বরিশালের ৫টি আসনে প্রার্থী দেয়নি বিএনপি, জামায়াতের মনোনয়ন নিয়ে রহস্য
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২৫, ০১:৪১ পিএম
বরিশাল বিভাগের পাঁচটি আসন ফাঁকা রেখে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে বিএনপি। এর মধ্যে একটিতে জামায়াতের হয়ে লড়ছেন মরহুম মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে মাসুদ সাঈদী। আরেকটিতে আছেন একই দলের প্রভাবশালী নেতা ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ। পিরোজপুর-২ আসনে জামায়াত প্রার্থী মাওলানা সাঈদীর আরেক ছেলে শামিম সাঈদীর বিপরীতেও অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রার্থী দিয়েছে বিএনপি।
বরিশালের ২১ নির্বাচনি এলাকার সবকটিতে প্রার্থী দিলেও কেবল এই ৩টি আসনই পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে জামায়াতের। সেই তিন আসনের ২টিতে কাউকে মনোনয়ন না দেওয়া আর একটিতে দুর্বল প্রার্থী দেওয়া নিয়ে চলছে আলোচনা। একসময়ের মিত্র জামায়াতকে আবারও কাছে পাওয়ার কৌশল হিসাবে বিএনপির এই ঢিলেঢালা আচরণ কিনা সেই প্রশ্নও তুলছেন অনেকে। যদিও ভিন্ন কথা বলছেন দলটির নেতারা। তাদের মতে, জোট প্রার্থীদের দেওয়াসহ প্রার্থী নির্বাচনে জটিলতা থাকায় কিছু আসনে ঘোষণা হয়নি মনোনয়ন। খুব শিগগিরই এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবে কেন্দ্র। এছাড়া এখানে আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি) সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ ও গণঅধিকার পরিষদ সভাপতি নুরুল হক নুরের আসনেও প্রার্থী দেয়নি বিএনপি।
বরিশালের ২১ নির্বাচনি এলাকার ১৬টিতে প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি। এর মধ্যে ৮ জন সাবেক এমপি। হেভিওয়েট মনোনয়ন-প্রার্থীদের মধ্যে বাদ পড়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল এবং সাবেক দুই এমপি নাজিমউদ্দিন আলম ও মেসবাহ উদ্দিন ফরহাদ। প্রথমবার মনোনয়ন পেয়েছেন যুবদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়ন, স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান এবং সাবেক টেকনোক্রেট প্রতিমন্ত্রী মরহুম নুরুল ইসলাম মঞ্জুরের ছেলে সুমন মঞ্জুর। বাকিরা হয় আগে সংসদে ছিলেন, নয়তো মনোনয়ন পেলেও জয়ী হতে পারেননি ভোটে। আলোচ্য এই ১৬ আসনের বাইরে যে ৫টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেনি বিএনপি সেগুলো নিয়েই এখন চলছে আলোচনা।
বরিশাল-৩ (বাবুগঞ্জ-মুলাদী) ও পটুয়াখালী-৩ (গলচিপা-দশমিনা) আসনে নির্বাচন করতে চাইছেন ব্যারিস্টার ফুয়াদ এবং ভিপি নুর। বিএনপি কাউকে প্রার্থী না করায় অনেকেই ভাবছেন আসন দুটি ছেড়ে দেওয়া হতে পারে তাদের। যদিও দলের ভেতরে রয়েছে ভিন্ন আলোচনা।
বরিশাল-৩ আসনে মনোনয়ন চাইছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাড. জয়নাল আবেদিন এবং মুলাদী উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি সাত্তার খান। আসনটি জোট বা সমমনা কাউকে ছাড়া হবে এমন কোনো আভাস এখনো মেলেনি। তবে এখানে জটিলতা বেধেছে সাত্তার খানকে নিয়ে। মুলাদী উপজেলায় সাত্তার খানের রয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। প্রায় ৫০ হাজার ভোটারের উপজেলা মুলাদীর এই নেতাকে ম্যানেজ করা না গেলে আসনটি হারাতে হতে পারে। যে কারণে বাকি দুই নেতাকে বলা হয়েছে সাত্তারকে ম্যানেজ করতে। যিনি পারবেন তিনিই হয়তো পাবেন মনোনয়ন। কেননা কেবল মুলাদীর ভোটে যেমন নির্বাচিত হতে পারবেন না সাত্তার, তেমনি তাকে বশে আনা না গেলে সহজ হবে না বিএনপির জয় পাওয়া। এ কারণেই এখানে প্রার্থী ঘোষণা হয়নি বলে বলছেন নেতারা। বরিশাল দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব অ্যাড. আবুল কালাম শাহিন বলেন, ‘বরিশাল-৩ বিএনপির নিশ্চিত আসন। এই আসনটি কেন অন্য কাউকে দেওয়া হবে? দলের স্বার্থে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যে সিদ্ধান্ত নেবেন সেটাই মেনে নেব। তবু দাবি থাকবে যাতে আসনটি আমাদেরই থাকে।’
