Logo
Logo
×

জাতীয়

ভূমিকম্প : ভাবনা বাড়াচ্ছে ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ নরসিংদী ফল্ট

Icon

জাগো বাংলা প্রতিবেদন

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০১:০৩ এএম

ভূমিকম্প : ভাবনা বাড়াচ্ছে ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ নরসিংদী ফল্ট

ভাবনা বাড়াচ্ছে নরসিংদী ফল্ট লাইন। ২১ নভেম্বর ৫ দশমিক ৭ রিখটার স্কেলের ভূমিকম্পের পর এ পর্যন্ত ৫ দফা মৃদু ভূমিকম্প হলো একই এলাকায়। গত সপ্তাহে চার দফার পর বৃহস্পতিবার সকালে একই এলাকায় ৪ দশমিক ১ রিখটার স্কেলের ভূমিকম্পে আতঙ্ক বাড়াচ্ছে ঢাকা ও আশপাশের এলাকায়।

এদিকে ভূমিকম্পের ফাটলগুলো পরীক্ষণের জন্য বাংলাদেশ জিওলজিক্যাল সার্ভের একটি টিম তথ্য উপাত্ত নিয়ে এসেছিল। এখন একই এলাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো. জিল্লুর রহমান একটি টিম নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়েছেন। প্রাথমিক গবেষণায় কি পাওয়া গেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাটির প্রায় ২৫ কিলোমিটার নিচে নরসিংদী ফল্ট লাইনটির দৈর্ঘ্য সাড়ে ৭ থেকে ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ হবে। ছোটো এই ফল্ট লাইন বরাবর এবং এর আশপাশের এলাকায় আফটার শকগুলো (বড় ভূমিকম্পের পর ছোটো ভূমিকম্পগুলোকে আফটার শক বলা হয়) হচ্ছে।

এই ফল্ট লাইনের দিক কি? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়া হয়েছিল বাংলাদেশ ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ভূ-তত্ত্ববিদ) মাহমুদ হোসেন খানের কাছে। তিনি এই ফাটলের উপাত্ত সংগ্রহকারী টিমে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা নরসিংদীতে যে ফাটল পেয়েছি সেগুলোর গভীরতা ছিল ৪০ থেকে ৪২ সেন্টিমিটার এবং চওড়া ছিল ২০ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত। তবে প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে এখানে পূর্ব-পশ্চিমমুখী একটি ফল্ট লাইন রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের ওপর দিয়ে যাওয়া ডাউকি ফল্ট (ভারতের শিলং খাদ ও সিলেট খাদের প্রান্তঃসীমা পর্যন্ত প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ ফল্ট লাইন) এর সমান্তরালে নতুন এই নরসিংদী ফল্টটি। ডাউকি ফল্টও পূর্ব-পশ্চিমমুখী এবং নরসিংদী ফল্টও প্রায় পূর্ব-পশ্চিমমুখী।’ নরসিংদী ফল্ট লাইনটি প্রায় পূর্ব-পশ্চিম বরাবর রয়েছে উল্লেখ করে প্রফেসর ড. জিল্লুর রহমান বলেন, ‘এই ফল্ট লাইনটি ছাড়াও আশপাশের এলাকায় আরও ফল্ট লাইন থাকতে পারে। বড় ফল্ট লাইন শনাক্ত করা সহজ হলেও ছোটগুলো শনাক্ত করা কঠিন।’ নরসিংদী ফল্ট লাইন যে পূর্ব-পশ্চিমমুখী এর আরেকটি প্রমাণ হলো ঘোড়াশাল গরুর খামারের কাছে এবং পার্শ্ববর্তী স্কুলের মাঠে যে ফাটল দেখা গিয়েছিল সেগুলো ছিল পূর্ব-পশ্চিম বরাবর।

ভাবনা বাড়াচ্ছে উৎপত্তিস্থলের গভীরতা: ভূমিকম্প উৎপত্তির পর প্রাথমিকভাবে ১০ কিলোমিটার গভীরে ভূমিকম্পের উৎপত্তি দেখালেও পরে সংশোধন করে তা ২৫ কিলোমিটার দেখানো হয়েছে। এ বিষয়ে প্রফেসর ড. জিল্লুর রহমান বলেন, গতকালের ভূমিকম্পটিও ২৫ কিলোমিটার নিচে। এর আগে ৫ দশমিক ৭ রিখটার স্কেলের ভূমিকম্পটিও একই গভীরতায় হয়েছিল। আর এখানেই আমাদের চিন্তার বিষয়।

