কার বাস্তবায়নে যে দলগুলোর সঙ্গে এনসিপির অবস্থান কাছাকাছি, তাদের সঙ্গে নির্বাচনী জোট বা সমঝোতা হতে পারে।
সংস্কার ও গণভোট নিয়ে কাছাকাছি অবস্থানের কারণে এনসিপি কি জামায়াতের সঙ্গে যেতে চায়– এ প্রশ্নের জবাবে আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, বিএনপি নির্বাচন এবং গণভোট এক দিনে চেয়েছিল, তা-ই হচ্ছে। এতে এনসিপির আপত্তি নেই। সংস্কারের জন্য এনসিপিসহ ৯ দল সমঝোতার উদ্যোগ নিয়েছিল। নিজস্ব একটি জোট তৈরির প্রাথমিক আলোচনাও আছে। আবার দলের অধিকাংশ নেতা মত দিয়েছেন, এনসিপি ৩০০ আসনে এককভাবে নির্বাচন করুক। তাই কারও সঙ্গে জোট হবেই– এমনটা এখনই বলা যাচ্ছে না।
বিএনপির সঙ্গে জোটে জোর
এনসিপি সূত্র জানিয়েছে, দলের ৫৫ সদস্যের রাজনৈতিক কাউন্সিলের ৩০-৩২ জন উপদেষ্টার বাসভবনের ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। দুই উপদেষ্টা ছাড়াও নাহিদ, আখতার, মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীসহ এনসিপির জ্যেষ্ঠ নেতারা জোট নিয়ে মতামত দেন বৈঠকে।
বৈঠক সূত্র জানায়, তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বিএনপির সঙ্গে জোটের পরামর্শ দেন। বিএনপির সঙ্গে জোট গঠনে সবচেয়ে জোরালো অবস্থান নেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তিনি বলেন, এনসিপিকে আগামী সংসদে থাকতে হলে বিএনপির জোটে যেতে হবে।
একজন উপদেষ্টা মনে করেন, তাঁর বিরুদ্ধে যেসব ‘অপপ্রচার’ রয়েছে, এর কারণে আগামী দিনে বিরোধী দলের রাজনীতি করলে বিপদে পড়তে হবে। বিএনপি ক্ষমতায় যাচ্ছে ধরে নিয়ে উপদেষ্টা এই দলটির সঙ্গে এনসিপির জোট চান। তিনি ঢাকা থেকে নির্বাচন করতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এনসিপি জোটে না গেলে এই উপদেষ্টা বিএনপিতে যোগ দিয়ে দলটির প্রার্থী হতে পারেন বলেও সূত্র আভাস দিয়েছে।
এনসিপির সূত্র জানিয়েছে, নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বিএনপির কড়া সমালোচনার পর এই উপদেষ্টার সমর্থক ছাত্রনেতারা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বিদ্রুপ মন্তব্য করেছেন। তাদের ভাষ্য, এনসিপি নেতারা দিনে সমালোচনা করলেও রাতে বিএনপি নেতাদের বাসায় আসন সমঝোতার আলোচনা করেন।
বিএনপির সঙ্গে আসন সমঝোতায় জ্যেষ্ঠ নেতারা
দুটি বৈঠকে উপস্থিত কয়েকজন বলেছেন, তারা জানতে পেরেছেন এনসিপিকে সর্বোচ্চ আটটি আসন ছাড়তে রাজি হয়েছে বিএনপি। এতে দুই উপদেষ্টা এবং জাতীয়ভাবে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠা ছয় নেতার আসন নিশ্চিত হলেও এনসিপির বাকি নেতারা বঞ্চিত হবেন। ফলে তারা বিএনপির সঙ্গে জোটে আগ্রহ পাচ্ছেন না। এই ছয় নেতার মধ্যে নাহিদ-আখতারের নাম থাকলেও দলের অধিকাংশ নেতার মনোভাবের কারণে তারাও আপাতত রাজি নন।
রাজনৈতিক সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে, গত এক মাসে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এনসিপির একাধিক নেতা। এনসিপি নেতারা দুই ভাগে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। আসন বণ্টনের প্রস্তাব নিয়ে মির্জা ফখরুল এবং স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমীর খসরু মাহমুদের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন তারা। এনসিপি নেতারা অনানুষ্ঠানিক আলাপে এসব বৈঠকের সত্যতা স্বীকার করলেও কেউ আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিতে রাজি হননি। একজন নেতা বলেছেন, মাছ খাওয়ার দাওয়াতে তারা তিনজন সালাহউদ্দিন আহমেদের বাসায় গিয়েছিলেন।
সাধারণ সভায় বিএনপিবিরোধী হাওয়া
১৪ নভেম্বরের এনসিপির সাধারণ সভায় দলের কেন্দ্রীয় কমিটির ৭০-৭২ জন নেতা অংশ নেন। নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, দুই মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদু্ল্লাহ এবং সারজিস আলম সভায় ছিলেন না।
