হঠাৎ তা’মীরুল মিল্লাত মাদরাসার টঙ্গী শাখা বন্ধ ঘোষণা
জাগো বাংলা প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২৫, ০৫:০৫ পিএম
অনির্দিষ্টকালের জন্য তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসার টঙ্গী ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আজ বুধবার (১৯ নভেম্বর) মিল্লাতের টঙ্গী ক্যাম্পাসের অধ্যক্ষ ডা. মো. হেফজুর রহমান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা, টঙ্গীর শিক্ষক, অভিভাবক ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, গভনিং বডির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত শিশু থেকে কামিল পর্বের সকল পাঠদান কার্যক্রম ও আলিম ২য় বর্ষের সকল পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করা হলো।
অতএব, উক্ত নোটিশের আলোকে অন্যান্য নির্ধারিত সকল কার্যক্রমে সংশ্লিটদের উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ করা হলো।
জানা গেছে, গাজীপুরের টঙ্গীতে অবস্থিত তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসায় চার দফা দাবিতে শিক্ষার্থীদের দিনব্যাপী আন্দোলনের এক পর্যায়ে মঙ্গলবার ছাত্র–শিক্ষকদের মধ্যে মারধরের ঘটনা ঘটে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর শিক্ষক কতৃক মারধরের অভিযোগ উঠলে গভর্নিং বডির প্রধান ড. কোরবানি আলী এদিন সন্ধ্যায় মাদ্রাসায় উপস্থিত হয়ে অভিযোগপ্রাপ্ত তিন শিক্ষককে তাৎক্ষণিকভাবে বহিষ্কারের নির্দেশ দেন। ফলে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
এদিকে মঙ্গলবার সকাল ৮টা ৫৫ মিনিটে আলিম দ্বিতীয় বর্ষের মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা বেতন বৃদ্ধি, অতিরিক্ত পরীক্ষার ফি নির্ধারণ, গরিব শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা এবং স্কলারশিপ চালুর দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন। পরে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে যোগ দেন।
শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, আন্দোলন থামাতে গিয়ে কয়েকজন শিক্ষক তাদের মারধর করেন। এতে বেশ কয়েকজন আহত হন এবং কারও কারও জামাকাপড়ও ছিঁড়ে যায়। মিল্লাত ছাত্র সংসদের (টাকসু) নেতা ওবায়েদসহ কয়েকজন শিক্ষার্থীর ওপরও মারধর করা হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে শিক্ষার্থীরা মাদ্রাসার প্রধান ফটক ভেঙে ঢাকা–ময়মনসিংহ মহাসড়কে অবস্থান নেন। প্রায় দীর্ঘক্ষণ যান চলাচল বন্ধ থাকে। পরে পুলিশের অনুরোধে শিক্ষার্থীরা পুনরায় ক্যাম্পাসে ফিরে আসে আন্দোলন করলে এক পর্যায়ে শিক্ষক মিলনায়তনে শিক্ষকরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। শিক্ষার্থীরা একাডেমিক ভবনের নিচের দুটি গেটে তালা লাগিয়ে সংশ্লিষ্ট অভিযুক্ত শিক্ষকদের বহিষ্কারের দাবি তোলেন এবং শিক্ষকদের অবরুদ্ধ করে রাখেন। এদিন দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শিক্ষকরা অবরুদ্ধ অবস্থায় শিক্ষক মিলনায়তনের ভেতরেই অবস্থান করতে থাকেন।
পরে মাগরিবের সময় গভার্নিং বডির প্রধান ড. কোরবানি আলী ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে অভিযোগপ্রাপ্ত তিন শিক্ষক—আতিকুর রহমান, সিবগাতুল্লাহ এবং কামরুল ইসলামকে বহিষ্কারের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে তিনি শিক্ষার্থীদের কিছু দাবি বিবেচনায় নেওয়ার আশ্বাস দিলে আন্দোলনকারীরা ক্যাম্পাস ত্যাগ করেন।
তবে শিক্ষকরা দাবি জানান—বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত তারা অবস্থান চালিয়ে যাবেন। বেশ কিছুক্ষণ চালিয়ে যাওয়ার পরে সন্ধ্যা ৭টা ১৫ মিনিটের দিকে তারা একে একে মিলনায়তন থেকে বের হন।
বহিষ্কারাদেশের পর রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানান বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি, বহিষ্কৃত শিক্ষক আতিকুর রহমান বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন শিক্ষক। তার বহিষ্কার বিভাগটির জন্য ক্ষতিকর হবে।
