ফাইভ পাস আবুল বয়াতি এখন কোরআনের তাফসিরকারক!
জাগো বাংলা প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২০২৫, ০১:১৩ এএম
বিতর্কিত বাউলশিল্পী আবুল সরকার মহারাজ ওরফে আবুল বয়াতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পার করার পর আর পড়ালেখা না করে গান গাওয়া শুরু করেন। পঞ্চম শ্রেণি পাস করেই দিতে থাকেন ধর্ম নিয়ে বিভিন্ন অপব্যাখ্যা। পাঁচ বছর ধরে তিনি বিভিন্ন আসরে আবির্ভূত হন কোরআনের ‘তাফসিরকারক’ হিসেবে। এসব বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য ও পবিত্র কোরআনের আয়াত নিয়ে ভুয়া বিবরণ তিনি প্রচার করতেন ইউটিউব, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সম্প্রতি একটি পালাগানের আসরে আল্লাহ, কোরআন এবং নবী মুহম্মদ (সা.)-সহ কয়েকটি ধর্মীয় বিষয়ে কটূক্তি করলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। অবশেষে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মামলায় বর্তমানে কারাগারে আছেন আবুল বয়াতি। তার জীবনযাপন ছিল রহস্যময়। মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার চর দিল্লি গ্রামে তার বাড়িতে ভিআইপি ভক্তদেরও আনাগোনা ছিল। বসত নানা আসর। এসব আড্ডায় বেশ কয়েকবার ধর্ম নিয়ে বিভিন্ন কটূক্তি করেন তিনি। কিন্তু শিল্পী হওয়ায় এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ও ফ্যাসিবাদী দলটির মানিকগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট গোলাম মহিউদ্দিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পেত না। তবে এবার তার বিরুদ্ধে ধর্মপ্রাণ লোকজন এককাট্টা হলে বিপত্তি বাধে।
আবুলের আত্মীয়স্বজন ও গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই সন্তানের জনক আবুল বয়াতি বাউল গান গাওয়া শুরু করেন ১০ বছর বয়স থেকেই। তার স্ত্রী আলেয়া বেগমও বাউলশিল্পী। আবুল যেখানেই গান গাইতে যেতেন, সেখানে তার স্ত্রীকেও নিতেন। সম্প্রতি নিজেকে পীর হিসেবে পরিচিত করতে শুরু করেন আবুল, বাড়াচ্ছিলেন ভক্ত। তিনি গ্রামবাসীর কাছে দাবি করেন, পীর সৈয়দ হাসিব আল হাসান রেজুইয়ের কাছ থেকে ২০০৭ সালে খেলাফত পান। এমন দাবি তিনি পালাগানের আসরেও বলতেন। এমনকি তার নামও লেখেন সৈয়দে গোলাম মহারাজ আবুল সরকার আল চিশতী নিজামি। তার একটি বয়াতি গানের বইও আছে।
সূত্র জানায়, ঢাকাসহ সারা দেশে তার ৫০ হাজারের মতো ভক্ত আছে বলে তিনি দাবি করতেন। তার বয়াতি গানের শিষ্যের সংখ্যাও হাজারখানেক। এছাড়া তিনি ভারতে গেছেন একাধিকবার। আবুল গানের আসরে ভক্তদের কাছে দাবি করেছেন, তিনি ভারতে আজমির শরিফ ভ্রমণ করেছেন। ২০০৭ সালে তার গানের ওস্তাদ রশিদ সরকারের সঙ্গে ওমরা হজও পালন করেন।
সূত্র আরো জানায়, আবুলের বসতভিটায় প্রায় ৪৫ শতাংশ জমি আছে। আরো ২০০ শতাংশ জমি কিনেছেন। নবীনগর এলাকায় তার একটি প্লট আছে। মানিকগঞ্জের শিবালয়ে আরিচা-দৌলতদিয়া লঞ্চঘাটে আশা সুপার মার্কেট করেছেন লিজের জমিতে। তিনি মিরপুর-১-এ ভাড়া বাসায় থাকতেন বলে জানা গেছে।
