Logo
Logo
×

রাজনীতি

দুর্দিনের কান্ডারি দুই নেতা পাননি ধানের শীষ, ফেসবুকে তোলপাড়

Icon

জাগো বাংলা প্রতিবেদন

প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২৫, ০৬:২৭ পিএম

দুর্দিনের কান্ডারি দুই নেতা পাননি ধানের শীষ, ফেসবুকে তোলপাড়

২৩৭ টি আসনে একক প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আগেভাগে এই প্রার্থী ঘোষণা বিএনপিকে ভোটের মাঠে এগিয়ে রাখবে।মনোনয়নকে কেন্দ্র করে দলের কোন্দলও কমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। এবারের প্রার্থী বাছাইয়ে নবীন-প্রবীণের সমন্বয় ঘটেছে। এক পরিবারে একাধিক যোগ্য প্রার্থী থাকলেও একজনকেই মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে; যেটি নিয়ে প্রশংসা হচ্ছে।

তবে ঘোষিত প্রার্থীদের প্রাথমিক তালিকায় দেখা গেছে, এবার মনোনয়ন পাননি দলটির বেশ কয়েকজন হেভিওয়েট নেতা। বিএনপির ত্যাগীদের মধ্যেও অনেকে ধানের শীষ পাননি। সবকিছু ছাপিয়ে গেছে দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ দুজন নেতার মনোনয়ন না পাওয়ার ঘটনা। তারা হলেন—বিএনপির দুর্দিনের কান্ডারি সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও সবচেয়ে বেশি মামলার আসামি পরীক্ষিত নেতা দলের যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল।

রিজভী ও সোহেলের মনোনয়ন না পাওয়ার ঘটনা অবাক করেছে বিএনপির অনেককেই।আক্ষরিক অর্থেই নিজের জীবনের চেয়েও দলকে ভালোবাসা এই দুই নেতার নাম নেই ২৩৭ জনের তালিকায়, এটি যেন চিন্তারও বাইরে ছিলে বিএনপির লাখো নেতাকর্মীর। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এ নিয়ে তুমুল সমালোচনা হচ্ছে। বিএনপির বহু নেতাকর্মী এ নিয়ে ক্ষোভ ঝেড়েছেন ফেসবুকে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন—বিএনপির মনোনয়ন পাওয়ার জন্য আর কত পরীক্ষা দেওয়া লাগবে। আর কত ত্যাগী হলে ধানের শীযের যোগ্য হওয়া যাবে। 

আরও পড়ুন
যদিও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সোমবারের সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন—এটি প্রাথমিক তালিকা। দল চাইলে এই তালিকায় রদবদল আনতে পারে।     

জানা গেছে, বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর সমর্থক ও দলের নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা ভেবেছিলেন যে, মনোনয়ন না চাইলেও তাকে ধানের শীষ দেবে বিএনপি।জিয়া পরিবারের প্রতি আনুগত্য, দলের প্রতি ত্যাগের মূল্যায়ন নিশ্চয়ই বিএনপির হাইকমান্ড করবে।

কুড়িগ্রাম-২, রাজশাহী-৫, বগুড়া কিংবা ঢাকার কোনো একটি আসনে তার মনোনয়ন আশা করেছিলেন তার সমর্থকরা। সংশ্লিষ্ট এলাকায়ও এ নিয়ে জোর আলোচনা হচ্ছিল। কুড়িগ্রাম তার জন্মভূমি, আর রাজশাহী তার রাজনীতি ও বেড়ে উঠার তীর্থভূমি। সেখানকার বিএনপি কর্মীরা ধরেই নিয়েছিল যে, রিজভীর মনোনয়ন নিশ্চিত। ঘোষিত তালিকায় কুড়িগ্রাম-২ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন সোহেল হোসেন কায়কোবাদ। আর রাজশাহী-৫ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন বিএনপি চেয়ারপাসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু।২৩৭ টি ঘোষিত আসনের কোনোটিতেই নেই রিজভীর নাম।

বিএনপি বেশ কয়েকজন নেতা যুগান্তরকে ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, রুহুল কবির রিজভীর দলের জন্য ত্যাগ ও জিয়া পরিবারের প্রতি আনুগত্যের মূল্যায়ন করা উচিত।

ফেসবুকে অনেকে  রিজভীর গ্রেফতার ও মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়ার ছবি পোস্ট করে, দলের প্রতি তার ডেডিকেশন থাকার পরও মনোনয়নে মূল্যায়িত না হওয়ার সমালোচনা করেন। 

রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই রুহুল কবির রিজভী ছিলেন আলোচনায়। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের প্রচার সম্পাদক, পরে সাধারণ সম্পাদক, রাজশাহী ছাত্রদলের নেতৃত্বে ও কেন্দ্রীয় সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৮৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনে সহ-সভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন তরুণ রিজভী। সে সময় স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন রিজভী। এসময় গুলিবিদ্ধও হন তিনি। 

আরও পড়ুন
ছাত্ররাজনীতির পর জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের রাজনীতিতে যুক্ত হন রিজভী। তিনি স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি পদে ছিলেন। সেখানেও সফলতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন।

বিএনপির কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার পর থেকে রুহুল কবির রিজভী দলীয় মুখপাত্র ও আন্দোলন-সংগ্রামের সামনের সারির নেতা হিসেবে পরিচিতি পান। দীর্ঘদিন ধরে তিনি দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

আওয়ামী লীগ শাসনকালে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার বিএনপি নেতাদের একজন রুহুল কবির রিজভী। তার নামে ১৮০ টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় রিজভী বহুবার গ্রেফতার হয়েছেন। রিমান্ডে নিয়ে তাকে অমানসিক নির্যাতন করা হয়েছে। কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সবশেষ চব্বিশের জুলাই বিপ্লবের আগমুহূর্তেও রিজভীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। 

আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় যখন পুলিশ ও ডিবি সদস্যদের দ্বারা ঘেরা থাকত, তখনও রিজভী কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দিতেন। তার নেতৃত্বে ঢাকায় প্রতিবাদী মিছিল হতো প্রায়ই। আত্মগোপনে থেকেও রিজভী কর্মসূচি চালিয়ে যেতেন। কেন্দ্রীয় দফতরের দায়িত্ব থাকায় একবার কার্যালয়ে তিনি অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। বহুদিন কার্যালয়ে অবস্থান করেই দলের কর্মসূচি ঘোষণা করতেন।

বিএনপি একাদশ সংসদ নির্বাচনে গেলেও রিজভী ঘোষণা দিয়ে ভোট থেকে দূরে থাকেন। তিনি বলেছিলেন—খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে তিনি কোনো নির্বাচনে অংশ নেবেন না।

দলের সর্বশেষ ঘোষিত প্রাথমিক প্রার্থী তালিকায় রিজভীর নাম না থাকায় বিএনপি বা রিজভী আহমেদের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে দলীয় সূত্র বলছে, এটি কেবল প্রাথমিক তালিকা; প্রয়োজন হলে এতে পরিবর্তন বা সংযোজন আসতে পারে বলে জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

সবচেয়ে বেশি মামলার আসামি হয়েও পাননি ধানের শীষ

বিএনপির নেতাকর্মীদের কাছে অন্যতম ত্যাগী ও মাঠের নেতা হিসেবে পরিচিত দলের যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল। হাসিনা সরকারের সময়ে বিরোধী দলীয় নেতাদের ধরপাকড় শুরু হলেই টার্গেট থাকতেন সোহেল। তিনি ছিলেন ফ্যাসিবাদের আতঙ্ক।দলীয় কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে কতবার যে জেল খেটেছেন তার কোনো হিসেব নেই। আপোষহীন মনোভাব সোহেলকে বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীদের কাছে আলাদা পরিচিতি এনে দিয়েছে।  

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সোহেলের বিরুদ্ধে বর্তমানে সারাদেশে সাড়ে চার শতাধিক মামলা রয়েছে—যা তাকে বিএনপির ‘সর্বাধিক রাজনৈতিক মামলার আসামির অবস্থানে রেখেছে। আওয়ামী লীগ আমলে শুক্র-শনিবার বাদে সপ্তাহের বাকি দিনগুলো তার কাটত আদালতের বারান্দায়। এ বিষয়ে হাবিব উন নবী খান এর আগে যুগান্তরকে বলেছিলেন—৪৫১টি মামলার আসামি হয়ে আদালতের বারান্দায় দিন কাটাই। মাসের ৩০ দিনের ২০/২২ দিনই হাজিরা থাকে। হয় পুরান ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট বা জজ কোর্টে অথবা রমনার হাইকোর্টে। মাঝে যে ২/৪ দিন সময় পাই সেদিন ঈদ ঈদ মনে হয়। কোর্ট থাকা মানে ওই দিন কমপক্ষে ৬/৭টি মামলায় হাজির। এখন চাকরিজীবীদের অফিসে যাওয়ার মতোই সকাল সোয়া ৮টায় উঠে ১০টার মধ্যে আদালতে থাকতে হয়। মামলার খড়গ নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘এমনও হয় সকালে এক কোর্টে গিয়েছি, সেখান থেকেই আরও ৪/৫টা কোর্টে এক সঙ্গে ডাক পড়ে। কোনটা রেখে কোনটায় যাব, এই কোর্ট থেকে সেই কোর্ট করতে করতে নাভিশ্বাস অবস্থা। তখন ভাবি আমার মতো মধ্য পর্যায়ের নেতার এই অবস্থা হলে, দলের নিচের দিকে নেতা বা কর্মীর কী চরম ভোগান্তি হচ্ছে। জেলা বা ইউনিয়ন নেতাদের কথা না-ই বললাম।’

