১০ জেলার ২০টি আসনে প্রার্থী বদলের আন্দোলন
বিতর্কিতদের নিয়ে বিপাকে বিএনপি
জাগো বাংলা প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ০৫:৩৬ পিএম
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিছু কিছু আসনে বিতর্কিত, অযোগ্য ও হাইব্রিড নেতাকে প্রার্থী হিসেবে বেছে নিয়ে চাপে পড়েছে বিএনপি। এ নিয়ে তৃণমূলে হতাশা আর ক্ষোভ ঝরছে। ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ-দুঃখে ফুঁসছেন। এরই মধ্যে বিতর্কিত এক নেতার প্রার্থিতা স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছে দলটি। অনেক আসনে প্রার্থিতা বদলের আন্দোলন এখনও চলছে। কোথাও সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটছে। এই ঘরোয়া দ্বন্দ্বের রাশ টানতে না পারলে অনেক আসন হাতছাড়া হতে পারে বলে শঙ্কা করছেন নেতাকর্মীরা।
যদিও দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ তালিকা চূড়ান্ত নয়। দলের স্থায়ী কমিটি যদি মনে করে, পার্লামেন্টারি বোর্ডের কাছে প্রতীয়মান হয়– তারা কোনো আসনে প্রার্থী বদল করবে, সেটি নিঃসন্দেহে নিয়ম মেনে পরিবর্তন আসবে।
নেতাকর্মীরা বলছেন, এরই মধ্যে মাদারীপুর-১ (শিবচর) আসনে কামাল জামান মোল্লার প্রার্থিতা স্থগিত করলেও অনেক আসনে বিতর্কিত আর অযোগ্যরা রয়ে গেছেন। মনোনয়ন নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলেও সাংগঠনিক শাস্তির ভয়ে মনোনয়নবঞ্চিত নেতারা প্রকাশ্যে কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন না। তবে এর মধ্যেও অন্তত ১০ জেলার প্রায় ২০টি আসনে প্রার্থী বদলের আন্দোলন চলছে।
এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, বিএনপির পক্ষ থেকে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, এটি সম্ভাব্য তালিকা। কোনো এলাকায় তেমন পরিবর্তন মনে করলে অবশ্যই সেটি করা হবে। আর বড় দল হিসেবে প্রতিটি আসনে একাধিক যোগ্য প্রার্থী আছে। সবকিছু বিশ্লেষণ করেই এ তালিকা করা হয়েছে।
অসন্তোষ বাড়ছে : চট্টগ্রাম-২ আসনে বিএনপি ঋণখেলাপি সরওয়ার আলমগীরকে বেছে নিয়েছে। শিক্ষাগত যোগ্যতায় অষ্টম শ্রেণি পাস এই নেতা রাজনৈতিক পালাবদলের পর দলে সক্রিয় হন। ২০১৮ সালে এই আসনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন কর্নেল (অব.) আজিম উল্লাহ বাহার চৌধুরী। তিনি ফটিকছড়ি বিএনপির আহ্বায়ক। নেতাকর্মীরা বলছেন, সরওয়ার অঢেল টাকার মালিক। সেখানে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে তাঁর মতো নেতাকে প্রার্থী করা হয়েছে। এটা নিয়ে সবাই ক্ষুব্ধ।
চট্টগ্রাম-৪ আসনে ‘হেভিওয়েট’ নেতা লায়ন আসলাম চৌধুরীর বদলে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও উপজেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি কাজী সালাহউদ্দিনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। আসলামের অনুসারী হিসেবে পরিচিত সালাহউদ্দিন। এতে বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা আন্দোলনের পাশাপাশি গণপদত্যাগের ঘোষণাও দিয়েছেন।
গাজীপুর-৩ আসনে বিএনপি বেছে নিয়েছে দলের কেন্দ্রীয় সহস্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. এস এম রফিকুল ইসলাম বাচ্চুকে। বিগত দিনে এই এলাকায় তিনি সক্রিয় ছিলেন না। তাঁর বিরুদ্ধে দুটি মামলা ও ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে গ্রেপ্তারের ঘটনা ছাড়া উল্লেখযোগ্য কিছু নেই। অথচ দীর্ঘদিন ধরে এই আসনে কাজ করছেন আক্তারুল আলম মাস্টার। জনপ্রিয় এই নেতার বিরুদ্ধে ৩০টির ওপর মামলা এবং তিনি চারবার কারাবরণ করেছেন। তার পরও মূল্যায়ান না হওয়ায় ভোটে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে শঙ্কা করছেন নেতাকর্মীরা।
