খালেদার অসুস্থতায় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ভাটা, বদলে যাচ্ছে হিসাব
জাগো বাংলা প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৪:৪৪ এএম
তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আজ ১৩ দিন। দলের শীর্ষ নেতারা তাকে দেখতে আসছেন। একই সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলোতেও অংশ নিচ্ছেন। কিন্তু বেগম জিয়ার বর্তমান অবস্থায় বিএনপির কর্মসূচিতে দেখা দিয়েছে ভাটা, যার প্রভাব পড়েছে দলের রাজনৈতিক বাতাবরণেও। অনেক হিসাব-নিকাশও বদলে যাচ্ছে। তবে শুধু যে বিএনপির রাজনীতিতে ভাটার টান লেগেছে, তা নয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অন্যান্য দলগুলোর বিভিন্ন কর্মসূচি ও সামাজিক কার্যক্রমের গতিও এক প্রকার শ্লথ। সরেজমিনে দেখা গেছে, আগামী নির্বাচন নিয়ে জনসাধারণের আগ্রহও অনেকটা কমে গেছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। গত প্রায় দেড় বছর ধরে সংস্কার-বিচারসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমের পাশাপাশি নির্বাচন নিয়েও নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সরকার। ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন আয়োজনেরও ঘোষণা দেয়। এরমধ্যেই আগামী ১১ ডিসেম্বর ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটের তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। একইসঙ্গে ভোটগ্রহণের সম্ভাব্য তারিখ হিসেবে ৮, ১১ ও ১২ ফেব্রুয়ারিকে বিবেচনায় রাখছেন সংশ্লিষ্টরা।
এমন পরিস্থিতিতে অসুস্থ হয়ে পড়েন দেশের রাজনীতিতে আপোষহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ফলে বিএনপির রাজনৈতিক কার্যক্রম অনেকটাই স্তিমিত হয়ে পড়েছে। যদিও দলটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ফাঁকা থাকা কয়েকটি আসনে নিজেদের প্রার্থী ঘোষণা করেছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় প্রচারণা চালিয়ে নিতে চালিয়ে নিতে পারছেন না প্রার্থীরা। তারা বলছেন, দলের প্রধান অসুস্থ, এই অবস্থায় ওতপ্রোতভাবে নির্বাচনী প্রচারণায় নামা কার্যত ধৃষ্টতা।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া বহু ত্যাগ স্বীকার করে ও নানা নির্যাতন সহ্য করে দেশবাসীকে ভালোবেসেছেন এবং তাদের জন্যই দেশে থেকেছেন। কোনো পরিস্থিতিই তাকে বিচলিত করতে পারেনি। সারা বিশ্ব থেকে তার রোগমুক্তি কামনা করা হচ্ছে। এটি প্রমাণ করে যে নেতা-নেত্রী মানুষকে ভালোবাসলে মানুষও তাকে কখনও ভোলে না। এই মুহূর্তে আমাদের কাছে তার রোগমুক্তিই মুখ্য বিষয়; অন্য কিছু নয়।’
আবার যারা মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন, তারাও খালেদা জিয়ার অসুস্থতার আগে মাঠ গরম করে রেখেছিলেন। এখন তারাও কর্মসূচি পরিহার করছেন। দেশের বিভিন্ন এলাকার মনোনয়ন বঞ্চিত প্রার্থীদের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের কাছে নির্বাচন, দলীয় কর্মসূচি সবই প্রয়োজন সাপেক্ষে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তার আগে গুরুত্বপূর্ণ বেগম জিয়ার সুস্থতা। তিনি সেরে উঠলেই পুরোদমে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবেন তারা।
যশোর-২ (চৌগাছা ও ঝিকরগাছা) আসনে মনোনয়ন বঞ্চিত বিএনপি প্রার্থী মিজানুর রহমান খান বলেন, ‘আমি আমার নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক সুস্থতাকেই এখন প্রাধান্য দিচ্ছি। আমি উনার সুস্থতা কামনায় আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করছি। আমার এলাকার বিভিন্ন ওয়ার্ডে তার জন্য দোয়া করাচ্ছি। মনোনয়ন নিয়ে এখনই চিন্তা করছি না। তবে চূড়ান্ত সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করবো।’
