Logo
Logo
×

জাতীয়

জুতা সারানোর দায়িত্ব আমার কাছে গর্বের

Icon

জাগো বাংলা প্রতিবেদন

প্রকাশ: ২২ নভেম্বর ২০২৫, ১২:২৬ পিএম

জুতা সারানোর দায়িত্ব আমার কাছে গর্বের
রাজধানীর তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়া রেইলগেট। এখানের প্রতিদিন যে ভিড়, যে হইচই, তার মাঝেও; একটি মানুষ নিজের ছোট্ট পৃথিবীতে ডুবে থাকে। যেন চারপাশের কোলাহল আর ট্রেনের শব্দ তার কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। মানুষের নষ্ট স্যান্ডেল, ছেঁড়া জুতা, খুলে যাওয়া সোল এসবই তার কাছে গল্পের খাতা। আর সেই গল্প লিখে দেন তিনি সুই-সুতো আর আঠার ছোঁয়ায়। নাম তার শিবু। পেশায় একজন জুতার কারিগর। বয়স ৫৫, কিন্তু কাজের অভিজ্ঞতা টানা ৪২ বছরের। এই মহল্লার রাস্তাঘাটের সঙ্গে বহুদিনের বন্ধুত্ব তার।

সেদিন রাতে বাসায় ফেরার পথে জুতার সোল যায় খুলে। রাত তখন প্রায় এগারোটা। কোথাও দোকান খুঁজে না পেলেও রেইলগেটের এক কোণে আপন মনে কাজ করছিলেন শিবু। কাছে যেতেই হাতের কাজ সেরে সেলাইয়ের কাজটি করে দেন।

কথার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সকাল দশটা থেকে রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত কাজ করেন তিনি। মাঝে দুপুরে কিছু সময়ের জন্য বাসায় যান।’

দোকান বলতে চারপাশ জুড়ে কাঠের বোর্ড। বোর্ডে ঝুলছে বিক্রি উপযোগী কিছু জুতা। আর আছে জুতা মেরামতের আসবাবপত্র। এই তার রাজত্ব। মানুষ আসে, জুতা দিয়ে যায়, কেউ দাঁড়িয়ে দেখে আবার কেউ তাড়াহুড়োয় চলে যায়। কিন্তু শিবু ঠিকই নিজের গতিতে কাজ করেন। নেই তাড়াহুড়ো, নেই অভিযোগ।

শিবু বলছিলেন, ‘এই কাজটা আমার রক্তেই আছে। আমার নানা জুতার কাজ‌ করতেন। তার পাশে বসে বসেই শিখেছি সব।’ কথাটা বলতে বলতে তার চোখে যেন ঝিলিক খেলে গেল। ছোটবেলায় নানার দোকানের গন্ধ, চামড়া, আঠা, রং সবই তাকে টেনে নিয়ে যেত কাজ শেখার দিকে। ‘তখন তো আর মোবাইল-টোবাইল ছিল না, সারাদিনই খেলাধুলা আর দোকানে বসা। ধীরে ধীরে হাত পাকে’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

যুবক বয়সেই নিজের ছোটোখাটো জুতার কারখানা করেছিলেন শিবু। গর্বের সুরে বলেন, ‘নিজের বানানো জুতা হাতঘুরে কোথায় কোথায় গেছে বলতে পারবেন না! কেউ ঢাকায় পরছে, কেউ গ্রামে নিয়ে গেছে। তখন টেকসই জুতার খুব কদর ছিল।’

কিন্তু সময় ধীরে ধীরে বদলালো। টেকসই জুতার চাহিদা কমে গেল। মানুষ চাইলো হালকা, ফ্যাশনেবল, ডিজাইন জুতা। ‘ওই ডিজাইনার জুতার সঙ্গে আর পারলাম না। খরচও বেশি, লাভও কম। আর বাজারে এখন বিদেশি জুতার ছড়াছড়ি। আমার কারখানা বেশি দিন চালানো গেল না’ বলার সময় শিবুর কণ্ঠে তখন ছিল দীর্ঘশ্বাস।

এখন তার অবলম্বন রেললাইনের পাশে ছোট্ট এই দোকান। দিন চলে যায় জুতা সেলাই-ফেলাই করে, তবুও মন খারাপ হয় না তার। বরং কাজ করার সুযোগেই খুশি। ‘মানুষের পায়ে জুতা পড়ে থাকে। ওই জুতা ঠিক করার দায়িত্বটা আমার কাছে গর্বের’, বলেই হাসলেন তিনি।

আমার আগে মাঝবয়সী এক লোক ছেঁড়া জুতা নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। রাত হচ্ছে, বাসায় যেতে হবে তাই অস্থির তিনি। শিবু তখন তেমন কিছু বললেন না, শুধু কাজ করে যাচ্ছিলেন। তারপর দক্ষ হাতে আঠা লাগিয়ে, সেলাই করে জুতাটাকে প্রায় নতুন করে দিলেন। লোকটি যাওয়ার সময় বলছিলেন, বাসার সামনেই এক লোক জুতা ঠিক করে, তবুও আপনার কাছে এসেছি। আপনার কাজের ধরন আলাদা। শিবুর ঠোঁটের কোণে তখন ছিল সফলতার হাসি। এরপর‌ই তিনি আমার কাজে হাত দিয়েছিলেন।

জীবনের এত লম্বা পথ পেরিয়ে এসেও তার চোখে আফসোস কম, সন্তুষ্টি বেশি। আমি সৎ পথে উপার্জন করি, এটাই আমার শক্তি জোড় গলায় বললেন তিনি।
নাখালপাড়ার ধুলো, বৃষ্টি, রোদ সবকিছুর বিরুদ্ধে প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকে তার ছোট্ট দোকান। কিন্তু তার মনোবল? তা যেন আরও শক্ত, আরও টেকসই।
শিবু হয়তো আলো ঝলমলে দোকানের মালিক নন। তার নেই বড় কোনো ব্যানার বা বিজ্ঞাপন। কিন্তু যারা তার কাছে জুতা ঠিক করে নিয়েছে, তারা জানে এই দেশের লাখো মানুষ শিবুর মতো কারিগরদের উপর নির্ভরশীল। তারা আছে বলেই আমরা নিশ্চিন্তে জুতা পায়ে বের হতে পারি।
আরও পড়ুনআন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস কেন এত মলিনবিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ৭ পেশা

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: মহিউদ্দিন সরকার