বিতর্কিত এই শিল্পীর স্বজনরা জানান, আবুলের তিন ভাই ও চার বোন আছে। এর মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। সাত ভাইবোনের মধ্যে ছোট ভাই জাহাঙ্গীর আলম। জাহাঙ্গীর একটি মসজিদের ইমাম। ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়ে অপব্যাখ্যা দেওয়ার কারণে আবুলের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো নয়। এ কারণে জাহাঙ্গীরকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করেন এই বয়াতি। এমনকি জামায়াত ও শিবিরের তকমা দিয়ে একাধিক মামলায় জড়িয়ে তাকে জেলেও পাঠান তিনি।
আবুলের সরাসরি আওয়ামী লীগের পদ-পদবি নেই। তবে আওয়ামী মন্ত্রী ও প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা থাকায় আপন ভাই জাহাঙ্গীরকে জমিসংক্রান্ত বিরোধে হয়রানি করেন। এছাড়া জাহাঙ্গীরের বাড়িতে একটি মহিলা মাদরাসা ছিল, যা রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসন দিয়ে বন্ধ করে দেন আবুল।
সূত্র জানায়, আবুল তার বাড়ির সামনে ৪ শতাংশ জমি দখল করেছেন। সেটির মালিক ছোট ভাই জাহাঙ্গীর, যা নিয়ে এখনো মামলা চলমান। আবুলের বাবার ৬১ শতাংশ জমি। এর মধ্যে ভাইবোনদের ঠকিয়ে একাই ৪৫ শতাংশ জায়গা গোপনে লিখে নেন। ছোট ভাই জাহাঙ্গীর অভিযোগ করেন, তার বাবাকে ওষুধ খাইয়ে জাদুটোনা করে তিনি এ কাজ করেছেন।
এলাকাবাসী জানান, ২০১৯ সালে আবুলের বাড়ির পাশেই ৫ শতাংশ জায়গায় একটি ঘর ছিল, যার মালিক জাহাঙ্গীর। সেটিও তার ভক্তদের দিয়ে ভেঙে ওই ঘর পানিতে ফেলে দিয়ে পুলিশের উপস্থিতিতেই সেটি দখল করেন। প্রতিবাদ এড়াতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত রাখেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকে। ওই ঘটনার পর তিনি গানের আসরে যাওয়ার জন্য যে পোশাকই পরেন, তার গায়ে প্রচণ্ড চুলকানি শুরু হয় এবং একে একে বেশ কয়েকটি পোশাক পরিবর্তন করেন। এরপরও চুলকানি বন্ধ হয়নি। এ রোগ তীব্র আকার ধারণ করলে চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরেও যান আবুল। এতেও রোগ ভালো হয়নি। এজন্য তিনি এখন কাফনের মতো সাদা কাপড় পরে থাকেন।
সূত্র জানায়, আওয়ামী আমলে বিভিন্ন সময় গানের আসরে শেখ মুজিব, শেখ হাসিনাসহ মানিকগঞ্জের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার নামে চাটুকারি গান পরিবেশন করে তাদের খুশি করার চেষ্টা করেন। এছাড়া বিভিন্ন সময় গানের আসরে আবুল ইসলাম ও ধর্মীয় বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও কুরুচিপূর্ণ এবং আপত্তিকার বক্তব্য দেন, যা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনাও হয়।
জানা গেছে, দেশের পরিস্থিতি যখন শান্ত, এমন সময় তিনি ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির ষড়যন্ত্র করছিলেন কি না, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদ করে ইতোমধ্যে তার কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, নতুন পীর হওয়ার দাবি আবুল কেন করেছিলেন—পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানিয়েছেন, অতিরিক্ত টাকা আয়ের জন্য তিনি নতুন পীর হওয়ার চেষ্টায় ছিলেন। কিন্তু গানের যত ভক্ত তৈরি করেছেন, সেক্ষেত্রে পীর দাবির পর তার অতটা ভক্ত হয়নি।
এ বিষয়ে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিক গতকাল সন্ধ্যায় জানান, মানিকগঞ্জের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বর্তমানে ভালো আছে।