যেসব আসনে বিশেষ দৃষ্টি বিএনপির, মনোনয়নবঞ্চিতরা পেতে পারেন সুখবর
জাগো বাংলা প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০২৫, ০৬:৫১ পিএম
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ২৩৬ আসনে প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করেছে বিএনপি। প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পরে বিভিন্ন আসনে দেখা দেয় বিরোধ। সম্প্রতি ওই সব আসনে প্রার্থীদের মধ্যে বিরোধ নিরসনের উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। এরই অংশ হিসাবে বিরোধপূর্ণ আসনের মনোনয়নবঞ্চিতদের ঢাকায় ডেকে এনে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি।
মঙ্গলবার দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বেশ কয়েকটি আসনের মনোনয়নবঞ্চিত নেতাদের সঙ্গে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে কথাও বলেছেন। কারও কারও সঙ্গে ফোনেও কথা বলছেন বিএনপি হাইকমান্ড। দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়-এমন কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি ধানের শীষের পক্ষে মাঠে থাকাসহ তাদের নানা দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মনোনয়নবঞ্চিতরাও তাদের আসনে নিরপেক্ষভাবে জনপ্রিয়তা যাচাই করে প্রার্থী পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানিয়ে দলের প্রতি আনুগত্য থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
অন্যদিকে কয়েকটি আসনে বয়স্ক প্রার্থী নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে স্থানীয় রাজনীতিতে তুমুল সমালোচনা চলছে। একদিকে এসব প্রার্থী বয়সের ভারে ঠিকমতো প্রচারণা চালাতে পারছেন না। অন্যদিকে তরুণ প্রজন্মের কাছেও তারা অপরিচিত। আবার বিগত আন্দোলন-সংগ্রামেও তাদের কোনো ধরনের ভূমিকা ছিল না। প্রাথমিক প্রার্থী ঘোষণার পর এসব আসনে সবচেয়ে বেশি বিক্ষোভ হওয়ায় সেখানে বিশেষ নজর রাখছে বিএনপি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু যুগান্তরকে বলেন, ‘কয়েকটি আসনে ক্ষোভ হতেই পারে। এসব আমরা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করছি, সমাধানের চেষ্টা করছি।’
বিরোধ সমাধানের উদ্যোগ
কুমিল্লা-৯ (লাকসাম-মনোহরগঞ্জ) সংসদীয় আসনের মো. আবুল কালামকে মনোনয়ন দেওয়ার পর ওই আসনে অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী সামিরা আজিম দোলার কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। গণসংযোগে গেলে দোলার গাড়িবহরে হামলাও করা হয়। পরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে ১৪ নভেম্বর রাতে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ উভয়কে গুলশান কার্যালয়ে ডেকে দলের নির্দেশনা দেন। পরিপ্রেক্ষিতে দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে। এ সময় কালামকে সমর্থন জানিয়ে নির্বাচনে সহযোগিতার আশ্বাস দেন দোলা। বিএনপির প্রার্থী আবুল কালাম বলেন, ‘দলের সুসংগঠিত ও সমন্বিত প্রচেষ্টায় ধানের শীষকে বিজয়ী করার জন্য একসঙ্গে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন। তারেক রহমানের নির্দেশনা মেনে আমরা ঐক্য অটুট রেখে ধানের শীষকে বিজয়ী করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
সাতক্ষীরা-৩ (কালীগঞ্জ-আশাশুনি) আসনে ডা. শহিদুল আলমকে মনোনয়ন না দিয়ে সাবেক সংসদ-সদস্য কাজী আলাউদ্দীনকে মনোনয়ন দেওয়ার প্রতিবাদে কালীগঞ্জে বিএনপির একাংশ বিক্ষোভ মিছিল করে। এ আসনেও ডা. শহিদুলের সঙ্গে কথা বলেছেন বিএনপি হাইকমান্ড।
ময়মনসিংহ-৬ (ফুলবাড়িয়া) আসনে আখতারুল আলমের মনোনয়ন বাতিল করে সাবেক ছাত্রনেতা আব্দুল করীম সরকারকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবিতে গণমিছিল ও বিক্ষোভ করে স্থানীয় নেতাকর্মীদের একাংশ। এ আসনে মনোনয়নবঞ্চিত আব্দুল করীম সরকারকে বিএনপির শীর্ষ পর্যায় থেকে ফোন করে ঐক্যবদ্ধভাবে ধানের শীষের পক্ষে কাজ করার কথা বলা হয়েছে।
সূত্রমতে, এই দুই মনোনয়নপ্রত্যাশী বিএনপি মহাসচিবকে জানিয়েছেন, যাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে এলাকায় তার কোনো জনপ্রিয়তা নেই। সেখানে প্রার্থিতা পুনর্বিবেচনা করা না হলে বিএনপির প্রার্থী জয়ী হতে পারবে না বলে তারা জানান। প্রয়োজনে নিরপেক্ষ কাউকে দিয়ে জরিপ করারও অনুরোধ জানান তারা।
তবে ওই নেতারা প্রতিশ্রুতি দেন, দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়-এমন কোনো কর্মকাণ্ড তারা করবেন না। ধানের শীষই তাদের ঠিকানা।
এছাড়া এদিন জয়পুরহাট-১ ও জয়পুরহাট-২, রাজশাহী-৪ ও রাজশাহী-৫, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনসহ আরও কয়েকটি আসনের মনোনয়নবঞ্চিতদের সঙ্গে কথা বলে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশনার কথা জানিয়ে দেন বিএনপি মহাসচিব। যেসব আসনে প্রার্থী নিয়ে বিরোধ চলছে, পর্যায়ক্রমে সেসব আসনের মনোনয়নবঞ্চিতদের নিয়ে বৈঠক করার কথা রয়েছে। এছাড়া বিরোধপূর্ণ আসনে মনোনয়নবঞ্চিতদের মধ্যে যার শক্ত অবস্থান ও জনপ্রিয়তা আছে, তার সঙ্গেও বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা কথা বলছেন। কোনো কোনো আসনে প্রার্থীদের সঙ্গে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও কথা বলছেন।
কয়েকটি আসনে বয়স্ক প্রার্থী নিয়ে জটিলতায় পড়েছে বিএনপি। এসব আসনের প্রার্থী নিয়ে স্থানীয় রাজনীতিতে সমালোচনা চলছে। ওইসব আসনের নেতারা জানান, এলাকার সাধারণ মানুষ প্রধানত বয়স ও শারীরিক সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। তারা বলছেন, বয়োবৃদ্ধ নেতাদের নেতৃত্বদানের সক্ষমতা কমে গেছে। বিশেষ করে অভ্যুত্থান-পরবর্তী দেশের রাজনীতিতে তরুণ প্রজন্ম জেন-জি একটি ফ্যাক্টর। তাদের ভোটও নির্বাচনে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। এই প্রজন্ম এবারের ভোটে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। যেখানে শুধু তাদের ভোটই নয়; তারা পরিবারের সদস্যদেরও ভোটদানে প্রভাবিত করতে পারবেন। এমন বাস্তবতায় তরুণ এই প্রজন্মের সঙ্গে ন্যূনতম সম্পর্ক নেই এমন ব্যক্তিদের ভোটদানে তাদের আগ্রহ কম থাকবে বলে তারা যুক্তি দিচ্ছেন। তাই বাস্তবতা অনুধাবন করে অপেক্ষাকৃত তারুণ্যকে প্রাধান্য দিয়ে বিএনপির মনোনয়ন চূড়ান্ত করার দাবি তুলছে ওইসব আসনের মনোনয়নবঞ্চিতরা।
কয়েকটি আসনে বয়স্ক প্রার্থী পরিবর্তনের জন্য স্থানীয় নেতারা দলীয় হাইকমান্ডের কাছে আবেদনও করেছেন।
সূত্রমতে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (কসবা-আখাউড়া) আসনে বিএনপির প্রাথমিক মনোনয়ন পেয়েছেন ৮৮ বছর বয়সি মুশফিকুর রহমান। স্থানীয় নেতারা আবেদনে বলেন, এই আসনে দলের পরীক্ষিত নেতৃত্বকে উপেক্ষা করা হয়েছে। বিগত দিনে দলের কঠিন সময়ে, আন্দোলন-সংগ্রামে কসবা-আখাউড়ার রাজপথে যিনি নেতাকর্মীদের পাশে ছিলেন-সেই কবীর আহমেদ ভূঁইয়াকে বিবেচনায় না রেখে দীর্ঘদিন এলাকাবিচ্ছিন্ন একজন প্রবীণ প্রবাসীকে মনোনয়ন দেওয়ায় অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়েছেন।’
আবেদনে বলা হয়, মেহেদী আহমেদ রুমীর মতো একজন বয়োবৃদ্ধ প্রার্থীর পক্ষে দলের একাংশকে নিয়ে প্রতিপক্ষকে ভোটের মাঠে মোকাবিলা করা কঠিন। এছাড়া রুমীর অসুস্থতা, কিছুটা ইমেজ সংকট, নেতৃত্বের এবং তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকা এবং এক-এগারো তার পরিবারের বিতর্কিত ভূমিকাসহ নানা কর্মকাণ্ড তুলে ধরা হয়েছে। পক্ষান্তরে ওই আসনের বঞ্চিত প্রার্থী শেখ সাদীর সম্পর্কে আবেদনে বলা হয়েছে, তিনি অপেক্ষাকৃত তরুণ, ক্লিন ইমেজ এবং স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক রয়েছে।
তিনি বলেন, ৩০ বছর ধরে রাজনীতি করছি। ১৭ বছর ধরে অনেকে হামলা-মামলা-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এ আসনে সাদিকেই মনোনয়ন দেওয়া হলে ধানের শীষের বিজয় সম্ভব হবে।
চট্টগ্রাম-১৩ আসনে সরওয়ার জামাল নিজাম প্রাথমিক মনোনয়ন পেয়েছেন। তার বয়স ৮০ বছরেরও বেশি। তার অতীত কর্মকাণ্ডসহ নানা বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে লিখিত জানানো হয়েছে। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপি শীর্ষ তিন নেতা স্বাক্ষরিত এক আবেদনে বলা হয়, দীর্ঘ সময়ে আন্দোলন সংগ্রামে নির্যাতিত-নিপীড়িত কর্মী হিসাবে বিএনপি ঘোষিত সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায় বিগত সময়ে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় সাবেক সংসদ-সদস্য সরওয়ার জামাল নিজামের নাম দেখে অনেকেই হতবাক ও ব্যথিত হয়েছেন। মনোনয়ন পুনর্বিবেচনা করে যারা দলের দুঃসময়ে আন্দোলন সংগ্রামে ছিল এ রকম কাউকে দলীয় প্রার্থী দেওয়ার জন্য আবেদন জানান তারা।
তৃণমূলের দাবিকে গুরুত্ব দিয়ে শেষ পর্যন্ত কোন কোন আসনে প্রার্থী বদল হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বিএনপির হাইকমান্ড।