Logo
Logo
×

জাতীয়

২৬ টুকরো লাশ নিয়ে র‌্যাব-পুলিশের ভিন্ন বক্তব্যের নেপথ্যে

Icon

জাগো বাংলা প্রতিবেদন

প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:২৮ পিএম

২৬ টুকরো লাশ নিয়ে র‌্যাব-পুলিশের ভিন্ন বক্তব্যের নেপথ্যে

রাজধানীর হাইকোর্ট এলাকায় জাতীয় ঈদগাহ মাঠের পাশে প্লাস্টিকের ড্রামের ভেতর থেকে আশরাফুল হকের ২৬ টুকরো লাশ উদ্ধারের ঘটনায় দুই ধরনের ব্যাখ্যা দিয়েছে পুলিশ ও র‌্যাব। রংপুরের ব্যবসায়ী আশরাফুল হত্যার ঘটনার মূলহোতা নিহতের বন্ধু জরেজকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। আর আশরাফুল ও জরেজের পরিচিত শামীমাকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

শুক্রবার (১৪ নভেম্বর) রাতে কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে জরেজকে গ্রেপ্তারের পর ডিবি জানায়, পরকীয়ার বলি আশরাফুল।

আর র‌্যাব জানায়, প্রেমিকাকে দিয়ে ‘ফাঁদে ফেলে’ আশরাফুলের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা আদায়ের পরিকল্পনা ছিল জরেজের। পরিকল্পনা অনুযায়ী আশরাফুলকে ঢাকায় আনা হয়। কিন্তু টাকা আদায় না করে কেন তাকে খুন করা হলো, সেটির ‘স্পষ্ট ধারণা’ পাওয়া যায়নি।

তখন হত্যাকাণ্ডের মোটিভ নিশ্চিত হতে র‍্যাব জানায়, জরেজের বক্তব্যের জন্য অপেক্ষা করতে হয় তাদের।

শনিবার (১৫ নভেম্বর) দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম বলেছেন, এটা আসলে একটা ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনি। মালয়েশিয়া প্রবাসী জরেজ মাস দেড়েক আগে দেশে ফেরেন। সেখানে থাকা অবস্থায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কুমিল্লার শামীমার সঙ্গে পরিচয় হয় এবং তাদের মধ্যে সম্পর্ক হয়। জরেজের দেশে ফেরার দিন শামীমাই তাকে ঢাকার বিমানবন্দরে রিসিভ করেন এবং পরে যে যার বাড়ি চলে যান।

তিনি বলেন, গ্রেপ্তার জরেজুল ইসলাম একজন মালয়েশিয়া প্রবাসী। আনুমানিক দেড় মাস আগে সে দেশে আসে। বিদেশে থাকাকালীন জরেজুল ইসলামের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কুমিল্লার শামীমা নামে এক প্রবাসীর স্ত্রীর সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে। জরেজুল ইসলাম দেশে ফেরার পর তার স্ত্রী বিষয়টি জানতে পারলে তাদের মধ্যে পারিবারিক মনোমালিন্য হয়। জরেজুলের স্ত্রী বিষয়টি জানতে পেরে তার (জরেজুল) বন্ধু আশরাফুলকে শামীমার মোবাইল নম্বর দেন। তার বন্ধু জরেজুলকে এসব থেকে নির্বৃত্ত করার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু আশরাফুল নিজেই এক পর্যায়ে শামীমার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন।

তিনি বলেন, নিহত আশরাফুল তার বন্ধুকে ১৪ লাখ টাকা দিয়ে জাপান পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেয়, তার মধ্যে শামীমা ৭ লাখ টাকা দেওয়ার কথা ছিল। মূলত এই টাকার সংস্থান এবং শামীমার সঙ্গে একান্তে দেখা করার আশায় দুই বন্ধু একত্রে রংপুর থেকে ঢাকায় আসে। ঢাকায় তিনজন একত্রে দেখা করার জন্য একটি নিরাপদ স্থান খোঁজ করছিল। পরে তিনজনের পরিকল্পনায় ডেমরার দক্ষিণ ধনিয়াতে একটি বাসা ভাড়া নেয় এবং একই দিন দুপুরে বাসায় ওঠে, তিনজন মিলে সেই বাসা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে। স্থানীয় বাজার থেকে তারা একটি তোশক, তিনটি বালিশ ও জানালার পর্দা কেনে। পরস্পর সম্মতিতে তারা একে অপরের সঙ্গে শারীরিক মেলামেশা করে।

