Logo
Logo
×

মতামত

সুদি কারবারির সঙ্গে অন্য কোনো বৈধ ব্যবসা করা যাবে কি?

Icon

লাইফস্টাইল ডেস্ক

প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০২৫, ০২:০৬ পিএম

সুদি কারবারির সঙ্গে অন্য কোনো বৈধ ব্যবসা করা যাবে কি?

বাণিজ্য মানব সভ্যতার অন্যতম প্রাচীন সম্পর্ক। এটি কেবল অর্থনৈতিক বিনিময় নয়, বরং নৈতিকতা, বিশ্বাস ও দায়িত্ববোধের এক সেতুবন্ধন। 

ইসলামে বাণিজ্যকে শুধু অনুমোদিতই করা হয়নি, বরং তা উৎসাহিত করা হয়েছে শর্ত একটাই, লেনদেন হতে হবে ন্যায়সঙ্গত, স্বচ্ছ ও হারাম থেকে মুক্ত। 

কিন্তু প্রশ্নটি যখন এমন হয় ‘একজন সুদি কারবারির সঙ্গে বৈধ কোনো ব্যবসা করা যাবে কি?’ তখন বিষয়টি কেবল অর্থনৈতিক নয়, বরং ধর্মীয় নীতিশাস্ত্রেরও অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। 

ইসলামী শরীয়তের মূলনীতি একেবারে পরিষ্কার। কুরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন, আর সুদকে হারাম করেছেন।’ (সুরা আল-বাকারা, আয়াত ২৭৫

অর্থাৎ, বাণিজ্য বৈধ, কিন্তু সুদভিত্তিক লেনদেন (রিবা) সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তাই কোনো মুসলমান এমন ব্যবসায় অংশ নিতে পারে না, যেখানে সুদ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখে। 

তবে বাস্তব জীবনের প্রশ্নটি একটু সূক্ষ্ম। ধরুন, কেউ একজন এমন ব্যবসায়ী, যিনি ব্যাংক বা আর্থিক খাতে সুদভিত্তিক লেনদেনে যুক্ত, কিন্তু পাশাপাশি খাদ্য, নির্মাণ, পোশাক বা প্রযুক্তির মতো বৈধ ব্যবসাও করেন। 

তাহলে কি মুসলমান হিসেবে তার সেই বৈধ ব্যবসায় অংশ নেওয়া, পণ্য বিক্রি করা বা ক্রয় করা নিষিদ্ধ হবে?

শরীয়তের দৃষ্টিতে অনুমোদন ও সীমারেখা  

ফিকহশাস্ত্রের আলোকে এর উত্তর একক নয়, বরং প্রসঙ্গনির্ভর। ইসলামী বিধান বলে যদি কোনো প্রতিষ্ঠানের মূল ব্যবসা হারামের ওপর নির্ভর করে, যেমন সুদ, মদ, জুয়া বা প্রতারণা, তবে সেই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোনোভাবে সহযোগিতা করা জায়েজ নয়। 

কিন্তু যদি তার মূল ব্যবসা বৈধ হয়, আর সুদভিত্তিক অংশ গৌণ বা আনুষঙ্গিক হয়, তাহলে লেনদেনের বিষয়টি ‘শর্তসাপেক্ষে বৈধ’ হতে পারে। 

ইমাম ইবনে বাজ রহ. এই বিষয়ে বলেছেন, ‘যদি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কিছু কাজ হারাম হয়, কিন্তু তার সঙ্গে তোমার লেনদেন কেবল বৈধ বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে তোমার সেই লেনদেন হারাম নয়।’ (মাজমু ফাতাওয়া ইবনে বাজ, খণ্ড ১৯

একই দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করেছেন শায়খ সালিহ আল-ফাওযান। তার মতে, ‘একজন মুসলমান বৈধ বিষয়ে কোনো সুদি ব্যবসায়ীর সঙ্গে লেনদেন করতে পারেন, তবে তিনি যেন হারাম লেনদেনে সহযোগী না হন।’

অন্যদিকে, হানাফি ও শাফেয়ি মাযহাবের বিশিষ্ট ইমামরা আরও সতর্ক অবস্থান নিয়েছেন। তাদের মতে, এমন যেকোনো সম্পর্ক, যা হারাম কার্যক্রমকে পরোক্ষভাবে সমর্থন করে বা শক্তি জোগায়, তা থেকেও বিরত থাকা উচিত। 

কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, পাপ ও সীমালঙ্ঘনের কাজে সহযোগিতা করো না। (সুরা আল-মায়িদা, আয়াত ২

অর্থাৎ, তুমি যদি জানো যে তোমার অর্থ, শ্রম বা লেনদেনের মাধ্যমে সুদের কারবারকে শক্তি দেওয়া হচ্ছে, তাহলে সেই সম্পর্ক শরীয়তের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। 

আজকের বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এ প্রশ্ন আরও জটিল হয়ে উঠেছে। প্রায় প্রতিটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠান কোনো না কোনোভাবে ব্যাংক, ঋণ বা সুদভিত্তিক আর্থিক কাঠামোর সঙ্গে জড়িত। 

এই বাস্তবতায় ইসলামী ফিকহ ‘দরুরা’ বা অপরিহার্যতার নীতি প্রবর্তন করেছে। এর মর্মার্থ হলো যেখানে হারাম থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকা বাস্তবভাবে অসম্ভব, সেখানে মুসলমান যতটুকু সম্ভব সতর্ক থাকবে এবং নিজের লেনদেনকে হারাম অংশ থেকে আলাদা রাখবে। 

ইসলামিক ফিকহ একাডেমি (OIC Fiqh Academy) ২০০৬ সালের এক ঘোষণায় বলেছে, ‘যদি কোনো মুসলিম এমন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসা করে যা আংশিকভাবে সুদভিত্তিক, তবে সে নিজ অংশে রিবার কোনো অংশ রাখতে পারবে না, এবং চুক্তি হতে হবে পরিষ্কার ও স্বচ্ছ।’

এই ব্যাখ্যা থেকে স্পষ্ট হয় সুদি কারবারির সঙ্গে বৈধ ব্যবসা করা সরাসরি হারাম নয়, তবে তা শর্তসাপেক্ষ। লেনদেনের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য হালাল হতে হবে, চুক্তি হতে হবে ন্যায়সংগত, এবং কোনোভাবেই সেই ব্যবসার মাধ্যমে সুদভিত্তিক কার্যক্রমকে সহায়তা করা যাবে না। 

ইসলামী অর্থনীতি কেবল মুনাফা অর্জনের শিক্ষা দেয় না, এটি নৈতিকতার দিকেও আহ্বান জানায়। শরীয়তের বাণিজ্যনীতি মূলত ‘ন্যায্যতার’ নীতিতে দাঁড়িয়ে যেখানে প্রতিটি লেনদেন আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম। তাই একজন প্রকৃত মুসলমানের জন্য ব্যবসা মানে কেবল লাভ নয়, বরং সততা ও দায়িত্বের প্রতিশ্রুতি রক্ষা। 

এই বাস্তবতায় বলা যায়, সুদি কারবারির সঙ্গে বৈধ ব্যবসা করা ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে মূলত নিষিদ্ধ নয়, কিন্তু তা করতে হলে সচেতনতা, সতর্কতা এবং ঈমানদারিত্বের ভারসাম্য বজায় রাখা আবশ্যক। 

কারণ ইসলাম যে সমাজ গড়তে চায়, সেটি কেবল অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী নয়, বরং নৈতিকভাবে বিশুদ্ধও।

লেখক: শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়,কায়রো, মিশর

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: মহিউদ্দিন সরকার