চিন্তার বিষয় কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের এই অঞ্চলে ১৬ থেকে ১৭ কিলোমিটার পর্যন্ত রয়েছে পলি মাটির স্তর। পলি মাটির স্তরের নিচে হলো শক্ত মাটির স্তর। যেহেতু ভূমিকম্পটি শক্ত মাটির স্তরে উৎপত্তি হয়েছে তাই এটি যে একটি সক্রিয় ফল্ট লাইন বরাবর হয়েছে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

একই সন্দেহ পোষণ করেন বাংলাদেশ ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ভূ-তত্ত্ববিদ) মাহমুদ হোসেন খান। তিনি বলেন, ইন্ডিয়ান প্লেট উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আর অগ্রসর হতে গিয়ে ডাউকি ফল্টের সঙ্গে হয়তো এই অংশের সংযোগ পয়েন্টে কোনো শক্তি উৎপত্তি হয়েছে। সেই শক্তি থেকে ছোটোখাটো কোনো ফাটল তৈরি হয়ে হয়তো ভূমিকম্পগুলো হচ্ছে। এ বিষয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন।

প্রয়োজন এখন ডিটেইল সার্ভে : দেশের ভূ-তাত্ত্বিক অবস্থা নিয়ে কাজ করে বাংলাদেশ বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স)। মাটির নিচের তেল গ্যাস অনুসন্ধান করতে বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে সিসমিক রিফ্লেকশন ম্যাপ (শরীরের এক্সরের মতো মাটির অভ্যন্তরের এক্সরে ম্যাপ) তৈরি করে সংস্থাটি। বাপেক্সে ৩১ বছর চাকরি করে ভূ-পদার্থ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক হিসেবে গত বছর অবসরে যাওয়া হাওলাদার অহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা দেশের অভ্যন্তরে মাটির নিচে সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার পর্যন্ত উপাত্ত নিয়ে থাকি। সারা দেশের মাটির নিচের উপাত্তই আমাদের কাছে রয়েছে। তবে নরসিংদী এলাকায় ছোটো একটি ফল্ট লাইন থাকতে পারে।

এ বিষয়ে আরও জানতে কথা হয় একই সংস্থার ব্যবস্থাপক (সিসমিক সার্ভে এক্সপার্ট) শাহ মো. মাহতাব উল আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘নরসিংদী এলাকায় কামতা গ্যাসফিল্ড ও রূপগঞ্জ গ্যাসফিল্ড মাটির প্রায় ২ হাজার ৮০০ মিটার নিচে পাওয়া গেছে। আর ভূমিকম্পের ফল্ট লাইনগুলো থাকে মাটির কমপক্ষে ১০ কিলোমিটার নিচে। তারপরও আমাদের কাছে মনে হয়েছে এই এলাকায় ছোটখাটো কিছু ফল্ট লাইন হয়তো রয়েছে। আর না থাকলে একটি বড় ভূমিকম্পের পর এতগুলো ছোট মাত্রার ভূমিকম্প হতো না। কিন্তু ছোট এসব ফল্ট লাইনগুলো শনাক্তের জন্য সারা দেশে ভূ-তাত্ত্বিক সার্ভে করতে হবে।’

একই মন্তব্য করেন প্রফেসর ড. জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, ‘বড় আকারের ফল্ট লাইনগুলো আমরা সবাই জানি। কিন্তু ছোট ফল্ট লাইনগুলো প্রকৃতপক্ষে আমরা জানি না। এগুলো বের করার জন্য সারা দেশে ডিটেইল সার্ভে করা এখন সময়ের দাবি।’

