Logo
Logo
×

জাতীয়

নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেটে এনআইডি সিন্ডিকেট

‘ডলার’ দিলে সহজেই মিলছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট, অন্যথায় তিন মাসের অপেক্ষা

Icon

জাগো বাংলা প্রতিবেদন

প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০২৫, ০২:৫৫ এএম

নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেটে এনআইডি সিন্ডিকেট

বিদেশের মাটিতে বসে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পাওয়া অনেকটা দুঃস্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে এই কার্যক্রম শুরু হতে না হতেই দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। সরকারি দপ্তর বলে কথা, ‘কয়লা ধুলে ময়লা যায় না’- এই প্রবাদটি সত্যি হতে চলেছে নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেটের ক্ষেত্রেও।  

এনআইডি কার্যক্রমকে ঘিরে কন্যুলেটে একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। নিয়মের ফাঁকফোকর গলিয়ে অর্থের বিনিময়ে তারা হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের অর্থ। আর এই অবৈধ আয়ের ভাগ হাত বদলে পৌঁছে যাচ্ছে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। এই সিন্ডিকেট তালিকায় রয়েছে কনস্যুলেটের কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী। সঙ্গে আছেন কয়েকজন কথিত অনলাইন সাংবাদিকও। সাংবাদিকতা পেশার আড়ালে যারা অ্যাপয়ন্টমেন্ট পাইয়ে দেওয়ার জন্য প্রবাসীদের পকেট কাটছেন। অথচ এনআইডি কার্যক্রম বিনামূল্যে দিচ্ছে সরকার। 

জাতীয় পরিচয়পত্র হলো বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও বাধ্যতামূলক নথি। ভোটাধিকার, জাতীয় পরিচয়, ড্রাইভিং লাইসেন্স, মটর যান রেজিস্ট্রেশন, পাসপোর্ট, জমি ক্রয় ও বিক্রয়, ব্যাংক হিসাব খুলতে, ব্যাংক ঋণ নিতে, টিন নাম্বার, মোবাইল সিম পেতে, সরকারি অনুদান ও ভাতা পেতে, চাকরির আবেদনসহ জাতীয় জনগুরুত্বপূর্ণ কাজে এনআইডির ব্যবহার একপ্রকার বাধ্যতামূলক। 

এসব কারণে বাংলাদেশিদের কাছে এনআইডির গুরুত্ব অপরিসীম। ১৮ বছর পূর্ণ হলে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন বরাবরে আবেদন করতে হয় এনআইডির জন্য। ২০০৮ সালে এনআইডি কার্যক্রম চালু হলেও প্রবাসীরা সুদীর্ঘকাল এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকার প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রদানের সিদ্ধান্ত নিলে গত ৩ অক্টোবর শুক্রবার থেকে নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেটে এনআইডি নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হয়। 

নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আবেদন জমা দিয়ে বায়োমেট্রিকের জন্য কনস্যুলেটে অ্যাপয়ন্টমেন্ট নিতে হয়। কিন্তু এই অ্যাপয়ন্টমেন্ট যেন সোনার হরিণ। তিন মাসের আগে কোনো অ্যাপয়ন্টমেন্ট মিলছে না নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে। কিন্তু সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কনস্যুলেটে গেলেই নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পন্ন করা যাচ্ছে। 

একাধিক সূত্র জানায়, নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রতিদিন ৫০ জন নিবন্ধন কার্যক্রমের জন্য অ্যাপয়ন্টমেন্ট নিতে পারেন। কিন্তু কনস্যুলেট এই নিয়ম উপেক্ষা করে নিজস্ব সক্ষমতায় প্রতিদিন ১০০ থেকে ১২০ জনের এনআইডি নিবন্ধন করছে। ৫০ জনের বাইরে যারা কনস্যুলেটে যাচ্ছেন তাদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন বিশেষ রেফারেন্সে নিবন্ধনের সুযোগ পাচ্ছেন। কিন্তু বাকীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিবন্ধন করছেন বলে জানা গেছে। 

১৪ নভেম্বর শুক্রবার সরেজমিনে দেখা গেছে, কনস্যুলের ঢোকার পর অভ্যর্থনা টেবিলে একটি কাগজে লেখা রয়েছে ‘অ্যাপয়ন্টমেন্ট ব্যাতীত এনআইডি নিবন্ধন করা হয় না।’ বিকাল আনুমানিক তিনটায় বস্টন থেকে আসা একজন প্রবাসী অভ্যর্থনা টেবিলে ধর্ণা দিয়েও এনআইডি নিবন্ধন করতে না পেরে ফিরে গেছেন শুধুমাত্র অ্যাপয়ন্টমেন্ট না থাকায়। একইসময়ে মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন অভ্যর্থনা টেবিলে বসা আরেকজন কর্মকর্তা। অপরপ্রান্তে থাকা ব্যক্তিকে উচ্চস্বরে তিনি অ্যাপয়ন্টমেন্টের জন্য সুনির্দিষ্ট একটি মাল্টিসার্ভিসেস প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন। 