বৈঠক সূত্র জানায়, নিচের এবং মধ্যমসারির নেতারা বলেছেন, মাত্র ৮টি আসনের জন্য বিএনপির সঙ্গে জোট করা ঠিক হবে না। আসন কম হলে অনেক নেতা বঞ্চিত হবেন। নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে এমপি-মন্ত্রী বানানোর জন্য সাধারণ নেতাকর্মীরা রাজনীতি করছেন না। অন্তত ২০টি আসন না ছাড়লে তারা বিএনপির সঙ্গে জোট করার পক্ষে নন।
বিএনপির সঙ্গে জোট করার বিভিন্ন অসুবিধা তুলে ধরে একাধিক নেতা বলেন, নতুন দল হিসেবে এনসিপি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল। দুই-তিনটি আসন ছাড়া কোথাও ভোটকেন্দ্র ব্যবস্থাপনা এবং পোলিং এজেন্ট দেওয়ার মতো অবস্থায় যাওয়াও তাদের জন্য কঠিন। জোট করলেও এনসিপিবিরোধী মনোভাবের কারণে বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীদের কাছ থেকে সহযোগিতা পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। মনোনয়নবঞ্চিত বিএনপি নেতাদের এনসিপিকে ছেড়ে দেওয়া আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে বিএনপির সঙ্গে জোট গঠন উপদেষ্টা এবং কয়েকজন নেতার জন্য লাভজনক হলেও এনসিপির সবার জন্য নয়।
সাধারণ সভায় নেতারা মতামত দেন, এর চেয়ে এনসিপির সারাদেশে এককভাবে ৩০০ আসনে নির্বাচন করা উচিত। তাতে ভরাডুবি হলেও নিজস্ব ভোটব্যাংক এবং স্বতন্ত্র রাজনীতি তৈরি হবে; যা আগামী দিনের রাজনীতির জন্য সহায়ক হবে। অল্প কয়েকজন নেতা নির্বাচন করলে বাকিরা রাজনীতির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। এমনকি দলে ভাঙনও ডেকে আনতে পারে।
এই নেতারা মনে করেন, উপদেষ্টারা যদি বিএনপিতে যোগ দেন, তাতেও এনসিপির ক্ষতি হবে না। বরং সরকারের ব্যর্থতা এবং তাদের কাউকে নিয়ে যেসব গুঞ্জন রয়েছে, সেগুলোর দায় এনসিপিকে নিতে হবে না।
এই বক্তব্যের পর নাহিদ ইসলাম এবং আখতার হোসেন সভায় আশ্বস্ত করেন, বিএনপির সঙ্গে জোট করার সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। প্রয়োজনে এককভাবে নির্বাচন করবে এনসিপি।
জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতায় আগ্রহ
দুই বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক নেতা বলেছেন, বিএনপির সঙ্গে জোট করলে এনসিপিও সংস্কারের প্রতি নমনীয় বলে তকমা পাবে, যা এনসিপির রাজনৈতিক বয়ানকে দুর্বল করবে। অধিক সংখ্যক আসনে ছাড় পাওয়া এবং সংস্কার-গণভোট নিয়ে কাছাকাছি অবস্থানের কারণে জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা লাভজনক বলে মনে করেন এই ধারার নেতারা।
তবে বৈঠকগুলোতে অংশ নেওয়া এনসিপি নেতাদের একটি অংশের ধারণা, নাহিদ ও আখতার জামায়াতের সঙ্গে সরাসরি জোট করবেন না। নির্বাচনী সমঝোতা করবেন। এনসিপি সামর্থ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চ সংখ্যক আসনে প্রার্থী দেবে। যেসব আসনে এনসিপির লড়াইয়ের সামর্থ্য রয়েছে, এমন ৪০-৫০টি আসনে সমঝোতার অংশ হিসেবে জামায়াত প্রার্থী সরিয়ে নেবে বা নিষ্ক্রিয় করবে। অন্যান্য আসনে এনসিপিও জামায়াতকে একই রকম সহায়তা দেবে।
জামায়াত, চরমোনাইর পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনসহ আটটি দল সংস্কার এবং গণভোট ইস্যুতে এক হয়েছে। এ দলগুলোও নির্বাচনী জোট নয়, সমঝোতার করার কথা বলছে। এসব দলের কয়েকটির সঙ্গেও এনসিপি আলোচনা করেছে।
এনসিপি নেতারা জানান, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ এবং বামপন্থি জোট গণতন্ত্র মঞ্চের ছয় শরিককে নিয়ে একটি নির্বাচনী সমঝোতা করার চেষ্টা চলমান আছে। কিন্তু প্রত্যাশিত সংখ্যক আসনে ছাড় পেলে গণঅধিকার পরিষদ ও গণতন্ত্র মঞ্চ বিএনপির জোটেই থাকবে। তাই এ দলগুলোর সঙ্গে এনসিপির জোটের সম্ভাবনা ক্ষীণ। এ ক্ষেত্রে জামায়াতসহ আট দলের সঙ্গে এনসিপি ও এবি পার্টি নির্বাচনী সমঝোতা করবে।