ভূমিকম্পের প্রভাবে আরও কতবার হতে পারে ‘আফটারশক’, ঝুঁকি কতটা?
জাগো বাংলা প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:৪৫ পিএম
রাজধানীতে দুইবার ভূমিকম্প হয়েছে শনিবার সন্ধ্যায়। মাত্র দুই সেকেন্ডে ঘটে যাওয়া দুটি ভূমিকম্পেরই উৎপত্তিস্থল রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এ নিয়ে গত সাড়ে ৩১ ঘণ্টায় চারবার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছে ঢাকা ও এর আশপাশ।
সবশেষ তিনটি ভূকম্পন মূলত গতকাল শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে হওয়া জোরালো ভূমিকম্পেরই প্রভাব, যাকে বলা হচ্ছে ‘আফটারশক’।
ভূমিকম্পের পর মাটির নিচে জমে থাকা চাপ পুরোপুরি কমে যায় না। মূল ভূমিকম্পের পর যে ছোট ছোট কম্পনগুলো অনুভূত হয়, সেগুলোই আফটারশক নামে পরিচিত। এটি আসলে ভূমিকম্পেরই ধারাবাহিক ক্ষুদ্র প্রতিক্রিয়া।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ তরিফুল নেওয়াজ কবির জানান, আজ সন্ধ্যায় রাজধানীতে পরপর দুটি ভূমিকম্প হয়েছে। এর মধ্যে সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিট ৪ সেকেন্ডে রিখটার স্কেলে ৩ দশমিক ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়। এর এক সেকেন্ড পর সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিট ৫ সেকেন্ডে দ্বিতীয়বার ভূমিকম্প হয়। রিখটার স্কেলে এটির মাত্রা ৪ দশমিক ৩। দুটি ভূমিকম্পেরই উৎপত্তিস্থল ঢাকার বাড্ডা এলাকায়। একইদিন সকালে নরসিংদীতে আরও একটি মৃদু ভূমিকম্প হয়। জেলার পলাশ উপজেলায় সকাল ১০টা ৩৬ মিনিট ১২ সেকেন্ডে ভূমিকম্পটি অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৩।
এর আগে, গতকাল শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে আঘাত হেনেছিল মূল ভূমিকম্পটি, যাতে কেঁপে ওঠে রাজধানীসহ আশপাশের এলাকা। ওই ভূমিকম্পের সময় অনেকেই আতঙ্কে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসেন। শিশুসহ ১০ জন নিহত ও ছয় শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন এদিন। সবচেয়ে বেশি—পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে নরসিংদীতে। এছাড়া, ঢাকায় চার ও নারায়ণগঞ্জে একজন মারা যান। ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কে অনেকেই ভবন থেকে লাফিয়ে পড়েন। এছাড়া কিছু ভবন হেলে পড়ে ও ফাটল দেখা দেয়।
ভূতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রধান ভূমিকম্পে ভূ-পৃষ্ঠ বা ভূগর্ভে সৃষ্ট ফাটল একবারে স্থিতিশীল হয় না। তখন সেই ফাটলের ধার দিয়ে আরও ছোট ছোট শক্তির নির্গমন ঘটে। এর ফলেই রিখটার স্কেলে কম মাত্রার এসব কম্পন অনুভূত হয়, যা আফটারশক নামে পরিচিত।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই আফটারশক মূল ভূমিকম্পের কয়েক মিনিট পর থেকেই অনুভূত হতে পারে। আবার অনেক ক্ষেত্রে কয়েক ঘণ্টা বা কয়েকদিন পরও দেখা যায়।
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার (ইউএসজিএস) মতে, বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে আফটারশক কয়েক সপ্তাহ, এমনকি কয়েক মাস বা বছর ধরেও হতে পারে। তবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর মাত্রা ও ঘনত্ব কমতে থাকে।
আফটারশকের কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা নেই। এটি একবার, দশবার, শতবার, এমনকি হাজারবারও হতে পারে। আফটারশক মূলত ভূমিকম্পের মাত্রা, স্থলভাগের গঠন এবং ভূগর্ভস্থ চাপের ওপর নির্ভর করে। বড় ভূমিকম্পের পর বেশি সংখ্যক ও দীর্ঘস্থায়ী আফটারশক দেখা যায়।
ভূমিকম্পের পর সাধারণত সবচেয়ে বেশি আফটারশক হয় প্রথম ৭২ ঘণ্টার মধ্যে। এই সময়টিকে ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, এই সময় ভবনের বাইরে খোলা জায়গায় থাকতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত ভবনে অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করা যাবে না।
আফটারশক কখনো বড় ক্ষতির কারণও হতে পারে। বিশেষ করে, যখন মূল ভূমিকম্পে ভবনগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে ছোট আফটারশকেও সেগুলো ধসে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
অতএব, ভূমিকম্পের পর কেবল একটি বড় কম্পন শেষ হলেই যে সব শেষ, তা নয়—বরং আফটারশকই তৈরি করে পরবর্তী ঝুঁকি ও সতর্কতা। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভূমিকম্পের পর নিরাপত্তা বজায় রাখতে জনগণকে সবচেয়ে বেশি সচেতন থাকতে হবে এই আফটারশক নিয়েই।
ভূমিকম্পের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হচ্ছে, এর পূর্বাভাস কখনও নির্ভুলভাবে দেওয়া যায় না। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি অদূর ভবিষ্যতে সম্ভব হবে, এমন আশাও খুব কম। বহু বছর ধরে নানা পদ্ধতি ব্যবহার করে ভূমিকম্প পূর্বাভাসের চেষ্টা করা হলেও একটিও সফল হয়নি।
তবে ভূতাত্ত্বিকরা কোনো নির্দিষ্ট ফল্ট লাইনে ভবিষ্যতে আবার ভূমিকম্প হবে, এটি নিশ্চিতভাবেই বলতে পারেন। কারণ, ভূগর্ভস্থ স্তরে শক্তি জমতে থাকলে একসময় তা ভূমিকম্পের মাধ্যমেই নির্গত হয়। কিন্তু ঠিক কখন সেই শক্তি মুক্তি পাবে, এটি নির্দিষ্ট করে জানানোর কোনো বৈজ্ঞানিক উপায় এখনও আবিষ্কৃত হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূমিকম্পের সময় নির্ভুলভাবে জানানো সম্ভব না হলেও, ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল নির্ধারণ, ভবন নির্মাণের সুরক্ষা বিধি তৈরি এবং আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা চালু করে ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই কমানো যায়।