সারা দেশে সদস্য সংখ্যা ২০০, রাজধানীতে মাত্র ৬০
ফায়ার সার্ভিসের আর্থকোয়াক রেসপন্স টিম
জাগো বাংলা প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৫, ০৩:৪৬ এএম
ভূমিকম্প ও ভবনধসের মতো দুর্যোগে উদ্ধার অভিযানের জন্য ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের রয়েছে স্পেশাল রেসকিউ টিম (এসআরটি)। এ টিমের সদস্যদের রয়েছে দুর্যোগ-পরবর্তী উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার বিশেষ প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা।
ভূমিকম্প ও ভবনধসের মতো দুর্যোগে উদ্ধার অভিযানের জন্য ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের রয়েছে স্পেশাল রেসকিউ টিম (এসআরটি)। এ টিমের সদস্যদের রয়েছে দুর্যোগ-পরবর্তী উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার বিশেষ প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা। পাশাপাশি রয়েছে অত্যাধুনিক সরঞ্জামও। তবে রাজধানী ঢাকার প্রতি তিন লাখ মানুষের বিপরীতে এমন এসআরটি সদস্য রয়েছেন মাত্র একজন। এ সংখ্যাকে জনসংখ্যার অনুপাতে খুবই নগণ্য বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ভূমিকম্প-পরবর্তী দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবেলায় এসআরটির সদস্য বৃদ্ধির পাশাপাশি ঝুঁকিপ্রবণ অঞ্চলে প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবী দল তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে এসআরটির ২০০ সদস্য কর্মরত আছেন। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় রয়েছেন ৬০ জন। তারা প্রস্তুত থাকেন পূর্বাচল ফায়ার সার্ভিসের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। বিশ্বের ঘনবসতিপূর্ণ শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান বরাবরই শীর্ষে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২-এর ‘ন্যাশনাল রিপোর্ট’ অনুযায়ী, উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নিয়ে গঠিত রাজধানী ঢাকা শহরের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৩ লাখ। কিন্তু দুই সিটি করপোরেশনের নিজস্ব তথ্য বলছে, এ জনসংখ্যা ১ কোটি ৭৫ লাখ। সেই হিসেবে ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ঢাকার প্রতি তিন লাখ মানুষের বিপরীতে আছেন একজন মাত্র এসআরটি সদস্য। তবে সংশ্লিষ্ট অনেকে মনে করেন, বর্তমানে ঢাকার জনসংখ্যা দুই কোটি ছাড়িয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল, রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগে ২০ জন করে মোট ১৪০ জন এসআরটি সদস্য রয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রাকৃতিকভাবেই বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল। ঝড়, বন্যার পাশাপাশি তীব্র ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে দেশ। শুক্রবারের ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প এবং শনিবারের তিন দফা ঝাঁকুনি দিচ্ছে সতর্কবার্তা। এমন পরিস্থিতিতে আতঙ্কে আছে দেশের মানুষ। ভূমিকম্পে রাজধানী ও বিভাগীয় শহরের বহুতল ভবনে বসবাসকারীদের ঝুঁকি অপেক্ষাকৃত বেশি। দেশে ভূমিকম্প হলে উদ্ধার অভিযানে প্রথমেই ডাক পড়ে ফায়ার সার্ভিসের। তবে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে উদ্ধার অভিযান পরিচালনায় ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা একেবারেই তলানিতে। এ রকম ভূমিকম্প-পরবর্তী পরিস্থিতি এককভাবে মোকাবেলার পর্যাপ্ত জনবল ও সরঞ্জাম নেই ফায়ার সার্ভিসের। এজন্য দেশের দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য যে এসওডি (স্ট্যান্ডিং অর্ডারস অন ডিজাস্টার) আছে, তার ভিত্তিতে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনীসহ সব বাহিনীকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হয়।
দীর্ঘ কর্মজীবনে ফায়ার সার্ভিসে উপপরিচালক (অপারেশন) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন দেবাশীষ বর্ধন। তিনি বলেন, ‘১০০ বছর আগে সিলেটে একটা বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। তখন অনেক প্রাণহানি হয়। এখন আবার ১০০ বছর পরে ঢাকাসহ সারা দেশেই ভূমিকম্প হচ্ছে। বিশেষ করে ৩১ ঘণ্টায় চারবার ভূমিকম্প হয়েছে। এমনকি গতকাল (শনিবার) মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডেও ভূমিকম্প হয়েছে। ফলে আমাদের দেশে এখন আবারো বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে। বিশেষ করে সিলেটের জৈন্তাপুর, চট্টগ্রাম, ময়মসিংহ, টাঙ্গাইল ও ঢাকা ভূমিকম্পের রেড জোন।’
