নরসিংদীর মাধবদী কীভাবে শক্তিশালী ভূমিকম্পের কেন্দ্রে পরিণত হলো?
জাগো বাংলা প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:২৮ পিএম
রাজধানী ঢাকার কাছে নরসিংদীর মাধবদীতে শুক্রবার যে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়েছিলো তাতে কেঁপে ওঠেছিলো রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশ এবং ভূমিকম্পের জেরে এখন পর্যন্ত মারা গেছে অন্তত দশ জন, আর আহত হয়েছে পাঁচশোর বেশি মানুষ।
ঢাকা থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে নরসিংদীর জেলার মাধবদী উপজেলায় মাটির প্রায় ১০ কিলোমিটার গভীরে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ওই ভূমিকম্পের শক্তি জমছে বলে জানিয়েছে দেশি বিদেশি সংস্থা ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক সংস্থা ইউএসজিএস-এর মতে, বাংলাদেশের ৭ কোটির মতো মানুষ মৃদু বা হালকা ঝাঁকুনি অনুভব করেছেন।
শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী ভূমিকম্পটিকে স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প হিসেবে বর্ণনা করেছে বাংলাদেশের আবহাওয়া বিভাগও।
এরপর আজ শনিবার আবারও মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিলো ৩ দশমিক ৩, যার উৎপত্তিস্থল নরসিংদী জেলারই পলাশ উপজেলা।
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, মাধবদীর যেই ভূমিকম্প সারাদেশে, বিশেষ করে ঢাকায় যে তীব্র আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে তার কারণ কি? কিংবা ঢাকা শহরে ব্যাপক ঝাঁকুনি দেয়া এই ভূমিকম্প সম্পর্কে আর কী জানা যাচ্ছে?
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলছেন, মাধবদী ভূমিকম্পের কারণ ভূগর্ভে ইন্ডিয়ান প্লেট ও বার্মিজ প্লেটের অবস্থান পরিবর্তন।
মাধবদীর ভূমিকম্প নিয়ে আর কী জানা যাচ্ছে
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূতাত্ত্বিক চলমান প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠ কয়েকটি টেকটনিক প্লেটে বিভক্ত, যেগুলো ভূগর্ভে তরল পদার্থের ওপর ভাসছে এবং এই প্লেটগুলো গতিশীল- একে অপরের সাপেক্ষে অবস্থান পাল্টাচ্ছে।
তবে এর বাইরে অনেক জায়গায় সাব-প্লেট ক্রিয়াশীল আছে। যেসব স্থানে একটি প্লেট এসে আরেকটি প্লেটের কাছাকাছি মিশেছে বা ধাক্কা দিচ্ছে বা ফাটলের তৈরি হয়েছে, সেটাকে বলা হয় ফল্ট লাইন। বাংলাদেশে এমন কয়েকটি ফল্ট লাইন আছে।
এই প্লেটগুলো যখন সরে যায় বা নড়াচড়া করতে থাকে কিংবা একটি অন্যদিকে ধাক্কা দিতে থাকে, তখন এক ধরনের শক্তি সঞ্চিত হতে থাকে।
আর সেই শক্তি যখন সেখানকার শিলার ধারণ ক্ষমতার পেরিয়ে যায়, তখন আগে থেকে থাকা কিংবা নতুন তৈরি হওয়া ফাটল কিংবা শিলা ব্লক একটি আরেকটির উপরে উঠে গেলে সেখানে সঞ্চিত শক্তি বেরিয়ে আসলেই ভূ-পৃষ্ঠে কম্পন অনুভূত হয়। মূলত এটিই ভূমিকম্প।
বিশেষজ্ঞ মত অনুযায়ী, বাংলাদেশে বড় ধরনের ভূমিকম্পের প্রধান উৎস দুটো। এর একটি হলো ‘ডাউকি ফল্ট’, যা ভারতের শিলং মালভূমির পাদদেশে বাংলাদেশের ময়মনসিংহ-জামালগঞ্জ-সিলেট অঞ্চলে বিস্তৃত যা প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ।
আরেকটি হলো: সিলেট থেকে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, টেকনাফ পর্যন্ত যা সব মিলিয়ে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা পর্যন্ত বিস্তৃত। এই উৎসটিকে খুব ভয়ংকর বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