কিন্তু আশরাফুল শামীমার সঙ্গে অস্বাভাবিক যৌনকর্ম করতে চাইলে শামীমা তাতে বাধা দেন। এতে করে দুজনের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হয় এবং শামীমা কান্নাকাটি শুরু করলে জরেজুল বিষয়টি নিয়ে বন্ধুর ওপর হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে যান। আশরাফুল শামীমাকে জোরাজুরি করার এক পর্যায়ে শামীমা কৌশলে আশরাফুলের হাত বেঁধে অস্বাভাবিক মেলামেশা করতে প্রলুব্ধ করে। আশরাফুল এরপর অস্বাভাবিক যৌনকর্ম শুরু করলে ক্ষিপ্ত জরেজুল প্রথমে আশরাফুলকে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে। এতে আশরাফুল চিৎকার শুরু করলে শামীমা তার ওড়না এবং সঙ্গে থাকা স্কচটেপ দিয়ে আশরাফুল এর মুখ বেঁধে দেয়। এভাবে মুখ বাঁধা থাকায় এবং জরেজুল ইসলামের আঘাতে এক পর্যায়ে আশরাফুল মারা যায়।

যদিও শুক্রবার রাতে ডিবির পক্ষে থেকে জানানো হয়, আশরাফুল শারীরিক সম্পর্কের দাবি জানালে বিষয়টি টের পেয়ে জরেজুল ক্ষিপ্ত হয়ে বাসা থেকে বের হন। বের হওয়ার সময় ভুলে আশরাফুলের মোবাইলও সঙ্গে নিয়ে যান। পরে মোবাইল নিতে ফিরে এসে জরেজুল দেখেন শামীমা ও আশরাফুল একসঙ্গে ঘুমিয়ে আছেন। তিনি বাসার ভেতরে লুকিয়ে রাতের অপেক্ষা করেন।

ডিবি সূত্রে আরও জানায়, ওই রাতে শামীমা ও আশরাফুল আবার যৌন সম্পর্কে জড়ালে জরেজুল তা মেনে নিতে পারেননি। সঙ্গে থাকা জরেজুল বালিশ চাপা দিয়ে আশরাফুলকে ধরে রাখেন এবং শামীমাও তাকে সাহায্য করেন। এক পর্যায়ে হাতুড়ি দিয়ে আশরাফুলের মাথায় আঘাত করলে তিনি মারা যান। হত্যার পর মরদেহ দুই দিন বাসার ভেতরে রাখা হয়।

কিন্তু হত্যাকাণ্ডের পরের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ডিবি প্রধান সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আশরাফুল মারা গেলে দুজনে চিন্তিত হয়ে পড়ে এবং লাশ গুম করার উপায় খুঁজতে থাকে। ১২ নভেম্বর সারারাত তারা লাশের সঙ্গেই একই বাসায় অবস্থান করে এবং ১৩ নভেম্বর সকালে জরেজুল ইসলাম ও শামীমা দুজনে পরিকল্পনা করে লাশ গুম করার জন্য বাজার থেকে দুটি প্লাস্টিকের ড্রাম, পলিথিন ও লাশ কাটার জন্য স্থানীয় দোকান থেকে একটি চাপাতি কিনে আনে। বাথরুমের পানির ট্যাপ ছেড়ে দিয়ে জরেজুল ইসলাম লাশটি কেটে টুকরা করে শামীমার সহায়তায় ড্রামে ভরে। শামীমা তখন বাইরে গিয়ে একটি সিএনজি ভাড়া করে আনে এবং দুজনে সিএনজিতে করে লাশের ড্রামসহ বেরিয়ে পড়ে।

বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) হাইকোর্ট সংলগ্ন জাতীয় ঈদগাহ মাঠের পাশে ফুটপাতে তারা লাশ ভর্তি ড্রাম দুটি রেখে দ্রুত বাসায় ফিরে যায়। বাসায় ফিরে দুজনে বাসার সকল মালামাল নিয়ে বের হয়ে যায়। শামীমা কুমিল্লার দিকে রওয়ানা হয় এবং জরেজুল রংপুর যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এক পর্যায়ে সে সিদ্ধান্ত বদল করে কুমিল্লায় তার এক বন্ধুর বাসায় গমন করলে সেখান থেকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।

