Logo
Logo
×

জাতীয়

আততায়ী ‘পেশাদার শ্যুটার’, হাদির সঙ্গেই ছিলেন?

Icon

জাগো বাংলা প্রতিবেদন

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৬:৩৭ এএম

আততায়ী ‘পেশাদার শ্যুটার’, হাদির সঙ্গেই ছিলেন?

ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরীফ ওসমান বিন হাদির ওপর হামলাকারী কারা? তাদের কী শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে?

ঢাকার পল্টনে বক্স কালভার্ট এলাকায় শুক্রবার জুমার নামাজের পর হাদিকে গুলি করার কয়েক ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও পুলিশ তার আততায়ীকে শনাক্ত করার বিষয়ে কোনো তথ্য দেয়নি।

তবে হামলাকারী হাদির সঙ্গে তার নির্বাচনি প্রচারে ছিলেন বলে সতীর্থরা মনে করছেন।

তাদের তোলা প্রচারের কিছু ছবিতে থাকা দুইজনকে তারা ‘আততায়ী’ হিসেবে সন্দেহ করছেন।

রাতে আইজিপি মো. বাহারুল আলম বলেন, তার ধারণা নির্বাচনে নেতিবাচক ‘প্রভাব ফেলতেই’ এই হামলার ঘটনা ঘটানো হয়েছে।

হাদির ওপর হামলার ঘটনার তদন্তের অগ্রগতি বিষয়ে জানতে চাইলে আইজিপি বলেন, “অগ্রগতি আমরা এই মুহূর্তে বলছি না। আমরা কাজ করছি। এবং বিফল হবো না।”

আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি ভোটগ্রহণের দিন রেখে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণা করেন।

পরদিনই নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থী জুলাই আন্দোলন ও আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলনের পরিচিত মুখ হাদির ওপর হামলা হল।

আগেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মতিঝিল, শাহজাহানপুর, পল্টন, রমনা ও শাহবাগ থানা এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকা-৮ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়েছিলেন হাদি। সেজন্য প্রতি শুক্রবারে তিনি জনসংযোগ করতেন।

এই শুক্রবার দুপুরে মতিঝিলের একটি মসজিদে সেরকম একটি প্রচার শেষে সতীর্থদের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজের জন্য ব্যাটারি রিকশায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে যাচ্ছিলেন তিনি।

চলন্ত রিকশায় থাকা অবস্থাতেই মোটরসাইকেলের পেছনে বসা আততীয় তাকে লক্ষ্য করে একটি গুলি ছোড়ে, যেটি তার মাথায় লাগে।

গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর হাদিকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে মস্তিস্কে একটি অস্ত্রপচার শেষে খুলি খুলে রেখে তাকে পাঠানো হয় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় অবস্থিত এভারকেয়ার হাসপাতালে। হাদির জীবন সংকটাপন্ন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।

ডিএমপির জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, “জুমার নামাজের পর বেলা ২টা ২৫ মিনিটে বিজয়নগর বক্স কালভার্ট এলাকায় মোটরসাইকেলে আসা হামলাকারীরা হাদিকে গুলি করে পালিয়ে যায়।”

জুমার নামাজের পর মসজিদে তাদের লিফলেট বিলি কর্মসূচি শেষে হাদি তার সব অনুসারীকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসতে বলেছিলেন।

তাদের একজন বলছিলেন, কথা ছিল লিফলেট বিলি শেষে সবাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জড়ো হয়ে দুপুরের খাবার খাবেন, আলোচনা করবেন। এর মধ্যেই হাদির ওপর হামলার খবর আসে।

হাদির সঙ্গে থাকা একজন বলেন, বিজয়নগরে রিকশাটি আসার পর ডান পাশ থেকে গুলি করেন মোটরসাইকেলের পেছনে বসা একজন। গুলির ধাক্কায় হাদি রিকশা থেকে পড়ে যান। এরপর মোটরাসাইকেলটি পালিয়ে যায়, তারা হাদিকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে আসেন।

