Logo
Logo
×

জাতীয়

সামনে বড় ভূমিকম্পের আভাস : ঢাকা ঘিরেই বিপদের শঙ্কা

Icon

জাগো বাংলা প্রতিবেদন

প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২৫, ০৩:৩৮ এএম

সামনে বড় ভূমিকম্পের আভাস : ঢাকা ঘিরেই বিপদের শঙ্কা

শুক্রবারের ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের পর শনিবার সকাল ও সন্ধ্যায় আরও তিনটি ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায়। প্রায় ৩২ ঘণ্টার ব্যবধানে চারবার ভূমিকম্প হয়েছে। এদিন তিনটি ভূমিকম্পের মধ্যে একটির উৎপত্তিস্থল নরসিংদী। বাকি দুটির উৎপত্তিস্থল খোদ রাজধানী ঢাকার বাড্ডায়। এসব ‘আফটার শক’ বড় ভূমিকম্পের লক্ষণ হতে পারে। এমনটিই জানিয়েছেন কয়েকজন বিশেষজ্ঞ।

তারা বলেন, বড় ধরনের ভূমিকম্পের শক্তি যেখানে ঘনীভূত হয়, তাকে ভূতাত্ত্বিক ভাষায় সাবডাকশন জোন বলা হয়। বাস্তবতা বলে দিচ্ছে, ঢাকার অবস্থান এই জোনের কাছাকাছি। এছাড়া ঢাকায় বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার মতো অবস্থা এখন ভূগর্ভে বিরাজমান। তাদের মতে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও ভয়ংকর ভূমিকম্পগুলো সাবডাকশন জোন ও এর আশপাশেই হয়ে থাকে। 

তবে এ নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে সবাইকে প্রস্তুতি নিতে হবে। মনোবল হারানো যাবে না। একই সঙ্গে ৭-৮ মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল করে ভবন নির্মাণে সবাইকে দৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বাড়ির সামনে প্রশস্ত রাস্তা থাকাও জরুরি। ইতোমধ্যে নিয়মবহির্ভূতভাবে যেসব ভবন নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলো দ্রুত চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেই হবে।

শুক্রবার সকালে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানার পর রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বেশির ভাগ এলাকার মানুষের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক ভর করেছে। উপরন্তু, ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই আফটার শক হিসাবে মাত্র ৩২ ঘণ্টার ব্যবধানে চারবার ভূমিকম্প হওয়ায় সবাইকে আরও বেশি উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। 

অনেকের মধ্যে এখন একটাই প্রশ্ন ও জানার আগ্রহ-বড় ধরনের ভূমিকম্প কি ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে। না জানি কখন ৬ কিংবা তারও বেশি মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। সে রকম কিছু হলে কতশত ভবন ধসে পড়বে। লাখ লাখ মানুষ মারা যাবে। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডও ঘটবে। কে কাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্স কি ঠিকঠাক আসতে পারবে। হাসপাতালগুলো কি ভূমিকম্পে টিকে থাকবে। যে ভবনে বসবাস করছেন সেটি কত মাত্রার ভূমিকম্পে টিকে থাকবে, কর্মস্থলের ভবন কতটা ভূমিকম্প সহনশীল। এসব সক্ষমতা পরিমাপ করার মতো আধুনিক যন্ত্রপাতি কি রাজউক কিংবা সরকারি সংস্থাগুলোর আছে? এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। বড় বিপদ আঁচ করতে পেরে কেউ কেউ আবার বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে দেশের কোথায় গেলে ভূমিকম্প থেকে নিরাপদে থাকা যাবে সেটি নিয়েও ভাবছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জনমনে এমন সব শঙ্কা দূর করতে সরকারের তরফ থেকে জনগণকে বেশি করে সচেতন করার পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি সাহস জোগাতে ব্যাপক কর্মসূচি নেওয়া দরকার। এ সেক্টরের সুপরিচিত বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে জাতীয় কমিটি গঠন করাসহ সভা-সেমিনারের আয়োজন করতে হবে। বিশেষ করে যেসব ভবন ভূমিকম্পের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, তা দ্রুত চিহ্নিত করার ব্যবস্থা নিতে হবে।

উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার আরও তিন ভূমিকম্প : শনিবার সকাল ১০টা ৩৬ মিনিট ১২ সেকেন্ডে দিনের প্রথম ভূমিকম্পটি হয়। এর উৎপত্তিস্থল নরসিংদীর জেলার পলাশ উপজেলা। মৃদু এ ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৩ দশমিক ৩। এদিন সন্ধ্যায় আরও দুটি ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে ঢাকা ও এর আশপাশ। দুটি ভূমিকম্পেরই উৎপত্তিস্থল রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত এলাকা বাড্ডা। এর মধ্যে সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিট ৪ সেকেন্ডে রিখটার স্কেলে ৩ দশমিক ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়। এর এক সেকেন্ড পরই ৬টা ৬ মিনিট ৫ সেকেন্ডে দ্বিতীয়বার ভূমিকম্প হয়। রিখটার স্কেলে যার মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৩।