তিনি আরো বলেন, ‘ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আমাদের যে জনবল আছে, তা খুবই সামান্য। ৭ মাত্রার কোনো ভূমিকম্প হলে সারা দেশের ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের ঢাকায় এনেও পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না। এজন্য আমাদের দেশজুড়ে ভলান্টিয়ার বাড়াতে হবে। পাশাপাশি ফায়ার ফাইটারদের ‘কলাপস স্ট্রাকচার সার্চ অ্যান্ড রেসকিউ’ প্রশিক্ষণ বাড়াতে হবে। ভূমিকম্প-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় ছোট, মাঝারি ও ভারি দল তৈরি করতে হবে।’
ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তর জানিয়েছে, সারা দেশে তাদের ৫৩৭টি স্টেশন রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা শহরে আছে ১৮টি স্টেশন ও দুটি বিশেষ টিম। ফায়ার সার্ভিসের মোট জনবল ১৪ হাজার ৫৬০ জন। এর মধ্যে ঢাকার স্টেশনগুলোতে আছেন ৬৫০ কর্মী। ভূমিকম্পের পর উদ্ধার অভিযানের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও কম আছে ফায়ার সার্ভিসের কাছে। হাইড্রোলিক কাটার, হাইড্রোলিক স্প্রেডার, হাইড্রোলিক র্যাম, এয়ার লিফটিং ব্যাগ, সার্চ ভিশন ক্যামেরা, রোটারি রেসকিউ ‘স’, চিপিং হ্যামার, রেসিপ্রোকেটিং ‘স’ ও চেইন ‘স’ বেশি প্রয়োজন হলেও এগুলোর সংখ্যা পর্যাপ্ত নয়।
ভূমিকম্প ও অগ্নিকাণ্ডের ক্ষতির ধরন ভিন্ন বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল। তিনি বলেন, ‘ভূমিকম্প আর অগ্নিকাণ্ডের ক্ষতির ধরন একটু ভিন্ন। ভূমিকম্প হলে সাধারণত ভবন বা স্থাপনা ধসে পড়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার ঝুঁকি থাকে। ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার তৎপরতার জন্য অগ্নিনির্বাপণের মতো বড় গাড়ি-পাম্প ব্যবহার করা যায় না। ছোট ছোট যন্ত্রপাতি, যেগুলো হাতে বহন করা যায় সেগুলো ব্যবহার করতে হয়। এ ধরনের যন্ত্রপাতি ফায়ার সার্ভিসের রয়েছে। আমাদের কর্মীরা তুরস্ক ও মিয়ানমারের ভূমিকম্পে উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। কাজেই আমাদের অভিজ্ঞ জনবল ও যন্ত্রপাতি রয়েছে। তবে আমরা জনবলের ঘাটতি পূরণ এবং সক্ষমতা আরো বৃদ্ধির চেষ্টা করছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘এটা সত্য যে ভূমিকম্পে বড় পরিসরে ক্ষয়ক্ষতি হলে বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামে প্রচুর প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে। এজন্য একটি বিশেষ রেসকিউ টিম পর্যাপ্ত নয়। সম্মিলিতভাবে সব প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। এছাড়া ৬২ হাজারের টার্গেট নিয়ে আমরা এরই মধ্যে ৫৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবককে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। আরো স্বেচ্ছাসেবক তৈরির চেষ্টা করছি। আমরা বিভিন্ন প্রচারণা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমেও সাধারণ জনগণকে সচেতন করে তোলার চেষ্টা করছি। আশা করি প্রয়োজনে তারাও আমাদের পাশে এসে উদ্ধারকাজে সহযোগিতা করবেন।’
২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে গত শনিবার সকাল ১০টা ৩৬ মিনিটে ৩ দশমিক ৩ মাত্রার এবং সাড়ে ৭ ঘণ্টা পর সন্ধ্যা ৬টার দিকে আরো একটি ভূমিকম্প হয়, রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৩। এ ভূমিকম্প দুটোরই উৎপত্তি ছিল নরসিংদীতে। সন্ধ্যায় কাছাকাছি সময়ে আরো একটি ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিল রাজধানীর বাড্ডা; যার মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৭। এর আগে শুক্রবার সকালে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে ১০ জনের মৃত্যু হয়। আহত হয় সহস্রাধিক। এসব মৃদু ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পকে বড় ভূমিকম্পের সতর্কবার্তা হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।