পটুয়াখালী-২ (বাউফল) আসনেও প্রার্থী ঘোষণা করেনি বিএনপি। এখানে জামায়াতের প্রার্থী দলের প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতা ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ। বিএনপির মনোনয়নের আশায় মাঠে আছেন দলের কেন্দ্রীয় সহদপ্তর সম্পাদক মো. মুনির হোসেন, দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সাবেক এমপি শহিদুল আলম তালুকদার এবং ইঞ্জিনিয়ার ফারুক তালুকদার। কেন চূড়ান্ত প্রার্থী ঘোষণা হলো না সে ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারছেন না কেউ। দলের কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুল হক নান্নু বলেন, ‘প্রার্থী বাছাই চূড়ান্ত হয়নি বলেই ঘোষণা আসেনি। খুব শিগগিরই এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে কেন্দ্র।’ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. মজিবর রহমান বলেন, ‘রাজনীতিতে যেহেতু শেষ কথা বলে কিছু নেই তাই কেন প্রার্থী ঘোষণা হলো না সেটা কেন্দ্রই ভালো বলতে পারবে। তবে আমাদের কথা হচ্ছে এটি বিএনপির আসন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে জোর অনুরোধ যেন আসনটি আমাদেরই থাকে।’
মনোনয়ন প্রশ্নে বিএনপিকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে পিরোজপুর-২ (ভান্ডারিয়া-কাউখালী-স্বরূপকাঠী) আসনে। এখানে মনোনয়নের আলোচনায় শক্তিশালী প্রার্থী ছিলেন মাহমুদ হোসাইন ভিপি মাহমুদ এবং ফকরুল আলম। অথচ মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে ভান্ডারিয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি সুমন মঞ্জুরকে। একসময় বিএনপির রাজনীতি করতেন সুমন মঞ্জুরের বাবা মরহুম নুরুল ইসলাম মঞ্জুর। ১৯৯৬-র নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেলেও জামানত হারান তিনি। পরবর্তী দুটি নির্বাচনেও হারেন বিপুল ভোটের ব্যবধানে। প্রায় কোনো নির্বাচনেই জয় না পাওয়া এই আসনে প্রার্থী নির্বাচনে আরও সতর্ক থাকবে বিএনপি-এমনটাই ভেবেছিল সবাই। কিন্তু সুমন মঞ্জুরকে মনোনয়ন দিয়ে আসনটি জামায়াত প্রার্থী মরহুম সাঈদীপুত্র শামিম সাঈদীকে ছেড়ে দেওয়া হলো বলে বলছেন অনেকে। মনোনয়ন ঘোষণার পর ফেসবুকসহ নানা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এমনই মন্তব্য করে চলেছেন ওই এলাকার নেটিজেনরা।
পিরোজপুর-১ (জিয়ানগর-সদর-নাজিরপুর) আসন নিয়েও চলছে আলোচনা। এখানে জামায়াতের প্রার্থী সাঈদীর আরেক ছেলে মাসুদ সাঈদী। অনেকে বলছেন, জোটসঙ্গী জাতীয় পার্টির (জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দারকে ছেড়ে দেওয়া হতে পারে এই আসন। সেক্ষেত্রে প্রকারান্তরে আসনটি জামায়াতেরই হবে বলছেন তারা। বয়োবৃদ্ধ মোস্তফা জামাল হায়দারের সংগঠন কিংবা কর্মী বলতে তেমন কিছুই নেই নির্বাচনি এলাকায়। মনোনয়ন পেলে বিএনপির ওপর ভর করে ভোট করতে হবে তাকে। ধার করা এই শক্তিতে জয় নিশ্চিত অসম্ভব হয়ে পড়বে। সেক্ষেত্রে জিতে যাবে জামায়াত। বাস্তবতা স্বীকার করে পিরোজপুর জেলা বিএনপির সদস্য সচিব সাইদুল ইসলাম কিসমত বলেন, ‘জয় নিশ্চিত করতে হলে বিএনপি থেকেই প্রার্থী দিতে হবে। অন্য দলের কাউকে দেওয়া হলে জয় পাওয়া কঠিন হবে।’
এগুলোর পাশাপাশি ঝালকাঠি-১ (রাজাপুর-কাঁঠালিয়া) আসনেও প্রার্থী ঘোষণা করেনি বিএনপি। শোনা যাচ্ছে এই আসনটি নাকি চাইছেন লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান। দীর্ঘ বছর বিশ্বব্যাংকে চাকরি করে সদ্য অবসরে আসা বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. জিয়াউদ্দিন হায়দারকে নিয়েও চলছে আলোচনা। রাজনীতির নানা সমীকরণে জিয়াউদ্দিন কিংবা ইরানকে দেওয়া হতে পারে আসন, এমন আলোচনা রয়েছে বিএনপিতে। এসব কারণেই ঘোষণা হয়নি চূড়ান্ত প্রার্থী। বিএনপির কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমান বলেন, ‘ব্যক্তির চেয়ে যেমন দল বড়, তেমনি দলের চেয়ে দেশ। আমাদের নেতা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশ নিয়ে ভাবছেন। সেই ভাবনার পুরোটা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলাই এখন সবচেয়ে জরুরি। তিনি যে সিদ্ধান্তই নেবেন তা দেশের স্বার্থে। প্রার্থী ঘোষণা না হওয়া ৫ আসনেও তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। আমরা কেবল সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের একেকজন কর্মী।’