৫০টির বেশি আসনে মনোনয়ন পুনর্বিবেচনার দাবি
অসন্তোষ বাড়ছে বিএনপিতে
জাগো বাংলা প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২৫, ১২:৫৮ পিএম
বিএনপির ঘোষিত প্রার্থীদের নিয়ে দলজুড়ে অসন্তোষ বাড়ছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় কর্মীরা ৫০টির বেশি আসনে মনোনয়ন পুনর্বিবেচনার দাবিতে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ করছেন।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৩ নভেম্বর ঘোষিত তালিকায় নব্য, 'হাইব্রিড', বিগত দিনে সুবিধাভোগী এবং আন্দোলন-সংগ্রামে নিষ্ক্রিয় ছিলেন—এমন ব্যক্তিরাও স্থান পেয়েছেন।
এছাড়া প্রবাসে থাকা বেশ কয়েকজনকেও মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। ফলে ত্যাগী, যোগ্য ও জনপ্রিয় নেতা বাদ পড়ে যাওয়ার অভিযোগে বিভিন্ন আসনে ভাঙচুর, মানববন্ধন, বিক্ষোভ, সমাবেশ এবং সড়ক–রেলপথ অবরোধ করে প্রতিবাদ করছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, এবারের নির্বাচন পরিস্থিতি ভিন্ন।
তিনি বলেন, "১৭ বছর ধরে সবাই আন্দোলন-সংগ্রাম করছে, কষ্ট করছে। মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের দেখতে হবে কাকে দিলে ভোট বেশি পাওয়া যাবে। যিনি বেশি ভোট আনতে পারবেন তাকেই মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিয়ে এখনো আমরা স্টাডি করছি। কোথাও ভুল হয়ে থাকলে সংশোধন করা হবে। এখনো সময় আছে, দল কাজ করছে।"
এর আগে, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও পরিষ্কার করে জানিয়েছিলেন—ঘোষিত প্রার্থীদের তালিকা চূড়ান্ত নয়, প্রয়োজনে তা পরিবর্তন করা হতে পারে।
দলীয় সূত্র বলছে, চূড়ান্ত মনোনয়ন দেওয়ার আগে ২৩টি আসন সম্ভাব্য সংশোধনের জন্য আগেই চিহ্নিত করা হয়েছে।
বিতর্কিত কয়েকটি মনোনয়ন
টাঙ্গাইল–৩ (ঘাটাইল) আসনে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে এস এম ওয়াবদুল হক নাসিরের নাম ঘোষণা করেছে বিএনপি। এ আসনে স্থানীয় বিএনপির বড় একটি অংশ প্রার্থী পরিবর্তনের দাবি জানাচ্ছে। এ দাবিতে টানা মিছিল, সমাবেশ, বিক্ষোভ ও মানববন্ধন চলছে।
বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, এস এম ওয়াবদুল হক নাসির ঘাটাইলের ভোটার নন, তার বাড়ি বাসাইল উপজেলায়। ফলে "বহিরাগত" প্রার্থী হিসেবে তাকে মানতে নারাজ অধিকাংশ স্থানীয় নেতা–কর্মী, সমর্থক ও ভোটার।
তারা নাসিরের পরিবর্তে সাবেক মন্ত্রী লুৎফর রহমান আজাদ অথবা বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মাইনুল ইসলামকে চূড়ান্ত প্রার্থী করার দাবি জানাচ্ছেন।
সুনামগঞ্জ–১ আসনে বিএনপির প্রাথমিক মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা কৃষক দলের আহ্বায়ক আনিসুল হক। দলীয় সূত্র বলছে, ওয়ান–ইলেভেনের সময় তিনি সংস্কারপন্থী ছিলেন বলে স্থানীয়ভাবে তার মনোনয়নকে কেন্দ্র করে প্রশ্ন উঠেছে।
অভিযোগ রয়েছে, তিনি ওয়ান–ইলেভেনের রূপকার হিসেবে পরিচিত সাবেক সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমদের ভাইয়ের ব্যবসায়িক অংশীদার ছিলেন। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন–সংগ্রামে নেতাকর্মীদের পাশে না থাকার অভিযোগও আছে। স্থানীয় নেতাদের দাবি—গত ১৫ বছরে বিএনপির প্রায় সব নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হলেও তার বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক মামলা হয়নি; তিনি মামলা পেয়েছেন শুধু তাহিরপুর উপজেলার যাদুকাটা নদী থেকে বালু উত্তোলনের ঘটনায় পরিবেশ আইনে। ৫ আগস্ট পরিস্থিতি পরিবর্তনের পর সুনামগঞ্জে আওয়ামী লীগের পুনর্বিন্যাস–প্রক্রিয়ায়ও তিনি ভূমিকা রেখেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া–৪ আসনে সাবেক এমপি মুশফিকুর রহমানকে সম্ভাব্য প্রার্থী করা হয়েছে। বয়স নব্বই–এর কাছাকাছি, পাশাপাশি গত ১৭ বছর তিনি কানাডা প্রবাসী ছিলেন। দুঃসময়ে তাকে না পাওয়ার অভিযোগে স্থানীয় নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ। এ আসনে অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশী কবির আহমদ ভূইয়ার সমর্থনে প্রতিদিনই বিভিন্ন কর্মসূচি চলছে।
কুষ্টিয়া–৪ আসনে সাবেক এমপি সৈয়দ মেহেদি আহমেদ রুমিকে প্রার্থী করা হয়েছে। বয়স আশির কোঠার এই নেতার পরিবর্তে জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক শেখ সাদীকে প্রার্থী হিসেবে চান অনেকেই। তরুণ প্রজন্ম ও নারী ভোটারদের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য হওয়া এবং দীর্ঘদিন মাঠে সক্রিয় থাকার কারণে তার প্রতি সমর্থন বেশি বলে মত স্থানীয়দের। এ আসনেও মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবি জোরালো হয়ে উঠেছে।
নেত্রকোণা–৫ (পূর্বধলা) আসনে ধানের শীষের প্রাথমিক প্রার্থী আবু তাহের তালুকদারকে ঘিরে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে—২০০১ সালে চার দলীয় জোট সরকারের শুরুতেই নেত্রকোণা জেলা শহরে 'আইটিসিএল' লুটকাণ্ডের ঘটনায় তিনি জেলা সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায় দল থেকে বহিষ্কৃত হন। গত ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাপক সম্পদশালী হয়ে উঠেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
চট্টগ্রাম–১২ আসনে ৫ আগস্টের পর এস আলম গ্রুপের গাড়িকাণ্ডে বহিষ্কৃত ও বিতর্কিত নেতা এনামুল হককে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। রহস্যজনকভাবে বহিষ্কারের কয়েক মাসের মধ্যে তার সাংগঠনিক শাস্তি তুলে নেওয়া হয়। বিভিন্ন অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও দলীয় হাইকমান্ড তা আমলে নেয়নি বলে নেতাকর্মীদের অভিযোগ।
এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। একই আসনে আওয়ামী লীগ আমলে গুমের শিকার বিএনপি নেতা সৈয়দ সাদাত আহমদকে মনোনয়ন না দেওয়ায় ক্ষোভ আরও বেড়েছে।
বিএনপি নেতাকর্মীরা বলেন, একাধিক গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও হাইকমান্ড আপত্তি উপেক্ষা করায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা তীব্র হয়েছে। তাদের ক্ষোভ—গুমের শিকার হয়েও সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন সৈয়দ সাদাত আহমদ।
এদিকে, মাদারীপুর–১ আসনে তালিকা প্রকাশের একদিন পরই কামাল জামান মোল্লার মনোনয়ন স্থগিত করে দল।
এছাড়া ঘোষিত প্রার্থীদের নিয়ে যেখানে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছে এবং প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি চলছে, তার মধ্যে রয়েছে—মাগুরা–১; গাইবান্ধা–৪; নরসিংদী–৪; টাঙ্গাইল–১ ও ৫; ঝিনাইদহ–৩; নাটোর–১; চাঁপাইনবাবগঞ্জ–২; ময়মনসিংহ–৩, ৬ ও ৯; নীলফামারী–৪; কুষ্টিয়া–২, ৩ ও ৪; কিশোরগঞ্জ–৫; চট্টগ্রাম–২, ৪, ১৩ ও ১৬; কুমিল্লা–৫, ৬ ও ১০; জামালপুর–২; সাতক্ষীরা–২ ও ৩; কুড়িগ্রাম–১ ও ৩; রাজশাহী–১, ৩ ও ৪; ব্রাহ্মণবাড়িয়া–৫; নোয়াখালী–২ ও ৫; ফেনী–২; রাজবাড়ী–২; শেরপুর–১ ও ২; চাঁদপুর–৪; মেহেরপুর–১, ২ ও ৩; নওগাঁ–১, ৩ ও ৪; জয়পুরহাট–২; পাবনা–৪; মুন্সিগঞ্জ–১; দিনাজপুর–২; গোপালগঞ্জ–২ এবং মৌলভীবাজার–২।