ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে মাঠ প্রশাসন সাজাতে শুরু করেছে সরকার। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গত মাসে তিন ধাপে মাঠ প্রশাসনের ৫২টি জেলার জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে পদায়ন করার পরও আবারও জেলা প্রশাসক পদে রদবদল করা হতে পারে। নতুন ও পুরাতন মিলে প্রায় ১০ জন জেলা প্রশাসককে মাঠ থেকে প্রত্যাহার করে নতুন ডিসি নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
চলতি সপ্তাহে আট থেকে ১০ জন কর্মকর্তাকে জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে নিয়োগ দেওয়া হতে পারে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে। যাদের প্রত্যাহার করা হবে ইতোমধ্যে তাদের গোয়েন্দা প্রতিবেদন নেওয়া হয়েছে। এদিকে ৭৭টি উপজেলায় ৭৭জন উপজেলা নির্বার্হী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে সরকার। সোমবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত পৃথক পৃথক প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
সম্প্রতি সারা দেশে জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদায়ন ঘিরে প্রশাসনে নতুন করে সমালোচনা শুরু হয়েছে। জনপ্রশাসনে স্বচ্ছতা, যোগ্যতার মূল্যায়ন ও নীতিগত পদায়ন দীর্ঘদিনের দাবি। কিন্তু বারবার একই গোষ্ঠীর পদোন্নতি-পদায়নের ঘটনা প্রশ্ন তুলছে প্রশাসন কি সত্যিই বদলাচ্ছে নাকি কোনো সিন্ডিকেট এর নেপথ্যে সক্রিয়। যোগ্য, নিরপেক্ষ ও সৎ কর্মকর্তারা বছরের পর বছর বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ একই গোষ্ঠীর সুবিধাভোগীরা বারবার গুরুত্বপূর্ণ জেলায় পদায়ন পাচ্ছেন। আগামী জাতীয় নির্বাচনে মাঠ প্রশাসন কতটা নিরপেক্ষ, কতটা সেবামুখী এবং কতটা জনমানুষের প্রতি দায়বদ্ধ তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
জনপ্রশাসন সংক্রান্ত এই বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করেছে জুলাই রেভল্যুশনারি অ্যালায়েন্স। তাদের ভেরিফায়েড পেজে বলা হয়েছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি উইং একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটে পরিণত হয়েছে। জনপ্রশাসনের সিপিটি অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. আবু শাহীন মো. আসাদুজ্জামান, জনপ্রশাসনের মাপ্র/অ.নি.ও ননি অধিশাখার যুগ্ম সচিব রাহিমা আক্তার, প্রেষণ-১ শাখার যুগ্মসচিব আবুল হায়াত মো. রফিক, চুক্তি ও বৈদেশিক নিয়োগ শাখার উপসচিব আবু সালেহ মো. মাহফুজুল আলমসহ জনপ্রশাসনে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা বদলী ও নিয়োগ ‘সিন্ডিকেট’ দ্বারা নিয়ন্ত্রণের অভিযোগের অন্ত নেই।
অ্যালায়েন্সের দাবি, এরাই ইউএনও ও ডিসি বদলি-পদায়ন ‘নিয়ন্ত্রণ’ করছেন এবং আওয়ামী-ঘনিষ্ঠ ও সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ উপজেলায় পাঠানো হচ্ছে। প্রশাসনে বদলি-পদায়নের ধারায় এক ধরনের অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্ক বা সিন্ডিকেট এমন ভাবে সক্রিয় হয়েছে। তাদের চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ পাচ্ছেন না।
অন্যদিকে, ৩৫তম ও ৩৬তম ব্যাচের ১৫৮ ইউএনওকে আকস্মিক প্রত্যাহার সেটিও এই সিন্ডিকেটের প্রভাবের বলে অভিযোগ। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে মাঠ প্রশাসন সাজাতে শুরু করেছে সরকার। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার ৫২টি জেলায় জেলা প্রশাসক পদে পরিবর্তন করা হয়। আবার বদলি না হলে এই ডিসিদেরই আসন্ন নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালনের কথা রয়েছে।
অপরদিকে জনপ্রশাসনের ঊনি অধিশাখার যুগ্মসচিব মিঞা মুহাম্মদ আশরাফ রেজা ফরিদী, ঊনি-১ শাখা উপসচিব মোহাম্মদ রফিকুল হক, ঊনি-২ শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব জেতী প্রু, মাপ্র-২ শাখার উপসচিব আমিনুল ইসলাম, নব-নিয়োগ শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব মো. উজ্জল হোসেনকে জনপ্রশাসন থেকে সরিয়ে দিতে জামায়াতপন্থি আমলারা মাঠে নেমেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার আগেই জানিয়েছে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের তিনটি নির্বাচনে যারা ন্যূনতম সংশ্লিষ্ট ছিলেন এমন কর্মকর্তাদের আগামী নির্বাচনের দায়িত্ব দেওয়া হবে না। তবে প্রধান উপদেষ্টার সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে পারেনি জনপ্রশাসন। এদিকে মৌখিক আদেশে আরও কয়েকজন শীর্ষ সচিবের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার ধারাবাহিক পদায়ন প্রশাসনের ভেতরে বিশেষ সুবিধাভোগী চক্রের অস্তিত্ব আরো দৃশ্যমান করেছে। নড়াইলে ‘ভুয়া জুলাই যোদ্ধা’ বিতর্কের কেন্দ্রে থাকা একই ব্যাচের শারমিন আক্তার জাহান নামের দ্বিতীয়বার ডিসির দায়িত্ব পেয়েছেন।