সুনামগঞ্জ-৫ আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক কলিমউদ্দিন মিলনকে। তিনি ওয়ান-ইলেভেনের সংস্কারপন্থি নেতা ছিলেন। এলাকায় নেতাকর্মীর সঙ্গে ভালো যোগাযোগ না থাকলেও তদবিরে মনোনয়ন বাগিয়েছেন বলে অভিযোগ স্থানীয় নেতাকর্মীর। ২০১৮ সালে এই আসনে মনোনয়ন পেয়েছিলেন মিজানুর রহমান চৌধুরী। বিগত দিনে তিনি এলাকায় নেতাকর্মী ছাড়াও সাধারণ মানুষের পাশে ছিলেন বলে জানিয়েছেন উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা আকরাম হোসেন। তিনি বলেন, মিজানের মতো জনপ্রিয় নেতাকে বাদ দিয়ে মিলনের মতো নেতাকে বাছাই করার খেসারত দলকে দিতে হবে।
নেত্রকোনা-৩ আসন নিয়েও জটিলতা বাড়ছে। সেখানে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে রফিকুল ইসলাম হিলালীকে। তাঁর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ তুলেছেন অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা। সেখানে সাবেক মেয়র ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন ভূঁইয়া দুলাল নীরব ভূমিকা পালন করলে আসনটি হাতছাড়া হতে পারে বলে শঙ্কা নেতাকর্মীর।
চাঁদপুর-২ আসনে মো. জালাল উদ্দিনকে প্রার্থী করা হয়েছে। অথচ আন্দোলনের সময়ে স্থানীয় নেতাকর্মী নিয়ে তিনি বনভোজন করায় বিতর্ক সৃষ্টি হয়। স্থানীয়রা তাঁকে প্রবাসী নেতা হিসেবেই চেনেন। এই আসনে ডা. মাহবুবের রহমান শামীম আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় থাকলেও এবার তিনি বঞ্চিত হয়েছেন।
চাঁদপুর-৪ আসনে মনোনয়নবঞ্চিত বিএনপি নেতা এম এ হান্নানের অনুসারীরা কয়েকদিন ধরে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছেন। এ আসনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির ব্যাংকিং ও রাজস্ববিষয়ক সম্পাদক হারুনুর রশীদকে প্রার্থী করা হয়েছে। উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক এম এ হান্নানের কর্মী-সমর্থকরা এর বিরোধিতা করছেন। স্থানীয় বিএনপি নেতা দোলোয়ার হোসেন দুলু বলেন, এম এ হান্নান যখন কারাগারে গেছেন, মামলা-হামলায় নির্যাতিত নেতাকর্মীদের পাশে ছিলেন তখন হারুন নিরাপদ দূরত্বে ছিলেন।
গোপালগঞ্জ-২ আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে ডা. এ কে এম বাবরকে। অথচ গত ১৭ বছরে এলাকায় তাঁর কোনো অবদান ছিল না। এই আসনে স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি সরদার মোহাম্মদ নুরুজ্জামানের বিরুদ্ধে অর্ধশতাধিক মামলা রয়েছে। এলাকার মানুষ তাঁকে সবসময় কাছে পেয়েছে।
এ ব্যাপারে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, বিএনপি বড় রাজনৈতিক দল। এখানে অনেক মনোনয়নপ্রত্যাশী। সবাইকে তো আর মনোনয়ন দেওয়া সম্ভব না। যারা মনোনয়ন পাননি, তাদের দল অন্যভাবে মূল্যায়ন করবে।
এস আলম ঘনিষ্ঠরাও প্রার্থী : বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলম গ্রুপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠদেরও মূল্যায়ন করেছে বিএনপি। এর মধ্যে নোয়াখালী-৫ আসনে প্রার্থী করা হয়েছে মোহাম্মদ ফখরুল ইসলামকে। তিনি এস আলম ঘনিষ্ঠ হওয়ার পাশাপাশি তাঁর বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। একসময়ের এই জামায়াত নেতা ২০০৯ সালে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনও করেছিলেন। তাঁর মেয়ে ব্যারিস্টার নাসরিন সুলতানা মিলি এবি পার্টির যুগ্ম সম্পাদক। অথচ এ আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে আলোচিত ছিলেন ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত ও কেন্দ্রীয় বিএনপির সহপল্লী উন্নয়ন ও সমবায়বিষয়ক সম্পাদক বজলুল করিম চৌধুরী আবেদ। বিগত দিনে তিনি এই এলাকায় এককভাবে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন। তাঁকে মনোনয়নবঞ্চিত করায় নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ।
