Logo
Logo
×

জাতীয়

কেন শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ বিষয়ে ভারত শিগগিরই সিদ্ধান্ত নেবে না

Icon

জাগো বাংলা প্রতিবেদন

প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৫, ০৩:১৭ এএম

কেন শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ বিষয়ে ভারত শিগগিরই সিদ্ধান্ত নেবে না

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) ১৭ নভেম্বরের রায়ের পর বাংলাদেশ ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের দাবি জোরদার করেছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে, অনুপস্থিতিতে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পর থেকেই এ দাবি আরও জোরালো হয়েছে।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইসিটির রায় স্বীকার করে জানিয়েছে—যে "বাংলাদেশে শান্তি, গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তি ও স্থিতিশীলতাকে" ভারত সমর্থন করে। তবে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ বিষয়ে ঢাকা কোনো আনুষ্ঠানিক অনুরোধ পাঠিয়েছে কি না—সে বিষয়ে নয়াদিল্লি মন্তব্য করা থেকে বিরত রয়েছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে হাসিনা ভারতে অবস্থান করছেন।

রায়ের পর থেকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)—সকলেই দ্বিপাক্ষিক প্রত্যর্পণ চুক্তির ধারায় তাকে ফেরত আনার দাবি তুলে চাপ বাড়িয়েছে।

২০১৩ সালের ভারত–বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তি সই হয়, এবং ২০১৬ সালে তা সংশোধন করা হয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকরা বলছেন, হাসিনাকে প্রত্যর্পণের বিষয়টি আইনি ও রাজনৈতিক— এ দুই মাত্রাই সামনে এনেছে।

ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন, নয়াদিল্লি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানানোর আগে ঢাকা থেকে বেশ কয়েকটি নির্দিষ্ট আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়া প্রয়োজন।

বীণা সিক্রির একটি সাক্ষাৎকার এবং আইন বিশেষজ্ঞ প্রভাষ রঞ্জনের বিশ্লেষণী নিবন্ধের ওপর ভিত্তি করে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ প্রসঙ্গে জটিলতাগুলো আরও স্পষ্টভাবে দেখার সুযোগ আছে।

ভারত কি রাজনৈতিক ঝুঁকি নেবে—আইনি ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে পুরোনো মিত্রকে ফেরত পাঠাতে?

রোববার (২৩ নভেম্বর) ঢাকায় ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রি বলেন—চুক্তিতে এমন কিছু ধারা আছে যা "রাজনৈতিক নিপীড়ন" থেকে কোনো অভিযুক্তকে সুরক্ষা দিতে পারে। এই ধারা ভারতকে শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে আইনি অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে পারে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যর্পণের অনুরোধ পাঠায়নি।

বীণা সিক্রির ভাষায়, ভারতকে পাঠানো বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নোট ভার্বালকে কোনোভাবেই প্রত্যর্পণ অনুরোধ হিসেবে গণ্য করা যায় না। এমন আবেদন পাঠাতে হলে পুরো বিচার নথি ও প্রাসঙ্গিক প্রমাণাদি দিতে হয়—তারপরই ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিক্রিয়া দিতে বাধ্য।

তিনি আরও বলেন, প্রত্যর্পণ সাধারণত দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া, যাতে কয়েক মাস বা বছর লেগে যেতে পারে। শেখ হাসিনার বিচারের প্রক্রিয়া নিয়ে ভারত উদ্বেগে আছে—বিশেষত তিন আইসিটির বিচারকের স্থায়ী নিয়োগ, যা বাংলাদেশ সংবিধানের ৯৮ অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে।

ভারতীয় এই কূটনীতিকের আরও মন্তব্য, এই বিচারকদের কারোই মানবতাবিরোধী অপরাধ-বিষয়ক বিচারে আন্তর্জাতিক আইনি মানদণ্ড প্রয়োগের অভিজ্ঞতা নেই।

বীণা সিক্রি প্রশ্ন তোলেন ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ার নিয়ে। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩, এর ২০০৯ সালের সংশোধন শুধুমাত্র ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধ বিচারের জন্য করা হয়েছিল। কিন্তু সম্প্রসারিত এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে—যা কোনো সংসদ দ্বারা অনুমোদিত নয়।

তিনি বলেন, এতে সাংবিধানিক প্রশ্নও ওঠে, বিশেষত রাষ্ট্রপতির ৯৩ অনুচ্ছেদে অধ্যাদেশ জারির ক্ষমতা নিয়ে স্পষ্টতা নেই, যখন সংসদ ভেঙে দেওয়ার প্রতিষ্ঠিত নিয়মও মানা হয়নি।

