জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা প্রথম মামলার রায় ঘোষণা করা হবে আজ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চে এ মামলা রায়ের জন্য ধার্য আছে। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। শেখ হাসিনার পাশাপাশি মামলায় অপর দুই আসামি সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এর মধ্যে সাবেক আইজিপি মামুন ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হিসাবে জবানবন্দি দিয়েছেন। শেখ হাসিনা ও কামাল ভারতে পলাতক। তাদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল থেকে ওয়ারেন্ট জারি আছে। তাদের অনুপস্থিতিতে রায় হচ্ছে আজ। রায় ঘোষণা উপলক্ষ্যে তিন আসামির মধ্যে একমাত্র গ্রেফতার সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে জেল থেকে আদালতে হাজির করা হবে। এদিন ট্রাইব্যুনাল ও সুপ্রিমকোর্ট অঙ্গনে সর্বোচ্চ কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। বাড়তি নিরাপত্তার জন্য সুপ্রিমকোর্টের পক্ষ থেকে সেনা মোতায়েন চেয়ে রোববার সেনা সদর দপ্তরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। পূর্বঘোষণা অনুযায়ী, গণ-অভ্যুত্থানে আহত ও শহীদদের পরিবারের সদস্যরাও ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে উপস্থিত থাকবেন বলে জানা গেছে।
বহুলপ্রতিক্ষীত ঐতিহাসিক এ রায় শোনার জন্য গোটা জাতি এখন অপেক্ষায়। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহুদেশের দৃষ্টি এখন এ রায়ের দিকে। ফলে বিচারপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও গুরুত্ব বিবেচনায় সরাসরি সম্প্রচারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যাতে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের মতো সাধারণ মানুষও তা প্রত্যক্ষ করতে পারেন। জুলাই গণহত্যা ইস্যুতে প্রথমবার কোনো রায় শুনবে জাতি, যা দেশের বিচারের ইতিহাসে বড় মাইলফলক হয়ে থাকবে। রোববার এমনটিই জানিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন। এছাড়া রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পয়েন্টে বড় পর্দায় রায় ঘোষণাপর্ব দেখাতে আয়োজন করেছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। প্রসিকিউশন জানিয়েছে, আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রার্থনার পাশাপাশি তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ভুক্তভোগী শহীদ ও আহতদের পরিবারের কাছে হস্তান্তরের আবেদন করা হয়েছে। ন্যায়বিচারের স্বার্থে ট্রাইব্যুনাল যে আদেশ দেবেন, প্রসিকিউশন তা মেনে নেবে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে এটিই সর্বপ্রথম রায়।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় প্রথম মামলাটি (মিসকেস বা বিবিধ মামলা) হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। গত বছরের ১৭ অক্টোবর পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে প্রথম বিচার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। সেদিনই এ মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল।
প্রথমদিকে এ মামলায় শেখ হাসিনাই একমাত্র আসামি ছিলেন। চলতি বছরের ১৬ মার্চ এ মামলায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে আসামি করার আবেদন করে প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ)। ট্রাইব্যুনাল তা মঞ্জুর করেন। পরে চার্জশিটে আসে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নাম। ১ জুন শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করে প্রসিকিউশন। আনুষ্ঠানিক অভিযোগে তিন আসামির বিরুদ্ধে মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়।
আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের দিন (১০ জুলাই) সাবেক আইজিপি মামুন গণ-অভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার কথা অকপটে স্বীকার করে ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হওয়ার আবেদন করেন। ওইদিন তার আবেদন গৃহীত হয়। ১২ অক্টোবর এ মামলায় যুক্তিতর্ক শুনানি শুরু হয়। তা শেষ হয় ২৩ অক্টোবর। চূড়ান্ত শুনানিতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের মৃত্যুদণ্ড চান চিফ প্রসিকিউটর। আসামি শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামানের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন বক্তব্য দেন। তিনি যুক্তিতর্ক শুনানিতে এ মামলা থেকে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামানের খালাস চেয়ে আবেদন করেন। রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি মামুনকে খালাস দিতে আবেদন করেন তার আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ। যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে সেদিন (২৩ অক্টোবর) ট্রাইব্যুনাল বলেন, এ মামলার রায় কবে দেওয়া হবে, তা ১৩ নভেম্বর জানানো হবে। সে অনুযায়ী গত ১৩ নভেম্বর ট্রাইব্যুনাল ১৭ নভেম্বর রায় ঘোষণার তারিখ ধার্য করেন।