চট্টগ্রাম-১২ আসনে গত বছর ৫ আগস্টের পর এস আলম গ্রুপের গাড়িকাণ্ডে দল থেকে বহিষ্কৃত নেতা এনামুল হককে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। যদিও বহিষ্কারের কয়েক মাসের মধ্যে তাঁর সাংগঠনিক শাস্তি প্রত্যাহার করা হয়।
নেতাকর্মীরা জানান, এস আলম পরিবারের তদবিরেই এনামুলকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ থাকলেও তা আমলে নেননি দলের শীর্ষ নেতারা। অথচ এই আসনে বিগত আওয়ামী লীগ আমলে গুমের শিকার সৈয়দ সাদাত আহমেদের মতো জনপ্রিয় নেতাকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
এস আলম ঘনিষ্ঠদের মনোনয়ন দেওয়ায় শুধু বিএনপি নেতাকর্মীরা নয়, মিত্র দলসহ অন্যান্য দলও সমালোচনা করছে। এর মধ্যে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ গত বুধবার চট্টগ্রামের চন্দনাইশে দলের এক অনুষ্ঠানে বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনও হাসিনার লোকজন সক্রিয়। কেউ এস আলমের মাধ্যমে, কেউ অন্যভাবে। চট্টগ্রামের পটিয়ার এনামুলের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, এখনও এস আলমের লোকজনকে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। এটি আমার কথা নয়, জনগণের কথা। আমিও তাদের সঙ্গে একমত।
কোন্দল মিটছে না শূন্য আসনে : এখনও ৬৩ আসন খালি রেখেছে বিএনপি। এসব আসনের বেশির ভাগে মিত্র দলের প্রার্থীকে মূল্যায়ন করতে পারে দলটি। তবে কিছু আসনে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের তীব্রতায় দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করতে গিয়ে জটিলতায় পড়েছে বিএনপি। এর মধ্যে সিলেট-৪ আসনে বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক মিফতা সিদ্দিকী মনোনয়ন চাইছেন। তবে রাজনৈতিক পালাবদলের পর মিফতা সিদ্দিকীর বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে বিব্রত দল। এ আসনে সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে মনোনয়ন দিতে চাইছে বিএনপি। তবে স্থানীয় কোন্দলের কারণে আরিফুল হক সিলেট-১ আসন চাইছেন। সেখানে খন্দকার আব্দুল মোক্তাদির চৌধুরীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এটি নিয়ে আরিফুলের সঙ্গে সমঝোতা করার চেষ্টা করছেন দলটির শীর্ষ নেতারা।
মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনে কাউকে মনোনয়ন দেয়নি বিএনপি। এই আসনে বিএনপির কেন্দ্রীয় সমাজসেবাবিষয়ক সম্পাদক কামরুজ্জামান রতনের বাইরে সাবেক এমপি ও মন্ত্রী আব্দুল হাইয়ের ছোট ভাই এবং জেলা বিএনপির সদস্য সচিব মহিউদ্দিন আহমেদ মনোনয়ন চাইছেন। এর মধ্যে কামরুজ্জামানের পক্ষে কেন্দ্রের এক প্রভাবশালী নেতা অবস্থান নেওয়ায় আসন পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠছে বলে স্থানীয় নেতারা জানান।
সদর উপজেলা যুবদলের নেতা সালাহউদ্দিন ভুঁইয়া বলেন, মহিউদ্দিনের বাড়ি সদর উপজেলায় আর রতনের বাড়ি গজারিয়ায়। সদরে ভোট বেশি। আবার মহিউদ্দিনের পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণে সেখানে তাদের জনসমর্থন সবচেয়ে বেশি। এই পরিবার ছাড়া আসনটিতে জিতে আসা সম্ভব নয়।
রেজা কিবরিয়া বিএনপিতে : বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ছেলে রেজা কিবরিয়া। তিনি হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ-বাহুবল) আসন থেকে সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করতে চান। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে একই আসনে ধানের শীষ প্রতীকেই নির্বাচন করেছিলেন। হবিগঞ্জ-১ আসনে দলটি এখনও তাদের প্রার্থী ঘোষণা করেনি। রেজা কিবরিয়া বিভিন্ন সময়ে গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক, গণঅধিকার পরিষদ ও এর বিভক্ত দল আমজনতার দলের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন।