Logo
Logo
×

জাতীয়

যে ভূমিকম্পে তছনছ হয়েছিল সিলেট

Icon

জাগো বাংলা প্রতিবেদন

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭:১৬ পিএম

যে ভূমিকম্পে তছনছ হয়েছিল সিলেট

১৮৯৭ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল সিলেট–আসাম অঞ্চল। শিলং প্ল্যাটোর নিচে থাকা বিশাল ওল্ডহ্যাম ফল্ট এক লাফে ১১–১৬ মিটার সরে যাওয়ায় সৃষ্টি হয়েছিল ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে অন্যতম শক্তিশালী ভূমিকম্প, যার মাত্রা ছিল ৮.২–৮.৩।

১৮৯৭ সালের ১২ জুন, বিকেল সাড়ে চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যে আচমকাই কেঁপে ওঠে গোটা উত্তর-পূর্ব ভারত। কোনো সতর্কবার্তা ছিল না, কোনো পূর্বাভাস ছিল না মনে হয়েছিল মাটির নিচে যেন বিশাল দরজা প্রচণ্ড শব্দে খুলে যাচ্ছিল। সেই ধাক্কায় কেঁপে ওঠে ৪ লাখ বর্গকিলোমিটার এলাকা, আর শব্দ শোনা যায় ৬.৫ লাখ বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত।

গবেষণা বলছে, কম্পনের আঘাতে শিলং মালভূমি প্রায় ১১ মিটার ওপরে উঠে আসে। গভীরতা ছিল ৯–৪৫ কিলোমিটার পর্যন্ত। তৎকালীন আসামের অংশ সিলেট অঞ্চলে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। শুধু সিলেটেই প্রাণ হারান ৫৪৫ জন। অঞ্চলভিত্তিক মৃত্যুর হার ছিল,  সুনামগঞ্জ: ২৮৭, সিলেট শহর: ৫৫, উত্তর সিলেট: ১৭৮, হবিগঞ্জ: ৭, দক্ষিণ সিলেট: ৮,করিমগঞ্জ: ১০

বাড়ি ধসে পড়া, ভূমিধস, নদীর পাড় ভেঙে যাওয়া, মাটির গভীর ফাটলে পড়ে যাওয়া সব মিলিয়ে অঞ্চলজুড়ে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। ভূমিকম্পের ধাক্কায় নদীগুলোও উন্মত্ত হয়ে ওঠে। ব্রহ্মপুত্রে ২–৩ মিটার উঁচু ঢেউ, বাজার-ঘাট ডুবে যাওয়া, বহু এলাকায় মাটির তরলায়ন,বাড়িঘর হেলে পড়ে কাদায় গলে যাওয়া এসব ছিল সাধারণ দৃশ্য।

এক হৃদয়বিদারক ঘটনায় সুনামগঞ্জে এক নারী নদীর মাঝখানে হঠাৎ তৈরি হওয়া ফাটলে পড়ে যান। স্বামী প্রাণপণ চেষ্টা করেও তাকে টেনে তুলতে পারেননি—দেহ আর কখনও উদ্ধার হয়নি।

আসাম–বেঙ্গল রেলওয়ের লাইন ভয়াবহভাবে বিকৃত হয়ে পড়ে। অনেক ব্রিজ ধসে যায়, টেলিগ্রাফ লাইন ছিঁড়ে পড়ে থাকে রাস্তায়। চলন্ত ট্রেনের নিচে রেললাইন দেবে যেতে থাকায় একাধিক দুর্ঘটনা অল্পের জন্য এড়ানো যায়।

শিলং শহরের পাথরের দালানগুলো প্রথম কম্পনেই ভেঙে পড়ে। আদালত, চার্চ, স্টেশন, সরকারি ভবন কিছুই রক্ষা পায়নি। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কম্পনের প্রথম মুহূর্তের শব্দ ছিল “হাজার জাহাজ একসঙ্গে ইঞ্জিন চালু করার মতো”এমন শব্দ তাদের জীবনে এর আগে কেউ শোনেনি।

চেরাপুঞ্জিতে ভূমিধসে মারা যায় প্রায় ৬০০ মানুষ। প্রথম তিন দিনে শিলং ও সিলেটে অনুভূত হয় প্রায় ২০০ আফটারশক। আতঙ্কে মানুষ ঘর ছাড়া হয়, রাত কাটায় খোলা মাঠে। ঘরে ঢোকার সাহস পায়নি কেউই।

সরকারি রিপোর্ট (E. A. Gait) অনুযায়ী আর্থিক ক্ষতি ছিল প্রায় ৫০ লাখ রুপি, যা সে সময়ের হিসেবে অফুরন্ত ধাক্কা। হাসপাতাল, কারাগার, আদালত ভেঙে পড়া,খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহে বিলম্ব, যোগাযোগব্যবস্থা পুরোপুরি অচল এই বিপর্যয় কয়েক মাস স্থায়ী ছিল।

এই ভূমিকম্প ভূবিজ্ঞানীদের নতুন করে বুঝিয়ে দেয় প্লেটের ভেতরের ফল্টও মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। শিলং প্ল্যাটোর পপ-আপ, নদীর সাইচ, মাটির তরলায়ন সবই ছিল পৃথিবীর গভীরে জমে থাকা শক্তির ভয়ানক নিদর্শন।

সব মিলিয়ে এই ভূমিকম্পে মৃত্যু হয়েছিল ১,৫৪২ জনের, যার মধ্যে সিলেটেই ৫৪৫। সিলেট যে এখনও ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল। আজকের বিজ্ঞানী এবং অতীত দুটোই সেই কথা বলে। ১৮৯৭-এর স্মৃতি যেন অদৃশ্য ছায়ার মতো আজও তাকিয়ে আছে আমাদের প্রস্তুতি ও সচেতনতার দিকে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: মহিউদ্দিন সরকার