পাঁচ দফা দাবি আদায়ের জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা আটটি রাজনৈতিক দল বিভাগীয় শহরগুলোয় সমাবেশ করছে। দুয়েকটি সমাবেশে লোকজন হলেও অন্যান্যগুলোয় সেরকম দেখা যায়নি। আবার কয়েকটি এলাকায় বড় আকারে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালিত হলেও তাতে জনগণ আগ্রহই দেখায়নি।
তৃণমূল জামায়াতের অনেক নেতাকর্মী জানিয়েছেন, খালেদা জিয়া অসুস্থ হওয়ার পর বিএনপির প্রার্থীরা নির্বাচনী প্রচারণায় তেমনভাবে নামছেন না। ফলে নির্বাচনে যে প্রতিযোগিতা বা হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের যে প্রবণতা, সেটি দেখা যাচ্ছে না। অনেক জায়গায় হিসাবও বদলে যাচ্ছে। কেননা, বেগম জিয়া বিএনপি ও বাংলাদেশের রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। তার নির্বাচনের মাঠে থাকা মানেই বিশাল ব্যাপার।
পিরোজপুর-১ আসনে জামায়াত মনোনীত প্রার্থী সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মাসুদ সাঈদী বলেছেন, বেগম জিয়া বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের এক অনন্য অনুপ্রেরণা। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষার আন্দোলনে তিনি কয়েক দশক ধরে অবিচল ভূমিকা পালন করেছেন। ফ্যাসিবাদী হাসিনার নির্যাতন, মিথ্যা মামলার পরিক্রমা এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ভয়াবহতার মাঝেও তার অটল মনোবল ও আপসহীন অবস্থান বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তার দৃঢ়তা, দেশপ্রেম ও নেতৃত্ব জাতীয় জীবনে গভীর প্রভাব রেখেছে। বাংলাদেশের বহু প্রজন্ম তাকে দেখেছে সাহস, সহনশীলতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতীক হিসেবে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় তার দীর্ঘ অবদান বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আমরা যারা বাংলাদেশকে ভালোবাসি তারা সকলেই বেগম খালেদা জিয়াকে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবেই চিনি।
অন্যান্য দলের তৃণমূল নেতাকর্মীরাও একই মত দেন। তাদের ভাষ্য, বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনের মাঠে থাকলে বিএনপির প্রার্থীদের যে প্রভাব বা প্রচারণা চোখে পড়ত, তিনি অসুস্থ হওয়ার পর সেটি কার্যত কমে গেছে। এটি নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। তাছাড়া দেশের ক্রান্তিলগ্নে বেগম জিয়ার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘ফিগার’ অনুপস্থিত থাকা মানে ভোটারদের আগ্রহ কমে যাওয়া। আওয়ামী লীগের সময়ে তার দল নির্বাচনে অংশ না নিলেও এর একটি প্রভাব ছিল। সুযোগ পেয়েও তিনি দেশের বাইরে যাননি। দেশে ছিলেন, জেল বরণ করেছিলেন। ফলে ভোটের ফলাফল বদলে গেছে। মানুষ ভোট দিতে যায়নি। যে কারণে আওয়ামী লীগকে দিনের ভোট রাতে করতে হয়েছে। আমি-ডামি নির্বাচন করে ফলাফল কুক্ষিগত করে নির্বাচনে জয়ী হতে হয়েছে।
বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বলছেন, বেগম খালেদা জিয়ার সিদ্ধান্তে দল যতবার নির্বাচনী কর্মসূচি করেছে, ততবার সফল হয়েছে। তিনি তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। দুইবার পূর্ণ মেয়াদে দেশ শাসন করেছেন। একবার দেশ ও দশের চিন্তা করে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছেন। বেগম জিয়া দেশের মানুষ ও উন্নয়ন নিয়ে ভাবেন বলেই আজ তাকে ফ্যাসিস্ট দলের বিরাগভাজন হতে হয়েছে। তিনি কখনো কোনো নির্বাচনে অন্যায় আচরণ করেননি। ১৯৯১ সালে পাঁচ আসনে দাঁড়িয়ে সবগুলোয় জয় পেয়েছেন। ২০২৬ সালের নির্বাচনে তিনি তিনটি আসন থেকে দাঁড়িয়েছেন। নির্বাচন চলাকালীন তিনি যদি অসুস্থ থাকেন তাহলে রাজনীতির অনেক হিসাব-নিকাশ পাল্টে যাবে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার গুরুতর অসুস্থতার কারণে দেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কিছুটা ভাটা নেমে এসেছে। কারণ তিনি গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘদিন সংগ্রাম ও আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে মিথ্যা মামলায় দীর্ঘ সময় কারাবরণ করেও তিনি সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। তার অসুস্থতা বাংলাদেশের রাজনীতি বা নির্বাচনে অবশ্যই প্রভাব ফেলছে। আমাদের সবারই কামনা, বিএনপি চেয়ারপারন খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, খালেদা জিয়ার অসুস্থতার কারণেই রাজনৈতিক কর্মসূচিতে জনগণ আগ্রহ দেখাচ্ছে না। কেননা, তার আপোষহীনতা, দৃঢ় রাজনৈতিক প্রজ্ঞা তাকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে নিয়ে গেছে। তিনি এখন আর শুধু বিএনপির নয়, দেশের প্রায় সবগুলো দলের রাজনৈতিক অভিভাবকে পরিণত হয়েছেন। সাধারণত নির্বাচন এলে দেশের আনাচে-কাঁনাচে মিটিং, মিছিল, সভা, সমাবেশ হতো বা হওয়ার কথা; সেসব ছাপিয়ে শুধুমাত্র ‘গণতন্ত্রের একমাত্র প্রতীক’ হয়ে ওঠা খালেদা জিয়ার সুস্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সর্বত্র। দেশের প্রতিটি এলাকার মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডাসহ প্রায় সবগুলো উপাসনালয়ে তার জন্য দোয়া হচ্ছে। এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারও বিবৃতির মাধ্যমে খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনায় সবার দোয়া আহ্বান করেছে।
খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে দেখতে ইতিমধ্যে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ডা মুহাম্মদ ইউনুস, তিন বাহিনীর প্রধান, জামায়াতে ইসলামীর আমির ডাক্তার শফিকুর রহমানসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা সরাসরি এবং মিডিয়ার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করছেন। তার লিভার সিরোসিস, হৃদরোগ, ফুসফুস ও কিডনির চিকিৎসায় গঠিত হয়েছে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে মেডিকেল বোর্ড। চীন ও যুক্তরাজ্য থেকে বিশেষজ্ঞ দলও এসেছে তার চিকিৎসায়। এসব কিছু পর্যবেক্ষণ করছেন খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠপুত্র তারেক রহমান।
গত কয়েকদিন ধরে এভারকেয়ারে তার ধারাবাহিক চিকিৎসা চলার পর গতকাল বৃহস্পতিবার তাকে লন্ডনে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মেডিকেল বোর্ড। এ লক্ষ্যে দেশে এসে পৌঁছেছেন তার পুত্রবধূ ডা. জুবাইদা রহমান। বিএনপি বলছে, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য ১৪ দলের একটি প্রতিনিধি দলও তার সঙ্গে যাবে। তাদের সঙ্গে থাকবেন ডা. জুবাইদা।
ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়াকে ‘রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা ভিভিআইপি’ ঘোষণা করে বিশেষ প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। তার নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সে (এসএসএফ) সদস্যদের। বাংলাদেশের ইতিহাসে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী অথবা প্রধান উপদেষ্টা পদের বাইরে থাকা কোনো ব্যক্তিকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রজ্ঞাপন জারি করে এমন ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ’ মর্যাদা ও এসএসএফ সুরক্ষা দেওয়ার নজির বিরল।
এদিকে, খালেদা জিয়াকে লন্ডন নিয়ে যেতে কাতারের আমিরের বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্স আসার কথা ছিল। কিন্তু কারিগরি ত্রুটির কারণে সেটি এখন আর আসছে না। কাতার আমিরের পক্ষ থেকে আসছে জার্মানির এয়ার অ্যাম্বুলেন্স। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে এই অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমেই তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে লন্ডন নেওয়া হবে। এ বিষয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপের সময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, শরীর যদি যাত্রার উপযুক্ত থাকে এবং মেডিকেল বোর্ড যদি সিদ্ধান্ত দেয় তাহলে রোববার লন্ডনের উদ্দেশে রওনা করবেন খালেদা জিয়া।
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে আবেগে পরিণত হয়েছেন খালেদা জিয়া
২৮ নভেম্বর দুপুরে বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার অবনতির খবর ছড়িয়ে পড়লে সেদিন সন্ধ্যা থেকেই এভার কেয়ার হাসপাতালের সামনে শুরু হয় মানুষের ঢল। কোনো রাজনৈতিক শো-ডাউন বা কোনো স্লোগানে এই ঢল সৃষ্টি হয়নি। খালেদা জিয়ার প্রতি মানুষের সম্মান, ভালোবাসা, আবেগ এই ভিড় সৃষ্টি করে। সবার চোখে মুখেই উৎকণ্ঠা দেখা যাচ্ছে।
রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভারকেয়ারের বাইরের এই ভিড় প্রমাণ করে, জনগণ বেগম জিয়াকে আর তার রাজনৈতিক জীবনের জন্য বিচার করছে না; বরং তার ত্যাগ ও দেশের জন্য আপোষহীন চরিত্রের জন্য সম্মান জানাচ্ছে। যখন একজন রাজনৈতিক নিজের জীবনের চেয়ে দেশ, মাটি ও মানুষকে গুরুত্ব দেন, তখন তিনি আর সাধারণ নেতা থাকেন না। হয়ে ওঠেন ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বেগম খালেদা জিয়া আজ সেই উচ্চতায় পৌঁছেছেন।
সরেজমিনে এভারকেয়ারের গেটের বাইরে দেখা গেছে, হাসপাতালের প্রধান ফটকে মানুষ জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একজন রিকশাচালক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মাদরাসার ছাত্র, শিশু, কর্পোরেট চাকরিজীবী মোট কথা সমাজের প্রতিটি শ্রেণির মানুষ খালেদা জিয়ার জন্য দোয়া করছেন। তিনি সুস্থ হয়ে উঠেছেন, এমন একটি খবর শোনার জন্য মানুষ দিনের পর দিন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন; এমন দৃশ্য বাংলাদেশের আর কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তির জন্য দেখা যায়নি। এটিই প্রমাণ করে, বেগম খালেদা জিয়া আপামর জনসাধারণের আবেগে পরিণত হয়েছেন।
এভারকেয়ারের সামনের অপেক্ষমাণ সংবাদপত্র বিতরণে যুক্ত রিপন মিয়া বলেন, আমি যতবার এইখান দিয়া যাই হাসপাতালটার দিকে একবার তাকাই, মন ভরে না। ম্যাডাম যদি একবার জানালায় আইতো, একবার হাত নাড়াইতো শান্তি পাইতাম। ছোটবেলা থেইকা তারে আমি দেখতাসি। কি সুন্দর আমাগো নেত্রী। কিন্তু আইজ তারে অসুস্থ বানায় দিলো ফ্যাসিস্ট হাসিনা। তিলে তিলে মাইরা ফালাইতে চাইসিলো। কিন্তু মানুষ তো তারে ভালোবাসে। এই ভালোবাসার টানেই আল্লাহ আমাগো নেত্রীরে সুস্থ কইরা দিবো।
কেন জনতার আকাঙ্ক্ষায় খালেদা জিয়ার সুস্বাস্থ্য?