চলন্ত অবস্থায় এক গুলিতে লক্ষ্যভেদ

গুলির ঘটনার একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, হাদিকে বহনকারী ব্যাটারিচালিত রিকশাটি বক্স কালভার্ট সড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় একটি হোন্ডা হর্নেট (১৬০ সিবিএস) মোটরসাইকেল তার অনেকটা পাশ ঘেঁষে চলতে থাকে। রিকশাটির একেবারে কাছে মোটরসাইকেল আরোহী অস্ত্র বের করে গুলি করেন। মোটরসাইকেলটির নম্বর বোঝা যায়নি প্রকাশিত ভিডিওগুলোতে।

শুক্রবার ছুটির দুপুরে রাস্তায় যান চলাচল ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে বেশ কম। ফাঁকা রাস্তায় মোটরসাইকেলটি দ্রুতবেগে পালিয়ে যায়।

ঢাকা মেডিকেলে হাদির সতর্থীরা বলেছেন, একটি গুলিই করেছে, যেটি হাদির মাথায় লেগেছে।

পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ বলেন, পল্টন থানার বক্স কালভার্ট রোডের ডিআর টাওয়ারের সামনে গুলি করা হয়। কারা কী কারণে তাকে গুলি করেছে, তা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। “আমরা অপরাধীদের শনাক্তে কাজ করছি।” ঘটনাস্থলে একটি গুলির খোসা পাওয়ার কথা জানিয়েছে পুলিশ।

ডিআর টাওয়ারের প্রহরী আনসার সদস্য ইমরান হোসেন হৃদয় বলেন, চাকা ফেটে যাওয়ার মত একটি শব্দ তিনি শুনে ভবন থেকে বাইরে বের হন। দেখেন, রিকশার ওপর একজন আহত অবস্থায় পড়ে আছেন। অন্যরা তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন।

হাদিকে হাসপাতালে নিয়ে আসা একজন বলেন, তার কানের পাশে একটি গুলি করা হয়েছে। একই তথ্য দিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই শরীফুল ইসলামও।

একটি গুলিতে চলন্ত নিশানাকে আঘাত করার ঘটনাটিকে খুবই পেশাদার ‘শ্যুটারের’ কাজ হিসেবে দেখছেন প্রায় চার দশক ঢাকায় অপরাধ বিষয়ক সাংবাদিকতা করে আসা পারভেজ খান।

তিনি বলেন, “এরা অনেক পেশাদার শ্যুটার। অনেক সময় কাকতালীয় কিছু ঘটনাও ঘটে যায় অপরাধজগতে। তবে এটা সেরকম না।

“একটা চলন্ত মোটর সাইকেল থেকে আরেকটি চলন্ত যানে থাকা টার্গেটকে গুলি করে লক্ষ্যভেদ করা খুবই কঠিন কাজ। এই শ্যুটার সেই কাজটিই করেছে, তাও আবার একটি মাত্র গুলি খরচ করেই। পেশাদার শ্যুটার ছাড়া এটা সম্ভবই না।”

তার ভাষ্য, “অনেক সময় ‘নবিশ’ অপরাধীরা ছিনতাই বা অন্য কোনো অপরাধের সময় বেকায়দায় টার্গেটকে ছুরিকাঘাত করে বসে, যাতে টার্গেটের মৃত্যু ঘটে। এরকম ঘটনা অনেক দেখা গেছে। এটা এরকম কাকতালীয় ঘটনা নয়।”

আততায়ী ছিলেন হাদির সঙ্গেই

হাদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর থেকেই তার সতীর্থরা বলছিলেন, হামলাকারীদের ছবি তাদের কাছে রয়েছে। বিকালে তারা দুটো ছবি প্রকাশ করেন। মতিঝিল ওয়াপদা মসজিদ ও মাদ্রাসা এলাকায় লিফলেট বিলির সময় তোলা ওই দুটি ছবির একটিতে মাস্ক পরা একজনকে হাদির সঙ্গে বসে থাকতে দেখা যায়। আরেকটি ছবিতে গায়ে স্যুট, গলায় চাদর পরা আরেকজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। দুজনেই বয়সে বেশ তরুণ।