অভিযোগ রয়েছে, নারায়ণগঞ্জে সহকারী কমিশনার (ভূমি) থাকাকালে তিনি মাতৃত্বকালীন ছুটিও নিয়মমাফিক ভোগ করেননি।
২৭তম ব্যাচের তৌফিকুর রহমানও তিন দফায় ডিসি হয়েছেন কুষ্টিয়া, খুলনা এবং সর্বশেষ বগুড়ায়। ২৫তম ব্যাচের আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীনও একাধিক জেলা ঘুরে এসেছেন। নড়াইলের বর্তমান ডিসি ড. মোহাম্মদ আবদুল ছালাম দুই ধাপে দুই জেলায় ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বঞ্চিত এক কর্মকর্তা বলেন, একজন কর্মকর্তা তিন জেলায় ডিসি, আরেকজন দুই জেলায় এটা স্বাভাবিক নীতি নয়। যারা সচিবদের একান্ত সচিব ছিলেন, তারাই বারবার সুযোগ পাচ্ছেন। আরেক কর্মকর্তা জানান, ২৫তম ও ২৭তম ব্যাচের কিছু কর্মকর্তাকে ডিসি করা প্রয়োজন ছিলো। তা না করে ফ্যাসিস্ট আওয়ামীলীগপন্থি ও জামায়াতপন্থি আমলাদের ডিসি পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অথচ অনেক সিনিয়র কর্মকর্তা আছেন, যারা বছরের পর বছর অপেক্ষায় থাকেন। কিন্তু তাদের ডিসি পদে পদোন্নতি নেই।
জানা গেছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গত ৯ নভেম্বর রাতে ১৪ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করলে সামাজিক মাধ্যমে ‘রাতের ডিসি’ আলোচনা উঠে আসে। কারণ এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন গভীর রাতে জারি করা হয়েছে। এর আগের দিন শনিবার আরো ১৫টি জেলায় ডিসি নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল সরকার। পরে বাতিল করা হয়। এর পরের বৃহস্পতিবার পৃথক দুটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে আরো ২৩টি জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগের কথা জানায় সরকার। এর মধ্যে কয়েকটি জেলায় ডিসিদের পরিবর্তন করা হয়, আর বাকিগুলোতে নতুন কর্মকর্তারাই ডিসি হিসেবে নিয়োগ পান। এসব প্রজ্ঞাপন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অর্থনীতি ক্যাডার থেকে প্রশাসন ক্যাডারে যুক্ত হওয়া বেশ কিছু কর্মকর্তা ডিসি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন যাদের মাঠ প্রশাসনে ও নির্বাচনি কাজের যুক্ত থাকার কোনো অভিজ্ঞতা নেই।
১৬৬ উপজেলায় নতুন ইউএনও
এবার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পদে রদবদল আনল সরকার। প্রথম ধাপে ১৬৬ উপজেলায় সিনিয়র সহকারী সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের নতুন ইউএনও নিয়োগ দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। আটটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এ ইউএনওদের নিয়োগ দেওয়া হয়। ঢাকা বিভাগের ২৯ উপজেলায়, বরিশাল বিভাগের ২১ উপজেলায়, চট্টগ্রাম বিভাগের ২৯ উপজেলায়, খুলনা বিভাগের ২১ উপজেলায়, রংপুর বিভাগের ২৪ উপজেলায়, রাজশাহী বিভাগের ১৩ উপজেলায়, সিলেট বিভাগের ১৪ উপজেলায় এবং ময়মনসিংহ বিভাগের ১৫ উপজেলায় নতুন ইউএনও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে ন্যস্ত করা কর্মকর্তাদের তাদের নিজ অধিক্ষেত্রে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য ‘দ্য কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর, ১৮৯৮ এর সেকশন-১৪৪ এর ক্ষমতা অর্পণ করা হলো। নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারা গত ৩০ নভেম্বরের মধ্যে বদলি করা কর্মস্থলে যোগদান করেছেন।
জানতে চাইলে সাবেক সচিব ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুস সবুর বলেন, মাঠ প্রশাসনে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া প্রশাসনের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ তৈরি করছে। বঞ্চনার এই চক্র সৎ কর্মকর্তাদের নিরুৎসাহিত করছে। প্রশাসনের ক্যারিয়ার প্রগ্রেশনকেই ধ্বংস করছে।