বিএনপির প্রার্থী তালিকার ৮৫% উচ্চশিক্ষিত
পিএইচডি ৬ জন, ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার ২০ জন
জাগো বাংলা প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৫, ০২:০১ এএম
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এসব প্রার্থী এখন আসনভিত্তিক গণসংযোগে ব্যস্ত সময় পার করছেন। তবে মনোনয়নের ক্ষেত্রে এবার বিএনপি ভিন্নতা দেখিয়েছে; যা এখন সব মহলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। দলটির ঘোষিত সম্ভাব্য একক প্রার্থী তালিকার ৮৫ শতাংশই উচ্চশিক্ষিত। আছেন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করা ব্যক্তিও। অন্তত দুইজন পড়াশোনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা আইভি লিগের অন্তর্ভুক্ত দুইটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এছাড়া বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন প্রার্থীদের প্রায় ১৪ শতাংশ। অন্তত ৪০ শতাংশ পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়টির অধিভুক্ত কলেজ থেকে। বিএনপির প্রার্থী তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বিশ্লেষণ করে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ফ্যাসিবাদ-পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ গড়তে জনগণের যে আকাঙ্ক্ষা, এর প্রতি সম্মান জানিয়ে প্রার্থী দিয়েছে বিএনপি। সেজন্যই উচ্চশিক্ষিতদের প্রাধান্য দিয়েছে দলটি। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী বলেন, জনগণের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে উচ্চশিক্ষিতদের প্রার্থী করেছে বিএনপি। উচ্চশিক্ষিত হয়ে যদি জাতির প্রতি অঙ্গীকার থাকে এবং জনগণের সেবায় আত্মনিয়োগ করে, তাহলে সেটিকে সাধুবাদ জানাই। তবে এটিও খেয়াল রাখতে হবে-শুধু উচ্চশিক্ষিত হলেই হবে না, জনগণ বা সমাজের জন্য কমিটমেন্ট থাকতে হবে। কারণ, রাজনীতির উদ্দেশ্যই হলো জনগণের মঙ্গল তথা মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য কাজ করা। এলাকায় গেলেন না, মানুষের জন্য কাজ করলেন না, সেই উচ্চশিক্ষিত হয়ে জনগণের লাভ নেই।
৮৫ শতাংশ প্রার্থীই উচ্চশিক্ষিত : উচ্চমাধ্যমিক বা এইচএসসি-পরবর্তী বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সমমানের শিক্ষাকে সাধারণ উচ্চশিক্ষা হিসাবে গণ্য করা হয়। উচ্চশিক্ষাকে সাধারণত তিনটি স্তরে ভাগ করা যায়-স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও ডক্টরেট। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বা সমমানের প্রতিষ্ঠান থেকে প্রদত্ত বিএ, বিবিএ, বিএসএস, বিএসসি ইত্যাদি ডিগ্রিকে ধরা হয় স্নাতক সমমানের ডিগ্রি। এছাড়া ইসলামিধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আলিয়া মাদ্রাসাগুলোয় ফাজিলকে স্নাতক সমমানের ডিগ্রির স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বিএনপি ২৩৭ আসনে প্রাথমিক একক প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে একটি আসনের প্রার্থিতা স্থগিত রয়েছে। ২৩৬ প্রার্থীর মধ্যে ২২৩ জনের শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে বিএনপির গুলশান কার্যালয়ের একটি উচ্চপর্যায়ের সূত্র থেকে নিশ্চিত করা গেছে।
প্রার্থী তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২২৩ জনের মধ্যে ৮৭ জন স্নাতক পর্যায় পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। স্নাতক সমমানের শিক্ষাগত যোগ্যতা রয়েছে এমন ব্যক্তিদের প্রায় ২০ শতাংশই পড়াশোনা করেছেন আইন বিষয়ে। এছাড়া অন্তত ১৬ শতাংশ বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে এবং ১৮ শতাংশ পড়াশোনা করেছেন ব্যবসায় শিক্ষায়। শুধু স্নাতক পর্যায় পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন-এমন ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত আটজন পড়াশোনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ায়।
এছাড়া আইন বিষয়ে বিদেশে এলএলবি করেছেন এমন প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন যুক্তরাজ্যের ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ও খ্যাতনামা আইনজীবী মাহবুব উদ্দিন খোকন, যিনি জুলাই আন্দোলনে মার্চ ফর জাস্টিস সংগঠনে ভূমিকা রেখেছিলেন। নেত্রকোনা-১ আসন থেকে মনোনীত ব্যারিস্টার কায়সার কামাল এলএলবি করেছেন যুক্তরাজ্যের উলভারহ্যাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি করেছেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রাগিব রউফ চৌধুরী, যিনি লড়বেন কুষ্টিয়া-২ আসন থেকে। নাটোর-১ আসনের ফারজানা শারমিন পুতুলও পড়াশোনা করেছেন যুক্তরাজ্যে।