গত ১৫ বছরে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ও তাদের দোসররা বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে পরিমাণ ব্যক্তিগত আক্রমণ ও কুরুচিপূর্ণ অপপ্রচার চালিয়েছে, তা সভ্য সমাজের অকল্পনীয় বলে মনে করেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় তাকে ‘এতিমের টাকা আত্মসাৎকারী’ হিসেবে চিত্রিত করার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের সবটুকু ব্যবহার করেছিলেন শেখ হাসিনা। বিভিন্ন জনসভায় দাঁড়িয়ে তাকে নিয়ে কটূক্তি হাসিনা। অথচ, মামলার নথিপত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে সেই ট্রাস্টের টাকা ব্যাংকে গচ্ছিত থেকে সুদে-আসলে কয়েকগুণ বেড়েছিল, আত্মসাতের কোনো ঘটনাই ঘটেনি। কিন্তু এই মিথ্যা অপবাদ দিয়েই তাকে বছরের পর বছর জেলে রাখা হয়েছিল। তাকে তার স্বামীর স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি থেকে এক কাপড়ে বের করে দিয়েছিল হাসিনার দোসররা। কিন্তু এত অপপ্রচার বা কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যের জবাবে বেগম খালেদা জিয়া কখনো একটি কটু কথাও বলেননি। তার এই পরিমার্জিত বোধ ও সহনশীলতাই আজ তাকে সাধারণ মানুষের চোখে শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত করেছে।
বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রনায়ক বা রাজনৈতিক নেতাই ভুলের ঊর্ধ্বে নন। বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলেও নানা ভুল-ত্রুটি, সীমাবদ্ধতা এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতা ছিল। ২০০১-২০০৬ মেয়াদে জঙ্গিবাদের উত্থান, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মতো নিরাপত্তা ব্যর্থতা, হাওয়া ভবনের কথিত দুর্নীতির অভিযোগ এবং দলের কিছু নেতার ক্ষমতার অপব্যবহার তার শাসনামলকে সমালোচিত করেছিল। এসব ঘটনা তার জনপ্রিয়তায় একসময় ভাটা ফেলেছিল, কিন্তু গত দেড় দশকে তিনি যে চরম মূল্য দিয়েছেন, ব্যক্তিগতভাবে এবং দলীয়ভাবে যতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, নির্যাতনের শিকার হয়েছেন; তা মানুষের মনে তার জন্য আলাদা স্থান তৈরি করেছে।
মানুষ যখন দেখে ৮০ বছর বয়সী নারীকে চিকিৎসা না দিয়ে প্রতি মুহূর্তে কষ্ট দিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, মিথ্যা মামলায় বছরের পর বছর জেলে রাখা হচ্ছে, তখন অতীতের প্রশাসনিক ভুলগুলো গৌণ হয়ে যায়। তার ত্যাগ এবং আপসহীনতা সেই সব ত্রুটিকে ছাপিয়ে তাকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে বলেও মনে করেন রাজনৈতিক বিশারদরা।
বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সাধারণ মানুষ বলছেন, বাংলাদেশের মানুষ ঐতিহাসিকভাবেই মজলুমের পক্ষে। খালেদা জিয়ার ওপর গত দেড় দশকে যে পরিমাণ মানসিক ও শারীরিক ধকল গেছে, তা সহজভাবে দেখার কোনো কারণ নেই। তার অসুস্থতার খবরে ভিন্ন মতাবলম্বীদের এই সহমর্মিতা প্রমাণ করে, রাজনৈতিক বিভেদ থাকলেও তার প্রতি মানুষের এক ধরণের সুপ্ত শ্রদ্ধা এবং মমতা কাজ করে।
কেন একজন রাজনৈতিক ব্যক্তির জন্য মানুষ এভাবে রাস্তায় ঘুমাচ্ছে বা অঝোরে কাঁদছে? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে অনেক বিশ্লেষক তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের কয়েকটি বিশেষ দিকের ওপর আলোকপাত করেন। তারা বলেন, নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে খালেদা জিয়ার আপোষহীন ভূমিকা তাকে ‘দেশনেত্রী’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল। আজ খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক জনপ্রিয়তা মূলত তার গত এক যুগের ‘নীরব সহ্যশক্তি’ থেকে উৎসারিত। বিশ্বের খুব কম নেতাই ক্ষমতার বাইরে এবং দীর্ঘ কারাবাসের পরও এমন তুমুল জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পেরেছেন।
এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর দিলারা চৌধুরী বলেন, বেগম খালেদা জিয়া তার কর্মজীবন ও অবদানের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী স্থান করে নিয়েছেন। ফলে রাজনীতি, নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডে এক প্রকার ভাটা বা বাতাবরণ দেখা যাচ্ছে। তার অসুস্থতায় শুধু বিএনপি নয়, সমগ্র দেশের মানুষ ব্যথিত। এখন দেশের মানুষের চোখ খালেদা জিয়ার দিকেই। তারা প্রত্যাশা করে, তিনি সুস্থ হয়ে আবারও দেশের নেতৃত্বে ফিরবেন।