Logo
Logo
×

জাতীয়

মেসে ডেকে শিক্ষার্থীকে রাতভর র‍্যাগিং, হাসপাতালে ভর্তি

Icon

জাগো বাংলা প্রতিবেদন

প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:০৯ পিএম

মেসে ডেকে শিক্ষার্থীকে রাতভর র‍্যাগিং, হাসপাতালে ভর্তি

সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে (গবি) শের আলী (২০) নামের এক শিক্ষার্থীকে মেসে ডেকে নিয়ে রাতভর র‍্যাগিং ও মারধরের অভিযোগ উঠেছে কয়েকজন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন ভুক্তভোগীর সহপাঠীরা। সোমবার (২৪ নভেম্বর) দিবাগত রাতে সাভার উপজেলার পাথালিয়া ইউনিয়নের নলাম এলাকায় একটি ভাড়া মেস বাসায় এ ঘটনা ঘটে। রাতেই আহত শিক্ষার্থীকে আশুলিয়ার গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

এ ঘটনায় অভিযুক্তরা হলেন অন্তু দেওয়ান (২২), মেহেদী হাসান (২১), আশরাফুল (২২), আসিফ লাবিব (২৩)। তারা গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী শের আলী আইন বিভাগের প্রথম সেমিস্টারের (৩৩তম ব্যাচ) শিক্ষার্থী। তিনি রংপুরের পীরগঞ্জের মাহমুদপুর এলাকার বাসিন্দা। আশুলিয়ায় একটি ভাড়া মেস বাসায় থেকে পড়াশোনা করেন তিনি।

এ ঘটনায় মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ করেন ভুক্তভোগীর সহপাঠীরা। এ সময় তারা র‍্যাগিং ও মারধরের সুষ্ঠু তদন্ত এবং অভিযুক্তদের বিচারের দাবি জানান।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী জানান, গতকাল বিকেলের দিকে প্রথমে আশরাফুলের বাসায় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ও তার বন্ধুদের ডেকে নেন অভিযুক্তরা। সেখানেই কথাবার্তার একপর্যায়ে প্রথমে তাকে হুমকি দেওয়া হলে তিনি বাসায় ফিরে যান। পরে রাতে আবার তাকে খিচুড়ি খেতে বাসায় ডেকে আনেন অভিযুক্তরা। খাওয়ার পর অন্যদের বিদায় দিলেও ভুক্তভোগীকে আটকে রাখেন তারা। এরপর রাত ৯টা থেকে ভোর রাত পর্যন্ত তাকে চর-থাপ্পড়, লাথিসহ বিভিন্নভাবে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। এছাড়া তাকে উলঙ্গ করে মানসিক নির্যাতনও করা হয়। ভোরের দিকে সবার পায়ে ধরে ক্ষমা চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরে ভুক্তভোগী বাসায় ফিরলে বন্ধুরা তাকে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হাসপাতালে ভর্তি করেন।

সরেজমিনে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হাসপাতালে গিয়ে ভুক্তভোগীকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দেখা যায়। মাথা, মুখমণ্ডলসহ সারা গায়ে আঘাতের নিলাফুলা জখমের চিহ্ন দেখা যায়। দায়িত্বরত চিকিৎসক জানান, শারিরীক নির্যাতন ও মারধরের কারণে তার গায়ে জখমের চিহ্ন দেখা যায়। পুরোপুরি সেরে উঠতে কয়েক দিন সময় লাগবে।

ভুক্তভোগী শের আলী বলেন, ‘আমরা যারা মেসে থাকি সবাইকে দাওয়াতের কথা বলে ডাকা হয়। প্রথমে আমরা মাজারে আসি, এরপর আসাদ ভাইয়ের বাসায় যাই। সেখানে যাওয়ার পর আমাকে আর আমার সহপাঠী মাহিমকে পেঁয়াজ ছিলতে বলা হয়, আমি বলি আমি পেঁয়াজ ছিলতে পারি না, আমি রসুন ছিলব। রসুন ছিলছিলাম, তখন আশরাফুল ভাই আমাকে ডেকে বলে—এত মুখে মুখে তর্ক করিস কেন। আমি বলি, বড় ভাইদের অসম্মান হয় এমন কিছু তো আমি বলিনি। তারপরে আশরাফুল ভাই বলল, তোকে মারতে কি লাগবে? তোকে মারলে কি হবে? আমি তখন বলি, আমাকে মারলে কিছুই হবে না। বলে আমি সেখান থেকে আমার বাসায় চলে আসি। রাত ৯টার দিকে আমার সহপাঠীদের দিয়ে আমাকে আবার ওই বাসায় ডাকা হয়, আমি যাই। আর আমার ভুল হয়েছে বলে সবার কাছে ক্ষমা চাই। এরপর সেখানে রান্না করা খিচুড়ি খাই।’

তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘খাওয়ার পর সবাইকে চলে যেতে বলে। কিন্তু আমাকে একা আটকায়, এরপর এক পায়ে দাঁড়াতে বলে, আমি দাঁড়াই। এরপর অন্তু ভাই ডেকে বলে কখনো হস্তমৈথুন করছিস? আমি বললাম, যৌবনে সবাই করে থাকে। তখন অন্তু ভাই আমাকে টানা ৫-৬টা চড়-থাপ্পড় মারে। এরপর বলে প্যান্ট খোল, যখন অস্বীকৃতি জানাই, তখন তরিকুল ভাই আবার আমাকে মারে। এরপর আমাকে প্যান্ট খুলে অন্তু ভাই পেটে লাথি মারে। ৩২ ব্যাচের মেহেদি ভাই, আশরাফুল ভাই দুইজন আমাকে চড় মারতে থাকে। এরপর আমি তাদের পায়ে ধরি, মাফ চাই। সেখানে ১৫-২০ জন ছিল ৩২ ব্যাচের, তাদের পায়ে ধরি, আমার ভুল হয়ে গেছে। এরপর আমাকে ছাড়ে। এরপর সেখান থেকে বের হতে দেয়। আমি একটা মসজিদে যাই, তারপর বাইরে এলে আমার বন্ধু মাহিম দেখে আমাকে নিয়ে যায়। পরে তারাই গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হাসপাতালে নিয়ে আসে। সকালে ৩২ ব্যাচের লাবিব ভাই হাসপাতালে এসে বলে, এটা আর বাড়াতে চাও? নাকি শেষ করবা বলে হুমকি দেয়। আমি এই ঘটনার যথাযথ বিচার চাই।’ এ বিষয়ে থানায় অভিযোগ করবেন বলেও জানান তিনি।

আহত শের আলীকে হাসপাতালে নেওয়া মাহিম খান বলেন, ‘সিনিয়রদের রুমে আমাদের ডাকা হয়, আমরা সবাই যাই, শের আলীও যায়। আমাদের পেঁয়াজ ছিলতে বলা হয়, ওরে বললে ও বলে চোখে সমস্যা পেঁয়াজ ছিলতে পারিনা। ও রসুন ছিলে। এক পর্যায়ে আশরাফুল ভাই ডেকে নেয়, দেখি চেতাচেতির আওয়াজ। পরে ও বাসায় চলে যায়। পরে আবার আমাকে আর এক বন্ধুকে দিয়ে শের আলীকে রাত ৯টার দিকে ডাকিয়ে আনায়। ও এসে বড় ভাইদের কাছে মাফ চায়৷ রাতে খাওয়ার পর সবাই চলে যায়, কিন্তু শের আলীকে তারা রেখে দেয়। বড় ভাইদের রুমে নেয়। বেশ কিছুক্ষণ পর দেখি শের আলী কাঁদতে কাঁদতে বের হয়েছে। তখন বন্ধুদের ডেকে আনি, জানতে পারি মারধর হয়েছে। এরপর তাকে প্রথমে রুমে নেই, পরে হাসপাতালে নিয়ে যাই।’

অভিযুক্ত অন্তু দেওয়ান (২৭ ব্যাচ) বলেন, ‘শের আলী আমাদের জুনিয়র তাকে শাসন করতেই পারি গায়ে হাত তোলার কিছু হয়নি। এ ধরনের কথা ভিত্তিহীন। এখানে আমার নাম জড়ানো হচ্ছে আমি নিজেও বিব্রতবোধ করছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘খিচুড়ির দাওয়াতে আমি গেছিলাম। সে বেয়াদবি করায় তাকে শাসানো, বকাবকি করা হয় কিন্তু ফিজিক্যালি এসল্ট করা হয়নি বা এ ধরনের কিছুই হয়নি। আর এটা বাইরের ঘটনা। আমরা যারা সিনিয়র আছি আমরা সমাধানের চেষ্টা করব। জুনিয়ররা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানিয়েছে, প্রশাসন সমাধান করবে এখন।’0

অন্তু দেওয়ান সম্প্রতি অনুষ্ঠিত গণ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী হয়ে পরাজিত হন। 

অন্য এক অভিযুক্ত কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের অনুষদ প্রতিনিধি মেহেদী হাসান (২৮ ব্যাচ) বলেন, ‘কাল আমাদের একটা খিচুড়ির দাওয়াত ছিল। সেখানে যাওয়ার পর সিনিয়র জুনিয়র-ঝামেলা বাধে সেটা মিউচুয়াল করার চেষ্টা করি, সরি বলতে বলি। কিন্তু কথা না শোনায় আমি বাইরে চলে আসি। পরে ঘোড়া পীর মাজার থেকে জানতে পারি ওরে (শের আলী) গণস্বাস্থ্যে নেওয়া হয়েছে। ফজর পর্যন্ত আমি গণস্বাস্থ্যেই ছিলাম, পরে সেখানের ডাক্তাররাও বলে যে সমস্যা নাই চাইলে বাসায় নিতে পারেন। এরপরে আমি বাসায় চলে যাই। আর পরবর্তী ঘটনা জানি না।’

আরেক অভিযুক্ত আসিফ লাবিব (২৮ ব্যাচ) বলেন, ‘এ ঘটনার সাথে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আমি ওই দাওয়াতে উপস্থিত ছিলাম, রুমের বাইরে ছিলাম ভুক্তভোগীর বন্ধুর সাথেই। ভেতরে কি ঘটেছে না ঘটেছে এসব বিষয়ে কোনো কিছুই জানি না।’

গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডা. নকিব জাহাঙ্গীর বলেন, ‘রাতে ওই শিক্ষার্থীকে হাসপাতালে আনা হয়। তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তাকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, ভর্তি করা হয়েছে। শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী পরবর্তী চিকিৎসা দেওয়া হবে।’

এ ঘটনায় বর্ণিত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফারাহ্ ইকবালকে সভাপতি এবং প্রভাষক কাউছারকে সদস্যসচিব করে ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ৩ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এই তদন্ত কমিটিকে।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির সভাপতি এবং আইন বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক রফিকুল আলম বলেন, বিভাগীয় তদন্ত কমিটি করা হয়েছে, তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল হান্নান বলেন, ‘বিষয়টি জানা নেই। তবে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী লিখিত অভিযোগ দিলে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: মহিউদ্দিন সরকার