গ্যাস উত্তোলন নয়, টেকটোনিক চাপেই দেশে ভূমিকম্প বাড়ছে
জাগো বাংলা প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০২৫, ০২:৫৫ পিএম
দেশে নভেম্বরজুড়ে একের পর এক ভূমিকম্প ও আফটারশক অনুভূত হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ বেড়েছে। এই কম্পনগুলো কি দেশের গ্যাস উত্তোলন কিংবা গোপনে পরিচালিত কোনো ফ্র্যাকিং কার্যক্রমের কারণে হচ্ছে? নাকি এটি সম্পূর্ণই প্রাকৃতিক টেকটোনিক চাপের ফল?
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, সরকারি তথ্য, আন্তর্জাতিক গবেষণা এবং সাম্প্রতিক সংবাদ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশে বড় আকারের শেল গ্যাস ফ্র্যাকিং চলছে এমন কোনো প্রমাণ নেই। বরং সাম্প্রতিক ভূমিকম্পগুলো বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের কারণেই ঘটছে।
ফ্র্যাকিং হলো ভূগর্ভের খুব গভীরে থাকা শেল গ্যাস বা টাইট অয়েল তোলার একটি আধুনিক প্রযুক্তি। এই পদ্ধতিতে পানি ও রাসায়নিক পদার্থের চাপ দিয়ে পাথরের স্তর ফাটানো হয়।
গত ২১ নভেম্বর সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে নরসিংতে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। ইউরোপীয় সিসমোলজিক্যাল কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, এই ভূমিকম্পের গভীরতা ছিল প্রায় ১০-২৭ কিলোমিটার, যা স্পষ্টতই গভীর টেকটোনিক ফল্টে সৃষ্ট কম্পন।
এই প্রধান ভূমিকম্পের পর দিনভর এবং পরদিন রাজধানীর বাড্ডাসহ আশপাশের এলাকায় ৩ থেকে ৪ মাত্রার একাধিক আফটারশক অনুভূত হয়।
বাংলাদেশ ভূমিকম্প গবেষণা কেন্দ্র বলছে, পুরো ২০২৫ বছরজুড়ে ভূমিকম্পের সংখ্যা দীর্ঘমেয়াদী গড়ের তুলনায় অনেক বেশি, যা ভূগর্ভে চাপ জমার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গ্যাস উত্তোলন, বিশেষ করে ফ্র্যাকিং নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। অনেকেই জানতে চাচ্ছেন, গোপনে ফ্র্যাকিং করা হচ্ছে কি না।
কিন্তু গ্লোবাল এনার্জি মনিটর, পেট্রোবাংলার বার্ষিক প্রতিবেদন, আন্তর্জাতিক জার্নাল এবং জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য একেবারে পরিষ্কার। তারা বলছে, বাংলাদেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে সাধারণ খনন প্রযুক্তি ব্যবহার করেই গ্যাস উত্তোলন হয়। যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডার মতো শেল গ্যাসের স্তর এখানে অনুকূল নয়, তাই ফ্র্যাকিং করে গ্যাস তোলার প্রয়োজন বা সম্ভাবনা দুটোই অত্যন্ত কম।
ওয়ানপেট্রো এবং ডব্লিউওএআর জার্নাল তাদের গবেষণা তুলে ধরে বলছে, বাংলাদেশের ভূগর্ভে শেল গ্যাসের স্তর পর্যাপ্ত ঘন, পুরু বা সমজাতীয় নয়। ফলে শেল রিজার্ভ থেকে বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক গ্যাস উত্তোলন এখানে প্রায় অসম্ভব।
আর ফ্র্যাকিং অবকাঠামোর যেসব লক্ষণ থাকে, (হাজার হাজার অনুভূমিক কূপ, বিপুল পানি-মিশ্রণের ব্যবহারের রেকর্ড, রাসায়নিক পরিবহন) এসবের কোনো প্রমাণই দেশে নেই। কিছু কূপে হয়তো অল্প পরিসরে অয়েল স্টিমুলেশন হয়েছে, যা বিশ্বজুড়েই প্রচলিত এবং এতে বড় কম্পন সৃষ্টির ঝুঁকি নেই বললেই চলে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফ্র্যাকিং বা প্রচলিত গ্যাস উত্তোলন থেকে সাধারণত খুব অগভীর ভূমিকম্প সৃষ্টি হতে পারে; যার মাত্রা সাধারণত ২ থেকে ৩, কখনও কখনও ৪ পর্যন্ত যায়। কিন্তু বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ভূমিকম্পগুলো ৫-এর ওপরে মাত্রার এবং গভীর টেকটোনিক স্তরে সংঘটিত। তাই এটি ভূগর্ভের প্রাকৃতিক প্লেট-চাপ ব্যতীত অন্য কোনো কারণে হওয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশের নিচে তিনটি প্রধান ফল্ট লাইন সক্রিয় থাকে। এগুলো হলো — ডফলা ফল্ট, দ্বারিকা ফল্ট ও মেঘনা ফল্ট জোন (ঢাকার কাছাকাছি)। এসব ফল্টগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা চাপ হঠাৎ মুক্ত করলে এমন কম্পন হওয়া স্বাভাবিক।
তবে গ্যাস উত্তোলনের প্রভাব পুরোপুরি অমূলক নয়। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, যে কোনো খনিজ উত্তোলনে স্থানীয় চাপের সামান্য পরিবর্তন হতে পারে। এই কারণে পেট্রোবাংলা ভূমিকম্পের পর ৪৮ ঘণ্টার জন্য ড্রিলিং সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছিল, যা একটি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা মাত্র। এটি থেকে বোঝা যায়, উত্তোলন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখে। তবে বড় ভূমিকম্পের পেছনে গ্যাস উত্তোলন বা কোনো শিল্পকর্মকে দায়ী করার মতো কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি এখনো নেই।