এদের ছবি দিয়ে হাদির ওপর হামলা ঘটনার সিসি ক্যামেরার ভিডিও ধরে তারা দাবি করছেন, এই দুজনই ‘আততায়ী’। এর মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে ছবিগুলো। মাস্ক পরিহিত ব্যক্তির ছবি থেকে ‘এআই’ ব্যবহার করে অনেকে সন্দেহভাজনের মুখচ্ছবি তৈরির চেষ্টাও করেছেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “ঘটনার সংবাদ পাওয়ার পর পরই পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এবং ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে জড়িতদের সনাক্ত ও গ্রেপ্তারে আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। থানা পুলিশের পাশাপাশি ডিবি সন্দেহভাজন ব্যক্তি ও স্থানগুলোতে তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছে।”

এই ঘটনায় নগরবাসীকে আতঙ্কিত না হয়ে ঘটনায় জড়িতদের সম্পর্কে কোনো তথ্য থাকলে তা কাছের থানা অথবা ৯৯৯ এর মাধ্যমে পুলিশকে জানানোর অনুরোধ করেছে ডিএমপি।

হাসপাতালে ভিড়

গুলিবিদ্ধ হওয়ার ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে হাদিকে ওই রিকশাতেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার কর্মী, সমর্থক, শুভানুধ্যায়ী আর সাংবাদিকরা ভিড় করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রাঙ্গণে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ডাকতে হয় সেনাবাহিনীকে।

ঢাকা মেডিকেলে একটি অস্ত্রপচারের পর সন্ধ্যা ৭টা ৩৫ মিনিটে একটি আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে বেসরকারি এভারকেয়ার হাসপাতালে পাঠানো হয়

‘জীবন সংকটে হাদি’

হাদিকে আঘাত করা গুলিটি মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে গেছে বলে ধারণা করছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মাথায় অস্ত্রোপচার চালানো চিকিৎসক অধ্যাপক জাহিদ রায়হান। তার অবস্থা খুবই খারাপ জানিয়ে অধ্যাপক জাহিদ বলছেন, “তার বিষয়ে আমরা কোনো আশার বলতে পারছি না।”

রাতে এভারকেয়ার হাসপাতালের চিকিৎসক জানিয়েছেন, তাকে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসে রাখা হয়েছে।

সন্দেহের বাইরে কেউ নয়

হাদির ওপর হামলার ঘটনায় ভোটের প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে শুরু করে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ— কাউকেই সন্দেহের বাইরে রাখছে না ইনকিলাব মঞ্চ।

শুক্রবার রাতে এক ব্রিফিংয়ে সংগঠনের সদস্য সচিব আব্দুল্লাহ আল জাবির বলেন, “আমরা কাউকে সন্দেহের চোখে দেখছি না; আবার কাউকে সন্দেহের বাইরেও রাখছি না। ভোটের রাজনীতিতে অনেকে ওসমান হাদিকে প্রতিপক্ষ মনে করতে পারে। এমন কারণেও হতে পারে।

“আবার এমনও হেতে পারে, যে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে, যে পতিত স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ওসমান হাদি বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর ছিল, তারা ভাবতে পারে, ওসমান হাদিকে মেরে ফেললে তারা আবার বাংলাদেশে ফিরে আসতে পারবে। আমরা জানিয়ে রাখি, ওসমান হাদি এখন ঘরে ঘরে তৈরি হয়েছে।”

এ ঘটনার দায় সরকারের ওপর চাপিয়ে তিনি বলেন, “যে সরকার হাদিকে রক্ষা করতে পারে না, সে বাংলাদেশকে কীভাবে রক্ষা করবে। আল্লাহ না করুক, ওসমান হাদির কিছু হলে অন্তর্বর্তী সরকারকে দায়ভার নিতে হবে।”

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: মহিউদ্দিন সরকার