তিনি প্রশ্ন তোলেন আইসিটির চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম এবং বিশেষ উপদেষ্টা টবি ক্যাডম্যানের নিয়োগ নিয়েও। তাজুল ইসলামের নিয়োগে প্রসিকিউটরের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে, আর ক্যাডম্যান অতীতে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বিচারে জামায়াত নেতাদের পক্ষে কাজ করেছিলেন—যা "প্রতিশোধমূলক উদ্দেশ্য" বা "স্বার্থসংঘাত" এর ধারণা তৈরি করতে পারে।

বীণা সিক্রি বলেন, আইনি প্রশ্ন ছাড়াও আরও একটি রাজনৈতিক সংকট আছে। দীর্ঘদিনের মিত্রকে [হাসিনা] ফেরত পাঠিয়ে ভারত কি রাজনৈতিক ঝুঁকি নেবে? বিশেষত আঞ্চলিক অস্থিরতার সময়ে যখন নয়াদিল্লি তার "প্রতিবেশী প্রথম" নীতি পুনর্গঠন করছে।

১৭ নভেম্বর, যেদিন হাসিনার রায় ঘোষণা করা হয়, সেদিনই বাংলাদেশ ভারতকে আহ্বান জানায় যাতে আইসিটিতে জুলাইয়ের হত্যাকাণ্ডে দোষী সাব্যস্ত ও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া "পলাতক দণ্ডিত" হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে অবিলম্বে প্রত্যার্পণ করা হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতি অনুযায়ী, দুই দেশের মধ্যে থাকা প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুসারে তাদের দুজনকে হস্তান্তর করাটা 'ভারতের জন্য অবশ্যপালনীয় দায়িত্বও বটে'।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও জানায়, মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী ব্যক্তিদের আশ্রয় দেওয়া হবে অত্যন্ত অবন্ধুসুলভ আচরণ এবং ন্যায়বিচারের প্রতি অবজ্ঞার শামিল।

সেদিনই পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন জানান, ভারতের কাছে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের প্রত্যর্পণের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি পাঠানো হবে। সেদিন সন্ধ্যায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, "আজ রাতেই হোক বা কাল—চিঠি অবশ্যই যাবে।"

আইসিটি নিরপেক্ষে না হলে কি আইসিসি হস্তক্ষেপ করতে পারে?

ভারতের সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস–এ প্রকাশিত ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির জিন্দাল গ্লোবাল ল স্কুলের অধ্যাপক ও ভাইস ডিন প্রভাষ রঞ্জনের নিবন্ধ অনুযায়ী, হাসিনার প্রত্যার্পণ প্রশ্নটি নিরপেক্ষভাবে বিবেচনা করা উচিত।

তার মতে, ২০১৩ সালের ভারত–বাংলাদেশ প্রত্যার্পণ চুক্তি অনুযায়ী কোনো প্রত্যার্পণ অনুরোধের সঙ্গে অপরাধের প্রমাণ সংযুক্ত থাকা আবশ্যক—এমনটি বলা ভুল। তিনি উল্লেখ করেন যে [চুক্তির] অনুচ্ছেদ ১০(৩)-এ প্রাথমিকভাবে এমন শর্তাদি ছিল, এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আদান–প্রদানের বিধানও ছিল, কিন্তু ২০১৬ সালের সংশোধনীর মাধ্যমে এসব শর্ত বাতিল করা হয়।

২১ নভেম্বর প্রকাশিত ওই নিবন্ধে রঞ্জন লিখেছেন যে, সংশোধিত অনুচ্ছেদ ১০(৩)–এ এখন শুধু গ্রেপ্তারি পরোয়ানা এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির পরিচয় নিশ্চিতকারী প্রমাণই প্রত্যার্পণের জন্য প্রয়োজন। হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালেই এই সংশোধনী আনা হয়েছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল প্রত্যার্পণ প্রক্রিয়া দ্রুততর করা।

ভাগ্যচক্রে এখন এই একই সংশোধনী হাসিনার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হচ্ছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ যখন গ্রেপ্তারি পরোয়ানার ভিত্তিতে হাসিনার আনুষ্ঠানিক প্রত্যার্পণ চায়, তখন তাকেই একই সংশোধনীর আওতায় ফেরত পাঠাতে বলা হয়েছিল।

তবে রঞ্জন জোর দিয়ে বলেন, এই বিধান বর্তমানে হাসিনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, কারণ তিনি ইতোমধ্যে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। ফলে বাংলাদেশকে এখন নতুন করে একটি প্রত্যার্পণ অনুরোধ জমা দিতে হবে।

দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের জন্য প্রযোজ্য অনুচ্ছেদ ১০(৪) অনুযায়ী দুটি শর্ত পূরণ করতে হবে—প্রথমত, অনুরোধকারী রাষ্ট্রকে দণ্ড বা রায়ের সনদ প্রদান করতে হবে; দ্বিতীয়ত, ওই ব্যক্তি যেন আর রায় বা দণ্ড চ্যালেঞ্জ করার আইনগত সুযোগ না রাখেন।

কিন্তু শেখ হাসিনা এখনো আইসিটির রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন—এ কারণে এই মুহূর্তে অনুচ্ছেদ ১০(৪) অনুযায়ী প্রত্যর্পণ আবেদন করা যাবে না। বাংলাদেশের আইন অনুসারে, যখন সব ধরনের আইনি প্রতিকার লাভের সুযোগ তার আর থাকবে না, তখনই কেবল প্রত্যর্পণের অনুরোধ করা যাবে।

তিনি বলেন, ৬(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, অপরাধের ধরন রাজনৈতিক চরিত্রের হলে প্রত্যর্পণ না করার যে ধারাটি নিয়ে অনেকেই কথা বলছেন—তা এখানে প্রযোজ্য নয়। কারণ ৬(২) অনুচ্ছেদে বলা আছে—হত্যাসহ কিছু অপরাধ কখনোই রাজনৈতিক নয়। মানবতাবিরোধী অপরাধও সেই তালিকায় পড়ে। হাসিনা যেহেতু মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন, সেহেতু তারক্ষেত্রে রাজনৈতিক ব্যতিক্রমের ধারা প্রযোজ্য হবে না।

তবে ভারত চাইলে ৮(১)(a)(iii) ধারায় প্রত্যর্পণ প্রত্যাখ্যান করতে পারে—যদি অভিযুক্ত প্রমাণ করতে পারে যে তার প্রত্যর্পণ "অন্যায় বা দমনমূলক হবে," বা অভিযোগ "বিচারের সৎ উদ্দেশ্য থেকে করা হয়নি।"

তিনি বলেন, হাসিনার বিচার প্রক্রিয়া ঘিরে রাজনৈতিক বিদ্বেষের অভিযোগ থাকায় এ ধারাটি ব্যবহারযোগ্য হতে পারে।

রঞ্জন আরও বলেন, আইসিটির নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকারের অনির্বাচিত চরিত্র আন্তর্জাতিক আইনের চোখে বিচার বাতিলের কারণ নয়। কারণ এটি কার্যকরভাবে দেশ পরিচালনাকারী 'ডি ফ্যাক্টো' সরকার—যাকে ভারতসহ অধিকাংশ দেশ স্বীকৃতি দিয়েছে। সুতরাং, আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে এটি একটি বৈধ সরকার।

২০ নভেম্বর অন্তুর্বর্তী সরকার জানায়—হাসিনা ও কামালকে ফেরত আনার বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) যাওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের আইন উপদেষ্টা বলেন, 'এই দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ফেরত আনার বিষয়ে আমরা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যেতে পারি কি না—তা নিয়ে শিগগিরই একটি বৈঠক করব।'

হাসিনার পক্ষ থেকে তার মামলাটি হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) পাঠানোর জন্য ইউনুস সরকারের কাছে যে আহ্বান জানানো হয়েছে, সে বিষয়ে রঞ্জন ব্যাখ্যা করেন যে রোম সংবিধির অধীনে আইসিসি পরিপূরকতার নীতি অনুযায়ী কাজ করে—অর্থাৎ আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার করার মূল অধিকার ও দায়িত্ব জাতীয় আদালতের।

অর্থাৎ, জাতীয় আদালত বিচারে অক্ষম বা অনিচ্ছুক হলে তবেই আইসিসি হস্তক্ষেপ করে। কিন্তু বাংলাদেশের আইসিটি যেহেতু বিচার করছে—তাই আইসিসি শুধুমাত্র তখনই হস্তক্ষেপ করতে পারবে যদি আইসিটির নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ বলে প্রমাণিত হয়।

আইসিটির কর্মকাণ্ড নিয়ে  উদ্বেগের প্রেক্ষিতে, রঞ্জন যুক্তি দেন যে—যদি অন্যান্য শর্ত পূরণ হয়—তাহলে মামলাটি সম্ভাব্যভাবে আইসিসির বিচারযোগ্যতার আওতায় আসতে পারে।

সূত্র : টিবিএস

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: মহিউদ্দিন সরকার