রায়ে নারী-পুরুষ সমান, অপরাধের ধরন বিবেচনায় শাস্তি দেওয়া হয় : এদিকে রোববার সকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে ব্রিফিং করেন প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামীম। তিনি বলেন, সিআরপিসি আইন অনুযায়ী জামিনের ক্ষেত্রে নারী, অসুস্থ ব্যক্তি ও কিশোরদের প্রিভিলেজ বা বিশেষ সুবিধা রয়েছে। তবে রায়ের ক্ষেত্রে নারীকে কোনো অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়ার বিধান সাধারণ কিংবা ট্রাইব্যুনাল আইনেও নেই। অর্থাৎ আসামি নারী নাকি পুরুষ, তা বিবেচ্য নয়। বরং তিনি কী অপরাধ করেছেন, সেই গ্র্যাভিটি বা গুরুতরতার ভিত্তিতেই শাস্তি নির্ধারণ হবে। আর অভিযোগ প্রমাণিত না হলে আসামি খালাস পাবেন।
তামীম বলেন, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার দিন ধার্য রয়েছে। আমরা আশা করছি, ধার্য তারিখেই এ রায় ঘোষণা করবেন ট্রাইব্যুনাল। প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে আমরা প্রস্তুত আছি। এছাড়া অনুমতি সাপেক্ষে রায়ের যে অংশটুকু ট্রাইব্যুনাল পড়ে শোনাবেন, তা বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করতে পারবে দেশের সব গণমাধ্যম। তিনি বলেন, এ মামলায় আনা পাঁচটি অভিযোগই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে প্রসিকিউশন।
এ মামলার রায় চলমান অন্য কোনো মামলায় প্রভাব পড়বে কি না-জানতে চাইলে এই প্রসিকিউটর বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থান চলাকালে যে কয়েকটি অভিযোগ আমরা এনেছি, একই অভিযোগে অন্য কোনো মামলা থাকলে আর চলবে না। কারণ, সংবিধান অনুযায়ী এক ব্যক্তিকে একই অভিযোগে দুবার বিচার বা শাস্তি দেওয়া যায় না। তবে এসবের বাইরে কোনো অভিযোগ থাকলে (যেমন: শাপলা চত্বর গণহত্যা, গুম-খুন, দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ক্ষমতার অপব্যবহার প্রভৃতি অপরাধের বিচার) চলতে বাধা নেই। ট্রাইব্যুনাল যে পাঁচটি অভিযোগ নিষ্পত্তি করছে, সেই অভিযোগে অন্য কোথাও নতুন মামলা করাও যাবে না বলে জানান তিনি।
শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গত বছরের ১৪ জুলাই গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে রাজাকার বলে সম্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওটি ছিল উসকানিমূলক বক্তব্য। এর পরিপ্রেক্ষিতে একই রাতে তিনি তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মাকসুদ কামালের সঙ্গে ফোনে আন্দোলনকারী ছাত্রদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের আদেশ দেন। ১৮ জুলাই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন তিনি। ফোনে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর মারণাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। একই সঙ্গে হেলিকপ্টার ব্যবহার করে গুলি এবং ড্রোনের মাধ্যমে ছাত্র-জনতার অবস্থান নির্ণয়ের নির্দেশ দেন।
রোববার প্রসিকিউটরকে একজন সাংবাদিক বলেন, শেখ হাসিনা ভারতে আছেন। তার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের কাছে রেড নোটিশ জারির আবেদন করেছিল প্রসিকিউশন। ইন্টারপোল কোনোরকম সাড়া দেয়নি-জবাবে প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার বলেন, ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলে প্রসিকিউশন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারির আবেদন করেছিল। কাল (আজ) যদি রায় হয় এবং রায়ে যদি ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে শাস্তি দেন, তাহলে ইন্টারপোলে আরেকটি ‘কনভিকশন ওয়ারেন্টের’ (দণ্ডাদেশের পরোয়ানা) আবেদন করবে প্রসিকিউশন তার বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করার জন্য।
ঐতিহাসিক এই মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন গণ-অভ্যুত্থানে চানখাঁরপুলে পুলিশের গুলিতে নিহত দশম শ্রেণির ছাত্র শাহরিয়ার খান আনাসের বাবা শাহরিয়ার খান পলাস। তিনি ছয়জনকে হত্যার এই মামলার সাক্ষী হয়ে আসামিদের ফাঁসি চান। এ মামলায় প্রথম শহীদ আবু সাঈদের সহযোদ্ধা কয়েকজন সাক্ষ্য দেন। এছাড়া স্টার উইটনেস হিসাবে সাক্ষ্য দেন জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক ও জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী নাহিদ ইসলাম এবং আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান। সর্বমোট ৫৪ জন সাক্ষী এ মামলায় সাক্ষ্য দেন।
মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে যারা সাক্ষ্য দিলেন : খোকন চন্দ্র বর্মণ, আবদুল্লাহ আল ইমরান, পারভীন আক্তার, রিনা মুর্মু, একেএম মঈনুল হক, আবদুস সামাদ, মিজান মিয়া, নাঈম শিকদার, শাহীনা বেগম, মো. এনাব নাজেজ জাকি, রবিউল আউয়াল, জসিম উদ্দিন, ডা. মাহফুজুর রহমান, শাহনাজ পারভীন, ডা. হাসানুল বান্না, সোনিয়া জামাল, মো. গিয়াস উদ্দিন, ডা. রাজিবুল ইসলাম, শরীফুল ইসলাম, ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী, জাকিয়া সুলতানা নীলা, মোহাম্মদ ইদ্রিস, আমেনা আক্তার, হোসনে আরা বেগম, ডা. মফিজুর রহমান, ডা. মনিরুল ইসলাম, ডা. মোস্তাক আহমেদ, নাসির উদ্দিন, মো. সাঈদুর রহমান, মো. মোহিদ হোসেন, হুমায়ন কবির লিটন, ডা. হাসানাৎ আল মতিন, তারেক নাসরুল্লাহ, ডা. মো. রশিদুল আলম, ডা. রাহাদ বিন কাশেম, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, মোহাম্মদ হাসান, সোহেল মাহমুদ, মো. আশরাফুল ইসলাম, মো. জাকির হোসাইন, মোহাম্মদ সিরাজুস সালেহীন, ইফতেখার আলম, শেখ নজরুল ইসলাম, মো. রুকনুজ্জামান, মো. শাহেদ জোবায়ের লরেঞ্চ, মাহমুদুর রহমান, নাহিদ ইসলাম, আলী আহসান জুনায়েদ, সাবরিনা আফরোজ শ্রাবন্তী, কামরুল হাসান, মো. কামরুল হোসাইন, আনিসুর রহমান, তানভীর হাসান জোহা ও তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর।