Logo
Logo
×

মতামত

তারেক রহমানের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা কেন প্রয়োজন

Icon

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০২:০৮ এএম

তারেক রহমানের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা কেন প্রয়োজন

বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি জনগণের ভালোবাসাই তাঁর প্রতি মহান আল্লাহর অসীম অনুগ্রহ। তাঁর দল বিএনপির প্রতিও যে জনগণের ভালোবাসা, তা স্বৈরাচারী এরশাদের পতন ও জনগণের অধিকার আদায়ে তাঁর আপসহীন ভূমিকার কারণে। দুই দশক আগে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর ফখরুদ্দীন-মইন উদ্দিন এবং শেখ হাসিনার মতো স্বেচ্ছাচারী কবলিত বাংলাদেশে বেগম খালেদা জিয়াকে কারান্তরালে রেখে তাঁকে কলঙ্কিত করার জন্য নানা অভিযোগ এনে, অপবাদ দিয়ে ও বিদ্রুপ করার পরও তাঁকে মানুষের হৃদয় থেকে মুছে ফেলা যায়নি।

খালেদা জিয়াকে সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করার পর থেকে দেশজুড়ে মানুষের ব্যাকুলতা, কান্না এবং তাঁর রোগমুক্তির জন্য আল্লাহর দরবারে হাত তুলে দোয়া করার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়, জনগণ তাঁকে কতটা ভালোবাসে। জনগণ কেন তাঁকে এত ভালোবাসে? ১৯৯১ সালে দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের পর পরবর্তী পাঁচ বছর তিনি লোভলালসার ঊর্ধ্বে উঠে দায়িত্ব পালন করেছেন। জনগণ তাঁর মাঝে এক দশক আগে চক্রান্তকারীদের হাতে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়ার প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছিল। তথাকথিত ওয়ান-ইলেভেনে আসা ফখরুদ্দীন-মইন উদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাঁকে হুমকি দিয়ে দেশ থেকে বের করে দিতে চেষ্টা করলে তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘আমি দেশ ছেড়ে, দেশের মানুষকে ছেড়ে কোথাও যাব না। এই দেশই আমার একমাত্র ঠিকানা। দেশের বাইরে আমার কিছু নেই, কোনো ঠিকানাও নেই।’ জনগণ কী বেগম খালেদা জিয়াকে ভালোবাসবে, না কি দেশে সামান্য ব্যক্তিগত বিপদ দেখলেই যারা পাশের দেশে গিয়ে, ‘মেরা ভারত মহান’ স্লোগানের সঙ্গে সুর মেলাবে তাদের ভালোবাসবে?

বেগম খালেদা জিয়ার অবস্থা এখনো সংকটজনক এবং তিনি ঝুঁকিমুক্ত নন। এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করার পর থেকে তাঁর স্বাস্থ্যের অব্যাহত অবনতির খবরের মধ্যে গত শুক্রবার তাঁর চিকিৎসায় নিয়োজিত মেডিকেল বোর্ড আশার কথা শুনিয়েছে, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় তাঁর বুকে জমে থাকা কফ পরিষ্কার হচ্ছে। তবে তাঁর হৃদযন্ত্র, লিভার, কিডনি ও ফুসফুসের জটিলতা কাটছে না। একটির সামান্য উন্নতি হলে অন্যটির অবনতি ঘটছে। চিকিৎসকরা আশাবাদী যে তাঁরা খালেদা জিয়াকে যে চিকিৎসা দিচ্ছেন, তিনি তা গ্রহণ করতে পারছেন এবং ওষুধ কাজ করছে। মেডিকেল বোর্ডের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে লন্ডনে নেওয়া। সবকিছু ঠিক থাকলে তাঁকে নিয়ে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করবে। তিনি সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে না আসা পর্যন্ত জনগণ অধীর আগ্রহে তাঁর জন্য অপেক্ষা করবে।

গত বুধবার আমি আমার এক লেখায় বেগম খালেদা জিয়ার গুরুতর শারীরিক অবস্থা এবং তিনি যখন জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন, সে অবস্থায় তাঁর একমাত্র জীবিত সন্তান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মায়ের পাশে থাকার আবশ্যকতার কথা বলি এবং জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে দলের শীর্ষ নেতা হিসেবে দেশ থেকে তাঁর অনুপস্থিতি বা দেশে না ফেরার কারণ এবং জাতিকে সংকট থেকে উত্তরণে তাঁর ভূমিকা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে সংশয় ব্যক্ত করি।