আফটার শক নিয়ে আতঙ্ক নয় : ৫ দশমিক ৭ রিখটার স্কেলের পর এ পর্যন্ত ৫ দফা ভূমিকম্প হলো ঢাকা ও নরসিংদী এলাকায়। গত ২১ নভেম্বরর ভূমিকম্পের পর ২২ নভেম্বর সকাল ১০টা ৩৬ মিনিট ১২ সেকেন্ডে ৩ দশমিক ৭ রিখটার স্কেলের, একই দিন সন্ধ্যা ৬ টা ৬ মিনিট ৪ সেকেন্ডে ৩ দশমিক ৭, এর এক সেকেন্ড পরে একই স্থানে ৪ দশমিক ৩ রিখটার স্কেলের ভূমিকম্পের পর গত ২৭ নভেম্বর বিকেলে ৩ দশমিক ৬ রিকটার স্কেলের ভূমিকম্প। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা ১৪ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডে ঢাকার আগারগাঁও থেকে ৩৮ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে নরসিংদী শিবপুরে ৪ দশমিক ১ রিখটার স্কেলের মৃদু ভূমিকম্প হয়েছে। এসব ভূমিকম্প সবগুলোই ২১ নভেম্বরের ভূমিকম্পের আফটার শক বলে মন্তব্য করেন ভূ-তত্ত্ববিদ মাহমুদ হোসেন খান। তিনি বলেন, কোনো এলাকায় ৫ দশমিক ৭ রিখটার স্কেলের ভূমিকম্পের পর প্রায় ২০০ দিন পর্যন্ত আফটার শক ভূমিকম্প হতে পারে।

অপরদিকে এসব আফটার শক ভূমিকম্পগুলোকে ঝুঁকি বিবেচনায় আনা হবে বলে মন্তব্য করেন ড. জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, এগুলো হলো নির্ভরশীল ভূমিকম্প। যদি ৫ দশমিক ৭ রিখটার স্কেলের ভূমিকম্পটি না হতো তাহলে এসব ভূমিকম্পের উৎপত্তি হতো না। তাই এগুলো নির্ভরশীল ভূমিকম্প এবং পরবর্তী ঝুঁকি নিরূপণের সময় এগুলোকে বিবেচনায় আনা হবে না।

অপরদিকে ভূমিকম্প নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে ভবন নির্মাণের ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড মেনে চলার গুরুত্বারোপ করে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৭ সালে আর্থকোয়েক রিসার্চ সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘বাংলাদেশ ভূমিকম্প ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। আর তা বিবেচনা করেই কিন্তু ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড প্রণয়ন করা হয়েছে। আমরা যদি ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড অনুসরণ করি তাহলে ভূমিকম্পে ঝুঁকির মাত্রা কমে আসবে।’

তিনি আরও বলেন, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রধান নগরগুলোর নতুন নতুন ভবনগুলো ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার নমুনা কম। পুরনো ভবনগুলো কিংবা যেসব ভবন প্রকৌশলী ছাড়া নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলো বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে।

উল্লেখ্য, সারা বিশ্বে প্রতিবছর দুই হাজার বার ভূমিকম্প হয়। এদের মধ্যে বছরে ১০০ ভূমিকম্প তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী হয়ে থাকে। ছোটো-বড় ২৭টি প্লেট নিয়ে গঠিত পৃথিবী প্রতিনিয়ত গতিতে থাকার কারণে প্লেটগুলোর প্রান্তঃসীমায় ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়ে থাকে। ইন্ডিয়া ও বার্মা প্লেটের মুখোমুখি সংঘর্ষের কারণেই টেকনাফ থেকে নেপাল পর্যন্ত হিমালয়ান পর্বতমালা পর্যন্ত গঠিত হয়েছিল। দেশে ২০২১ থেকে এ পর্যন্ত ২১৭টি ভূমিকম্প রেকর্ড হয়েছে। এর মধ্যে ২০২৫ সালেই হয়েছে ৮২টি। গত চার বছরের ২১৭টি ভূমিকম্পের মধ্যে দেশের ভেতরে উৎপত্তি হয়েছে ৪৩টি ভূমিকম্পের। এ সব ভূমিকম্পের প্রায় সবগুলোই মাটির ১০ কিলোমিটার গভীরে উৎপত্তি হয়েছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: মহিউদ্দিন সরকার