তবে আজ (১৯ নভেম্বর) সকাল ৯টা থেকে বিজ্ঞান বিভাগের শত শত শিক্ষার্থী একাডেমিক ভবনের নিচে অবস্থান নিয়ে বহিষ্কারাদেশ পুনর্বিবেচনা ও বাতিলের দাবি তোলেন।
তাদের অভিযোগ, মঙ্গলবার শিক্ষকদের অবরুদ্ধ করে প্রশাসনকে চাপের মুখে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করা হয়েছে এবং এতে শিক্ষকদের মানহানি করা হয়েছে। এবং তারা আরো দাবি করেন আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে গিয়ে বেশ কয়েকজন শিক্ষক হেনস্তার শিকারও হয়েছেন। এ ছাড়া শিক্ষকদের বহিষ্কারাদেশ বাতিলের দাবিতে গণসাক্ষর কর্মসূচী পালন করেন। এতে কয়েক শতাধিক শিক্ষার্থী শিক্ষর করেন বহিষ্কারাদেশ বাতিলের দাবিতে। তাছাড়া আন্দোলন চলাকালে তারা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ বিরোধী স্লোগানও দেন।
এ সময় শিক্ষকদের একটি দল আন্দোলনকারীদের শান্ত করতে এগিয়ে আসেন। আরবি বিভাগের অধ্যাপক ড. সালমান ফারসী শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, “মিল্লাতে মেধাবীদের মূল্যায়ন হবে—এর বাইরে কোনো মূল্যায়ন হবে না। পরিস্থিতি নিয়ে তোমরা লিখিত বার্তা পাবে, এখন সবাই বাড়ি ফিরে যাও।” তার আশ্বাসের পর আন্দোলনকারীরা কর্মসূচি স্থগিত করেন।
পরবর্তীতে মাদ্রাসার অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এতে জানানো হয়, গভার্নিং বডির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত শিশু শ্রেণি থেকে কামিল পর্যন্ত ক্লাস বন্ধ থাকবে এবং আলিম দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা স্থগিত করা হলো।
তবে মাদ্রাসার একটি অভ্যন্তরীণ সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন জটিলতা ও কোন্দল চলমান। কেউ কেউ নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক তারা বলেন, শিক্ষকদের মাঝে সিন্ডিকেট রয়েছে যা বন্ধ করা জরুরি। অনেকে বলছেন কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও লেখালেখি হয় নোয়াখালী শিক্ষক ফোরাম এবং বরিশাল শিক্ষক ফোরামের অদৃশ্য বিভক্তি নিয়ে। তবে ছাত্রসংসদ এবং অনেক শিক্ষক মনে করেন আঞ্চলিকতার বিভক্তি সমাধান হওয়া জরুরি প্রতিষ্ঠানের কল্যাণের স্বর্থে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায় ২০২৫ সালে একাধিকবার আন্দোলন, ভাঙচুর ও শিক্ষক–শিক্ষার্থী বিরোধের ঘটনা ঘটে। এসব অভ্যন্তরীণ সংকটের জের ও শিক্ষকদের বহিষ্কারাদেশ বাতিলের দাবিতে আজ সকাল থেকে শিক্ষকরা কর্মবিরতি পালন করছেন।
এ বিষয়ে মাদ্রাসার কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের জিএস সাইদুল ইসলাম বলেন, শিক্ষকদের দায়িত্ব হলো সব সময় শিক্ষার্থীদের কল্যাণে তাদের ভূমিকা রাখা। কিন্তু গতকাল দেখলাম শিক্ষার্থীদের ছোট ছোট দাবিগুলো আমলে না নিয়ে তাদের কে না বুঝিয়ে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে তাদের কে দমিয়ে রাখতে গিয়ে খুব বেদম প্রহার করে বেশ কিছু শিক্ষক। আন্দোলনের নতুন মোড় নেয়। ট্রাস্ট চেয়ারম্যান সহ গতকাল বিষয় গুলো সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু আজকে দেখলাম শিক্ষকরা না মেনে কর্মবিরতি দিয়ে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ব্যাহত করলো। ছোট বিষয়টিকে বড় করে আজকে প্রতিষ্ঠানের পরিক্ষা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছে।
শিক্ষকদের এহেন আচরণ কোনভাবেই শিক্ষা সূলভ দায়িত্বশীল আচরণ না। এই কর্মকাণ্ড আদর্শিক, ভিশনারী প্রতিষ্ঠানের সাথে কোনভাবেই মানানসই না। শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে গিয়ে আজ পর্যন্ত কেউ টিকে থাকতে পারিনি। এ বিষয় মাথায় নিয়ে সবার কাজের আগে চিন্তা করা দরকার।
মিল্লাতের টঙ্গী ক্যাম্পাসের অধ্যক্ষ ড. হিফজুর রহমান বলেন, আলোচনার মাধ্যমে বিষয়গুলো সমাধানের চেষ্টা চলছে। পরে আনুষ্ঠানিকভাবে মত জানানো হবে। তবে এরপর আর তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।
মাদ্রাসর তাদারকি কমিটির প্রধান অধ্যাপক জামাল উদ্দিন জানান, ‘আজ সাময়িকভাবে বন্ধ থাকলেও কার্যক্রম স্থিতিশীলভাবে চলবে, পরীক্ষাও হবে।”