পিএইচডি ডিগ্রিধারী ছাড়াও রয়েছেন ২০ জন ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তিনি পড়াশোনা করছিলেন যুক্তরাজ্যের ইমপেরিয়াল কলেজে এবং সেখান থেকেই প্রবাসীদের স্বাধীনতাসংগ্রামের পক্ষে সংগঠিত করেছিলেন। পরে সেখান থেকেই পিএইচডি সম্পন্ন করে সদ্য স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন সত্তরের দশকে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আহ্বানে যোগ দেন বিএনপিতে। বর্তমানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য লড়বেন কুমিল্লা-১ আসন থেকে। এছাড়া নরসিংদী-২ আসন থেকে লড়বেন ড. আব্দুল মঈন খান, যিনি পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন যুক্তরাজ্যের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ২০০২ সালে তিনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রকাশনায় একজন সাবেক শিক্ষার্থী হিসাবে তার মন্ত্রিত্বের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি দায়িত্বে থাকাকালীনই বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবলের নেটওয়ার্কে যুক্ত হয়।
বিএনপির প্রার্থীদের তালিকায় থাকা ১১ জন ডাক্তার স্থান পেয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ইউরোলজিস্ট ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন। দেশে এমবিবিএসসম্পন্ন করার পর যুক্তরাজ্যের রয়্যাল কলেজ অব ফিজিশিয়ান্স, এডিনবরা থেকে এফআরসিপি সম্পন্ন করেন। তালিকায় আরও আছেন ডা. এমএ মুহিত, যিনি একজন জনস্বাস্থ্যবিদ। এ বিষয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করেছেন লন্ডন স্কুল অব হাইজিন ও ট্রপিক্যাল মেডিসিন থেকে। ডা. মুহিত লড়বেন সিরাজগঞ্জ-৬ আসন থেকে।
২০১৮ সালের নির্বাচনে সর্বকনিষ্ঠ প্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন পাওয়া ডা. সানসিলা জেবরিন এবারও মনোনয়ন পেয়েছেন শেরপুর-১ আসন থেকে। তিনি ছাড়াও ডাক্তারি পেশায় যুক্ত এমন প্রার্থীদের মধ্যে আছেন খন্দকার জিয়াউল ইসলাম মোহাম্মাদ আলী, অধ্যাপক সৈয়দ মাইনুল হাসান সাদিক, একরামুল বারী টিপু, মাহবুবুর রহমান লিটন, আনোয়ারুল হক, দেওয়ান মো. সালাহউদ্দিন, অধ্যাপক এসএম রফিকুল ইসলাম এবং আবু মনসুর সাখাওয়াত হোসেন জীবন।
ইঞ্জিনিয়ারের মধ্যে রয়েছেন ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-অ্যাবের উপদেষ্টা মঞ্জুরুল আহসান মুন্সী, বুয়েট থেকে পাশ করা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার জাকির হোসেন সরকার ও বুয়েট গ্র্যাজুয়েটস ক্লাবের বর্তমান সভাপতি খালেদ হোসেন মাহবুব। এছাড়াও তালিকায় আছেন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে রুয়েট থেকে পাশ করা আশরাফ উদ্দিন বকুল। দেশের বাইরে প্রকৌশল বিদ্যায় ডিগ্রি নিয়েছেন শামা ওবায়েদ, ইশরাক হোসেন, মাইনুল ইসলাম খান এবং ফাহিম চৌধুরী।
আইভি লিগ অ্যালামনাই ২ জন : আইভি লিগ অ্যালামনাই আইভি লিগের অন্তর্ভুক্ত বিশ্বের নামকরা আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীদের বোঝায়। বিশ্ববিদ্যালয় হলো ব্রাউন, কলাম্বিয়া, কর্নেল, ডার্টমাউথ, হার্ভার্ড, পেনসিলভানিয়া, প্রিন্সটন ও ইয়েল। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জনএফ কেনেডি এবং বারাক ওবামাও আইভি লিগ অ্যালামনাই। বিএনপির প্রার্থী তালিকায় থাকা ড. ওসমান ফারুক ও ব্যারিস্টার নওশাদ জমিরও আইভি লিগ অ্যালামনাই। বিশ্বব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. ওসমান ফারুক। তিনি পিএইচডি করেছেন আইভি লিগের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি অর্থনীতির ওপর। তিনি কিছুদিন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেছেন। ওসমান ফারুক লড়বেন কিশোরগঞ্জ-৩ থেকে। বিশ্বখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ট্যাক্সেশন বা কর আরোপ সংক্রান্ত বিষয়ে এমএসসি করেছেন ব্যারিস্টার মুহম্মদ নওশাদ জমির। এছাড়া তিনি এলএলএম করেন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত আইভি লিগের অন্তর্গত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হার্ভার্ড ল স্কুল থেকে। নওশাদ জমির লড়বেন পঞ্চগড়-১ আসন থেকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা এর অধিভুক্ত কলেজের ৪০ শতাংশ : স্নাতক স্তরের পরবর্তী ডিগ্রি নিয়েছেন এমন প্রার্থীর সংখ্যা এখন পর্যন্ত একশ, যাদের মধ্যে অন্তত ৯০ জনের স্নাতকোত্তর বা সমমানের ডিগ্রি রয়েছে। প্রার্থীদের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এর মধ্যে ৪০ শতাংশ পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা এর অধিভুক্ত কলেজ থেকে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, হাফিজ উদ্দিন আহমদ ও সালাহউদ্দিন আহমদ রয়েছেন এ তালিকায়। এছাড়া রয়েছেন দলটির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের একঝাঁক নেতা, যারা এবার নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আ ন ম এহসানুল হক মিলন, সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী আমান উল্লাহ আমান, খায়রুল কবির খোকন, হাবিবুল ইসলাম হাবিব, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, রকিবুল ইসলাম বকুল, আজিজুল বারী হেলাল, আমিরুল ইসলাম খান আলিম, নুরুল ইসলাম নয়ন, শহীদুল ইসলাম বাবুল, রাজিব আহসান ও কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ। শেখ হাসিনা সরকারের সময় গুম হওয়া সাবেক ছাত্রদল নেতা ও সংসদ-সদস্য এম ইলিয়াস আলীর সহধর্মিণী তাহসিনা রুশদীরও স্নাতকোত্তর করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগ থেকে।