আরও পড়ুন
বিদেশে থাকা বন্ধুরা মামলার তথ্য পাঠাতে বলেছেন এ কথা জানিয়ে এই নেতা বলেছিলেন, ‘তারা নাকি গিনেজ বুক রেকর্ডে আবেদন করবে। যদি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মামলা খাওয়া ব্যক্তি হওয়া যায়। কিন্তু বিভিন্ন কোর্ট থেকে মামলার কাগজ উঠাতে যে টাকা দরকার তা তো আমার কাছে নেই।’

তবে এবার মনোনয়নের তালিকায় সোহেলের নাম না থাকায় অনেক নেতা-কর্মী বিস্মিত হয়েছেন। দলের এই সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে বিএনপির ভেতরে-বাইরে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে। তৃণমূলের অনেকেই মনে করছেন, একজন ‘নির্যাতিত ও ত্যাগী’ নেতার মূল্যায়ন না হওয়া বিএনপির জন্য নেতিবাচক বার্তা হতে পারে। 

মাসুদ নামে ঢাকার এক বিএনপির এক নেতা বলেন, সোহেল ভাই আন্দোলনের দিনগুলোতে মাঠে ছিলেন, আমরা সবাই জানি তার ভূমিকার কথা। এমন একজন নেতাকে বাদ দেওয়া অনেকের কাছেই বেদনাদায়ক।

হাবিব উন নবী খান সোহেল ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তার নেতৃত্বে স্বেচ্ছাসেবক দল সারাদেশে প্রাণ ফিরে পায়। পরবর্তীতে তিনি অবিভক্ত ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব পদে ছিলেন। এরপর ঢাকা দুই ভাগ হয়ে গেলে সোহেল ঢাকা দক্ষিণের সভাপতি হন। বর্তমানে এই নেতা বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব পদে রয়েছেন।

হাবিব উন নবী খান সোহেল ঢাকা-৮ আসন থেকে একবার বিএনপির মনোনয়ন নিয়ে ভোট করেন। এবার ঢাকা-৮ কিংবা ঢাকা-৯ আসন থেকে তাকে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে বলে ধরে নিয়েছিল তার সমর্থকরা। শেষ পর্যন্ত ঢাকা-৮ আসনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। আর ঢাকা-১০ আসনটি ফাঁকা রাখা হয়।

হাবিব উন নবী খান সোহেল নিজে এ বিষয়ে গণমাধ্যমে সরাসরি কিছু না বললেও তার ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন, তিনি (সোহেল) দলের যেকোনো সিদ্ধান্ত মেনে নেবেন।

বিএনপি নেতাকর্মীরা আশা করছেন, দ্বিতীয় প্রার্থী তালিকায় এ দুজনের নাম থাকতে পারে।

হেভিওয়েট আরও যারা বাদ পড়েছেন

স্থায়ী কমিটির নেতাদের মধ্যে ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, নজরুল ইসলাম খানের পাশাপাশি সেলিমা রহমান প্রথম দফার তালিকায় নেই। এছাড়া ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জমান রিপন, শামসুজ্জামান দুদু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, আব্দুস সালাম আজাদ, সহ-আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক রুমিন ফারহানা, সহদপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু, সহঅর্থনৈতিক বিষয়ক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান সুমন, স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সহসম্পাদক আব্দুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল, নির্বাহী কমিটির সদস্য নাজিমউদ্দিন আলমসহ আরো বেশ কয়েকজন হেভিওয়েট কেন্দ্রীয় নেতা মনোনয়ন পাননি। প্রথম দফার প্রার্থী তালিকায় নেই আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিষ্টার নাসির উদ্দিন আহমেদ অসীমেরও নাম। 

প্রসঙ্গত, সোমবার গুলশান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব ২৩৭ টি আসনে দলের প্রার্থী ঘোষণা করেন। বাকি ৬৩ আসনে মিত্র ও দলের প্রার্থী দেওয়া হবে বলে ইঙ্গিত দেন তিনি। মঙ্গলবার সকালে এক ফেসবুক পোস্টে মির্জা ফখরুল জানান, এটি তার শেষ নির্বাচন। যারা মনোনয়ন পাননি তাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, যারা মনোনয়ন পাননি, বিশ্বাস রাখুন, ইনশাআল্লাহ দল আপনাদের যথাযথ দায়িত্ব ও সম্মান দেবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: মহিউদ্দিন সরকার