এভাবে ঢাকা ও এর সন্নিকটে নরসিংদীতে প্রায় ৩২ ঘণ্টার ব্যবধানে চারবার ভূমিকম্প হওয়ার প্রভাব কি হতে পারে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও ভূতাত্ত্বিক ড. মো. আনোয়ার হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি জেলা বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে। 

বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক দিক থেকে তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। এর মধ্যে পূর্ব পাশে বার্মিজ সাবপ্লেটের নিচে ইন্ডিয়ান প্লেটের একটি অংশ তলিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে উত্তর দিকে ইউরেশিয়ান প্লেটে তলিয়ে যাচ্ছে ইন্ডিয়ান প্লেট। আবার বার্মিজ সাবপ্লেটও ইউরেশিয়ান প্লেটেরই অংশ। ইউরেশিয়ান প্লেটের উত্তরাংশে একদিকে ইন্ডিয়ান প্লেট তলিয়ে যাচ্ছে। আবার ইউরেশিয়ান প্লেটের পূর্বাংশে যেটিকে বার্মিজ সাবপ্লেট বলা হয় সেটিও নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। এই তলিয়ে যাওয়াকে সাবডাকশন বলে। যে প্লেটটি আস্তে আস্তে তলিয়ে যাচ্ছে সেটি সাবডাক্টিং প্লেট। আর যে প্লেটটি উপরে চড়ে বসে সেটি অবডাকটিং প্লেট।

তিনি বলেন, তলিয়ে যাওয়া এ সাবডাকশন জোন সিলেট থেকে শুরু হয়ে টেকনাফ পার হয়ে জাভা সুমাত্রা পর্যন্ত বিস্তৃত। এই জোনটি ঢাকার কাছাকাছি। চট্টগ্রাম ও সিলেট এলাকা এই জোনের কাছাকাছি। সাবডাকশন জোনে পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহত্তম ভূমিকম্পগুলো সংঘটিত হয়। 

সেক্ষেত্রে ঢাকাসহ কয়েকটি শহর সাবডাকশন জোনের কাছাকাছি অবস্থিত। এজন্য বড় ভূমিকম্প হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। উত্তর পাশে আছে ডাউকি ফল্ট। যেটি নেত্রকোনা হয়ে সিলেটে ডাউকি হয়ে ভারতের বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে লম্বা একটি জোন। ভূমিকম্প হওয়ার মতো দুটি জোন আমাদের একেবারেই কাছে। ঐতিহাসিকভাবেও এটি প্রমাণিত যে এখানে বড় ভূমিকম্প হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ঢাকা শহরের আশপাশে মধুপুরেও অনেক ফল্ট আছে। এমনকি শীতলক্ষ্যা নদীকেও ফল্ট কনট্রোলড বলা হয়। সাধারণত ভূমিকম্প হলে সাবডাকশন জোনের কাছাকাছিই হয়। ফলে ভূমিকম্প হওয়ার মতো ঐতিহাসিক প্রমাণ ও ফিজিক্যাল কারণ দুটোই এখানে বিদ্যমান।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ আর্থকোয়াক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ঢাকা ও তার আশপাশে মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পগুলো বড় ভূমিকম্পের আভাস হতে পারে। তিনি বলেন, নরসিংদীর পলাশেই শনিবার সকালে আরেকটি ছোট ভূমিকম্প হয়েছে এবং সন্ধ্যায় হয়েছে ঢাকার বাড্ডায় পরপর দুটি। এভাবে ছোট ছোট ভূমিকম্প হওয়া খারাপ লক্ষণ। বড় ভূমিকম্প হওয়ার আগে এগুলো ‘ফোরশক’ হতে পারে। তবে বড় ভূমিকম্প হবে কিনা তার জন্য আরও ২-৩ দিন অপেক্ষা করতে হবে। এরকম আরও কয়েকটি ফোরশক হলে তখন বুঝে নিতে হবে সামনে বড় একটি ভূমিকম্প হতে পারে। আর সে রকম অবস্থার সৃষ্টি হলে ঢাকা ও তার আশপাশে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে এ বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে-যদি এরকম ছোট ছোট কিছু ভূমিকম্প আগামী কয়েক দিনে হতে থাকে।

ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, এ ধরনের ছোট ছোট ভূমিকম্প আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। এটি মানসিক স্বাস্থ্য নষ্ট করে। ইতোমধ্যে শুক্রবারের ভূমিকম্পে অনেকেই ট্রমাটাইজড হয়ে আছেন।

তিনি বলেন, ঢাকার পূর্ব এবং উত্তর দিকে ভূমিকম্পের প্রধান দুটো উৎস ‘সাবডাকশন জোন’। যেটি আসলে ডাউকি ফল্ট। সেখানে যদি ভূমিকম্প হয় তাহলে সবচেয়ে ক্ষতি হবে ঢাকায়। তবে বড় ভূমিকম্প মূল ঢাকায় নাও হতে পারে। কিন্তু একই জোনে কয়েকটি ছোট-মাঝারি ভূমিকম্পও বড় ক্ষতি করতে পারে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: মহিউদ্দিন সরকার