টেকটনিক প্লেটে বাংলাদেশের যে অবস্থান তাতে দুটো প্লেটের সংযোগস্থল রয়েছে- পশ্চিমে ইন্ডিয়ান প্লেট আর পূর্ব দিকে বার্মা প্লেট। আর বাংলাদেশের উত্তরদিকে আছে ইউরেশিয়ান প্লেট।
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলছেন, ভারতীয় প্লেটটি ধীরে ধীরে পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে বার্মা প্লেটের নিচে অর্থাৎ চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, তলিয়ে যাওয়ার কারণে একটা সাবডাকশান জোনের তৈরি হয়েছে। আর নটরিয়াস (ভয়ংকর অর্থে) এই জোনের ব্যাপ্তি সিলেট থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত। পুরো চট্টগ্রাম অঞ্চল এর মধ্যে পড়েছে। এখানে বিভিন্ন সেগমেন্ট আছে। আমাদের এই সেগমেন্টে ৮.২ থেকে ৯ মাত্রার শক্তি জমা হয়ে আছে। এটা বের হতেই হবে।
তার মতে, নরসিংদীর মাধবদীতে যে ভূমিকম্পের উৎস ছিলো সেই এই সেগমেন্টেরই এবং নরসিংদীতে দুই প্লেটের যেখানে সংযোগস্থল, সেখানেই ভূমিকম্প হয়েছে।
মাধবদির ভূমিকম্প প্রসঙ্গে সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, এখানে প্লেট লকড হয়ে ছিলো। এর অতি সামান্য ক্ষুদ্রাংশ খুললো বলেই শুক্রবারের ভূমিকম্প হয়েছে। এটিই ধারণা দেয় যে সামনে বড় ভূমিকম্প আমাদের দ্বারপ্রান্তে আছে।
তবে শুক্রবার মাধবদী ভূমিকম্পের পর আজ একই জেলার পলাশ উপজেলায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে, যার মাত্রা রিখটার স্কেলে ৩ দশমিক ৩ বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রুবাইয়াত কবির।
৮০০ বছর ধরে শক্তি জমছে
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞদের মতে, দুই প্লেটের সংযোগস্থলে শক্তি সঞ্চয় হচ্ছে আটশ বছরের বেশি সময় ধরে। সেখানে ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রার ভূকম্পন তৈরির মতো শক্তি জমা হয়ে আছে বলে বলছেন সৈয়দ হুমায়ুন আখতার।
তিনি বলেন, এটা বের হবেই। মাধবদীর ভূমিকম্পের কারণে এখন সামনে সহজেই সেই শক্তি বের হয়ে আসতে পারে। আর সেটি হলে আমাদের ঢাকা নগরীর একটি মৃত্যুপুরী হয়ে ওঠার আশংকা আছে। সে কারণে আর অবহেলা না করে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের এই অঞ্চলে আগেও বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে, এমনকি ভূমিকম্পে নদীর গতিপথ বদলে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। তবে সেগুলো ছিল সিলেট ও চট্টগ্রাম এই দুটো উৎসের বাইরে।
এ ধরনের ভূমিকম্পে ১৭৯৭ সালে ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ বদলে গেছে । এখনকার মেঘনা নদী এক সময় লালমাই পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে প্রবাহিত হতো। বড় ধরনের ভূমিকম্পের ফলে এই নদীর গতিপথও পরিবর্তিত হয়ে ২০ থেকে ৪০ কিলোমিটার পশ্চিমে বর্তমান অবস্থানে সরে আসে।
১৭৬২ সালে টেকনাফ থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত ৮.৫ মাত্রার ভূমিকম্পে সেন্টমার্টিন দ্বীপ তিন মিটার উপরে উঠে আসে। সিলেটের মৌলভীবাজার, কিশোরগঞ্জ এই অঞ্চলে ১৯২২ সালে হয়েছিল ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্প। এর আগে ১৮৬৮ সালে ঐ অঞ্চলে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল।
ডাউকি ফল্ট যে অঞ্চলে সেই জৈন্তাপুর-সুনামগঞ্জে ৮দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল ১৮৯৭ সালে।
তবে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হতে পারে এমন দুটিই অঞ্চলের যেখানেই বড় কোনো ভূমিকম্প হলে অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে ঢাকাতেই বড় বিপর্যয়ের আশংকা প্রকাশ করে আসছেন বিশেষজ্ঞরা।