বিএনপি মিডিয়া টিম প্রেস-এর দায়িত্বে নিয়োজিত সালেহ শিবলী লন্ডন থেকে আমাকে বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসা-সম্পর্কিত বন্দোবস্তের আপডেট দেন এবং তারেক রহমানের দেশে ফেরা, বা বিলম্ব হওয়ার কারণ নিয়ে মিডিয়ায় নানামুখী বক্তব্যে বিভ্রান্তি রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন। তাঁর নিরাপত্তার উদ্বেগই দেশে দ্রুত না ফেরার কারণ কি না, জানতে চাইলে শিবলী বলেন যে নিরাপত্তার বিষয়টি অবশ্যই একটি কারণ, তবে মুখ্য কারণ নয়। বেগম খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করার পর থেকেই তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে গুঞ্জন এবং বাংলাদেশের মিডিয়ায় প্রাত্যহিক প্রধান খবর উঠলে তারেক রহমান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি তাঁর দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত ‘একক নিয়ন্ত্রণাধীন নয়’ বলে উল্লেখ করার পর অনেকে বলেছেন, তাঁর দেশে না ফেরার অন্যতম কারণ নিরাপত্তাহীনতা।

এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকেও জানানো হয়েছে যে তারেক রহমানের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। বাংলাদেশে প্রবেশের পর বিমানবন্দর থেকে তিনি স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) নিরাপত্তাও পেতে পারেন। এ ব্যাপারে সরকার সময়মতো সিদ্ধান্ত নেবে। বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বা সমমর্যাদার ব্যক্তিরা এসএসএফের নিরাপত্তা পেয়ে থাকেন। সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে রাষ্ট্রের ‘অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ ঘোষণা করে তাঁকে এসএসএফের নিরাপত্তা দিয়েছে সরকার। গোয়েন্দা সূত্রও নিশ্চিত করেছে যে তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে কোনো নিরাপত্তাশঙ্কা নেই, তাঁর ব্যক্তিগত কোনো নিরাপত্তাশঙ্কাও নেই। তিনি সর্বোচ্চ নিরাপত্তা পাবেন।

সরকার হয়তো তারেক রহমানের ‘সর্বোচ্চ’ নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বা নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। শর্ষের মাঝেও ভূত থাকে। ১৯৮৭ সালের জুলাই মাসে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে গার্ড পরিদর্শনের সময় লাইন থেকে ছুটে এসে রাইফেল দিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর কাঁধে সজোরে আঘাত করেছিল শ্রীলঙ্কার নৌবাহিনীর এক সদস্য। কার মনে কী থাকে তা স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কারও জানার কথা নয়। ‘এসএসএফ’-এর নিরাপত্তাবেষ্টনীতে থাকা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থাকা ব্যক্তিদের বাইরে এখন দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দেশে তাঁর অনুরাগীও আছে, যারা তাঁর জন্য জীবন দিতেও যেমন প্রস্তুত, তাঁর প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী লোকজনও আছে, যারা তাঁর ক্ষতিসাধন করতে ওত পেতে থাকবে এটাই স্বাভাবিক।

ওয়ান-ইলেভেনের সরকার আমলে কারা নিষ্ঠুর আক্রোশে তাঁর ওপর অবর্ণনীয় শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে প্রায় পঙ্গু করে ফেলেছিল, সে কাহিনি কমবেশি সবার জানা। অতএব সব বিবেচনায় তারেক রহমানের দেশে ফেরার ও নিরাপদে চলাফেরা এবং নিঃশঙ্কচিত্তে নির্বাচনি অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে পারে, যা কারও কাম্য নয়। সবাই এখন নির্বাচন চায়, যাতে অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকার আর কালক্ষেপণ না করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সসম্মানে বিদায় নিতে পারে।

অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটতে সময় লাগে না। চোখের পলকে অঘটন ঘটে যায়। পাঠকদের ১৯৮৩ সালের ২১ আগস্ট ফিলিপাইনে সহস্রাধিক সেনা ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যের নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা ম্যানিলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান থেকে অবতরণ করা মাত্র ঘাতকের গুলিতে বিরোধী দলের নেতা সিনেটর বেনিগনো অ্যাকুইনোকে হত্যা করার ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেব। অ্যাকুইনো ছিলেন ওই সময়ের ফিলিপাইনে প্রচণ্ড ক্ষমতার অধিকারী প্রেসিডেন্ট মার্কোসের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ও কট্টর সমালোচক। তিন বছর যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছা-নির্বাসনে থাকার পর তিনি দেশে ফিরে আসছিলেন পরের বছর সম্ভাব্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার উদ্দেশ্যে। তাঁর দেশে ফেরা নিয়ে ফিলিপাইনে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। বিমানে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় তাঁর জীবনের ওপর ঝুঁকি রয়েছে, তা সত্ত্বেও যে তিনি দেশে ফিরে যাচ্ছেন- এ সম্পর্কে বলেন, “আমি আমার বিপদ সম্পর্কে সচেতন। কারণ আপনারা জানেন, হত্যাকাণ্ড ফিলিপাইনে ‘পাবলিক সার্ভিস’-এর অংশ। ঘাতকের একটি গুলিতে যদি আমার মৃত্যু হয়, তবে তাই হোক।”

অ্যাকুইনোকে বহনকারী বিমান ম্যানিলা বিমানবন্দরে অবতরণ করলে সৈন্যরা বিমানে প্রবেশ করে তাঁকে আটক করে এবং তাদের প্রহরায় বিমান থেকে নামিয়ে তাঁকে কারাগারে নিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ গাড়ির দিকে নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে ঘাতক। সৈন্যরা সতর্ক হওয়ার আগেই তারা অ্যাকুইনোকে রানওয়ের টারমাকে রক্তের মাঝে পড়ে থাকতে দেখেন। সেনা বেষ্টনীর মধ্যেই ঘাতকের আগ্নেয়াস্ত্র থেকে নিক্ষিপ্ত একটি মাত্র গুলি অ্যাকুইনোর মাথায় বিদ্ধ হয়েছিল। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। সৈন্যদের গুলিতে তাঁর ঘাতকও প্রাণ হারায়। প্রেসিডেন্ট মার্কোস তাঁর বিবৃতিতে বলেন, ঘাতক ছিল ‘পেশাদার খুনি’। এমন শার্প শুটার কি বাংলাদেশে নেই? বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর ও লেখক কয়েক বছর আগে গুলি চালিয়ে তাঁর লক্ষ্যভেদ করার দক্ষতা সম্পর্কে এক ফেসবুক পোস্টে যা উল্লেখ করেছিলেন, তা মোটামুটি এমন, ‘শুধু বলতে হবে কোন বিচিতে গুলি করতে হবে।’ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিকদের জন্য লক্ষ্যভেদ করা কোনো ব্যাপারই নয়। কিছু সন্ত্রাসী, পেশাদার খুনি আছে, যারা লক্ষ্য ভেদ করতে সমান পারঙ্গম। দেশে অবৈধ স্নাইপার গানেরও ছড়াছড়ি। অতএব বাংলাদেশে তারেক রহমানের জীবনের ওপর সম্ভাব্য প্রতিটি আশঙ্কা দূর করা জরুরি।

বাংলাদেশের জনগণের সামনে এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ভিড়, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বেগম খালেদা জিয়ার সুস্থতা, তারেক রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তন এবং মাত্র দুই মাস পর অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনকে বিঘ্নিত, এমনকি ব্যাহত করার উদ্দেশ্যে ভারতে পলাতক, মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি শেখ হাসিনার উসকানিতে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো যে তাদের নাশকতামূলক তৎপরতা চালানোর প্রাণপণ চেষ্টা চালাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তারা যাতে তা না করতে পারে, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে আওয়ামী লীগের নাশকতার অপচেষ্টা আগেভাগেই বানচাল করতে হবে। এ ছাড়া অন্য কোনো ইস্যুকে নির্বাচনের সঙ্গে জড়িয়ে যাতে নির্বাচনের তারিখ পেছানোর মতো প্রশ্ন উঠতে না পারে, সে সম্পর্কেও সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

লেখক : যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: মহিউদ্দিন সরকার