এ ব্যাপারে বাকী কথা অফিস টাইমের পরে হবে বলে জানিয়ে ফোন লাইন কেটে দেন ওই কর্মকর্তা। একটি দূতালয় বা কনুস্যুলেটে একজন কর্মকর্তার এভাবে উচ্চস্বরে আনঅফিসিয়াল কথাবার্তায় সেবা নিতে আসা অনেকেই বিরক্তি প্রকাশ করেন। 

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, নিউইয়র্কে আনঅফিসিয়ালি প্রায় ৮ লাখ বাংলাদেশি অভিবাসী রয়েছেন। যাদের ৫০ শতাংশেরই এনআইডি নেই। এছাড়া বাংলাদেশি নতুন প্রজন্মের এনআইডি নেই ৯০ শতাংশেরই। এ হিসাবে কয়েক লাখ প্রবাসীর এনআইডির প্রয়োজন রয়েছে। অনেকে ‘নথিপত্রহীন অভিবাসী’ হওয়ায় আসার পর কখনো বাংলাদেশে যেতে পারেননি। এনআইডি না থাকায় বাংলাদেশে সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ করতে জটিল সমস্যায় পড়ছেন তারা। বাংলাদেশে সম্পত্তির ওয়ারিশদার হিসাবে নতুন প্রজন্মের জন্যও এনআইডি অত্যাবশ্যকীয়। এ কারণে অনেক অভিভাবক সন্তানের জন্য এনআইডির আবেদন করেছেন। কিন্তু কেউই যথাসময়ে অ্যাপয়ন্টমেন্ট পাচ্ছেন না। এজন্য প্রায় তিন মাস অপেক্ষা করতে হচ্ছে। অনেকের আশঙ্কা- অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ শেষ হলে এনআইডি কার্যক্রম কোনো কারণে স্থগিত হয়ে গেলে তারা এই সুর্বণ সুযোগ গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। 

প্রবাসীদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল ভোটাধিকার। এনআইডি থাকলে মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধন করলে প্রবাস থেকে পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন। কিন্তু ১৮ নভেম্বর নির্বাচন কমিশন এক ঘোষণায় জানিয়েছে- যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীরা আগামী ২৪ থেকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত মাত্র ৫ দিন এই নিবন্ধনের সুযোগ পাবেন। এই সময়ের আগে যারা এনআইডি নিবন্ধনের সুযোগ পেয়েছেন তারাই পোস্টাল ব্যালটের জন্য নিবন্ধন করতে পারবেন এবং তারাই ভোট দিতে পারবেন। ফলে এখনো যারা এনআইডি নিবন্ধনের জন্য অ্যাপয়ন্টমেন্ট পাননি, তাদের ভোট দেওয়ার স্বপ্ন অধরা রয়ে যাবে। 

তবে নির্বাচন কমিশনের নিয়মের বেড়াজাল ভেঙে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এনআইডি নিবন্ধনে চলছে রমরমা অ্যাপয়ন্টমেন্ট ব্যবসা। প্রতিদিন মাত্র ৫০ জনের নিবন্ধন দুই ঘণ্টার মধ্যেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। এরপর সমপরিমাণ, এমনকী তার চেয়েও বেশী নিবন্ধন করা হচ্ছে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। 

সূত্র জানায়, অ্যাপয়ন্টমেন্ট ছাড়া এনআইডি নিবন্ধনের জন্য জনপ্রতি কমপক্ষে ৫০ ডলার, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশি অর্থ নেওয়া হচ্ছে। কনস্যুলেটের দায়িত্বশীলদের চোখ এড়িয়ে এই কার্যক্রম সম্পন্ন হচ্ছে। তবে সূত্রটি বলছে- বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। কনস্যুলেটের সর্বোচ্চ পর্যায়ে অনৈতিক সুবিধা পৌঁছে যায়। 

এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক একটি গণমাধ্যমকে বলেন, এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। ৫০ জনের বাইরে কাউকে নিবন্ধনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। তবে দূর-দূরান্ত, বিশেষ করে অন্য রাজ্য থেকে যারা আসছেন, তাদের অনেককে প্রতিদিন বিশেষ নিবন্ধনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। সিন্ডিকেটের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ ধরনের অভিযোগ বা তথ্য-প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

কনসাল জেনারেল জানান, এনআইডি কার্যক্রম শুরুর পর ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ২৫৩৯ জন নিবন্ধন সম্পন্ন করেছেন। তাদের মধ্যে অনেকেই ইতিমধ্যে ডিজিটাল কপি পেয়ে গেছেন। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সঠিক না থকা বা অমিল থাকায় শতাধিক আবেদনপত্র বাতিল হয়েছে। কোনো কোনো আবেদনপত্র প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, যাদের এনআইডি থাকার পরও নতুন করে আবেদন করেছেন। 

উল্লেখ্য, নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেটে অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর নতুন কিছু নয়। ২০২০ সালে মহামারী করোনার পর ডাকযোগে করা প্রবাসীদের পাসপোর্ট আবেদনের প্রায় ৭০ হাজার ডলার লোপাট হয়েছিল। এ ঘটনা ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের তদন্তে প্রমাণিত হয়েছিল। কয়েকজনের চাকরিও চলে যায়। এত বড় ঘটনার পর এনআইডি কার্যক্রমে সিন্ডিকেট গড়ে ওঠায় কনুস্যলেটের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: মহিউদ্দিন সরকার