এদিকে শামীমাকে গ্রেপ্তারের পর হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা ভিন্নভাবে দেয় র‍্যাব। তার দেওয়া প্রাথমিক স্বীকারোক্তির বরাত দিয়ে শনিবার (১৫ নভেম্বর) কারওয়ান বাজারে র‍্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে র‍্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল ফায়েজুল আরেফীন কথা বলেন।

র‌্যাব জানায়, ১৪ নভেম্বর সকালে কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার বড় বিজরা এলাকায় নিজ বাড়ি থেকে শামিমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা, ব্ল্যাকমেইলিং এবং লাশ গুমের পুরো প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন।

লে. কর্নেল ফায়েজুল আরেফীন বলেন, গত ১১ নভেম্বর রাতে রংপুর থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন ব্যবসায়ী আশরাফুল হক। তিনি একই এলাকার বন্ধু জরেজুল ইসলামের সঙ্গে ব্যবসায়িক পাওনা আদায়ের জন্য ঢাকায় আসেন। ১২ নভেম্বর সকাল থেকে তার পরিবার তার মোবাইল বন্ধ পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে।

১৩ নভেম্বর হাইকোর্ট এলাকার পানির পাম্প সংলগ্ন দুটি নীল রঙের ড্রাম থেকে ২৬ টুকরো করা এক অজ্ঞাত ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করে শাহবাগ থানা পুলিশ। পরে আঙুলের ছাপ বিশ্লেষণে মরদেহটির পরিচয় নিশ্চিত হয়— তা ছিল নিখোঁজ আশরাফুল হকের।

গ্রেপ্তার শামীমা আক্তারের মোবাইল বিশ্লেষণ ও জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তিনি ও জরেজ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রেমের সম্পর্কে ছিলেন। জরেজ তাকে জানায়— তার এক বন্ধুকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ব্ল্যাকমেইল করে ১০ লাখ টাকা আদায় করা সম্ভব। এর মধ্যে ৭ লাখ নেবে জরেজ, ৩ লাখ পাবে শামীমা।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, ঘটনার এক মাস আগে থেকেই শামীমা নিহত আশরাফুলের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে তাকে আকৃষ্ট করেন। নিয়মিত অডিও-ভিডিও কলে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে।

লে. কর্নেল ফায়েজুল আরেফীন আরও বলেন, ১১ নভেম্বর রাতে ঢাকায় আসার পর জরেজ ও আশরাফুলের সঙ্গে ঢাকার শনির আখড়ার নূরপুর এলাকায় একটি বাসা ভাড়া নেন শামীমা। সেখানে ব্ল্যাকমেইলের উদ্দেশ্যে আশরাফুলকে মালটার শরবতের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাওয়ানো হয়। তিনি অচেতন হওয়ার পর জরেজ বাইরে থেকে শামীমা ও আশরাফুলের অন্তরঙ্গ ভিডিও ধারণ করে।

শামীমার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, ১২ নভেম্বর দুপুরে আশরাফুল পুরোপুরি অচেতন হয়ে পড়লে জরেজ তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে এবং মুখে স্কচটেপ লাগায়। এরপর ইয়াবা সেবনের উত্তেজনায় জরেজ হাতুড়ি দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করে তাকে হত্যা করে। লাশ পাশের ঘরেই রেখে দুজন রাত কাটায় এবং শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়।

র‍্যাব-৩ এর অধিনায়ক বলেন, পরদিন সকালে জরেজুল বাজার থেকে চাপাতি ও দুটি ড্রাম এনে লাশ ২৬ টুকরো করে ড্রামে ভরে। দুপুরে একটি সিএনজি ভাড়া করে ড্রামগুলো বাসা থেকে বের করে; পরে মাঝপথে সিএনজি পরিবর্তন করে হাইকোর্টের মাজার গেটের কাছে পৌঁছায়।

মূলত, আশরাফুল হত্যা মামলার দুই আসামিকে পৃথকভাবে ‍গ্রেপ্তার করে পুলিশ ও র‌্যাব। ফলে তাদের দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক বয়ানের কারণে দুই ধরনের বক্তব্য পাওয়া গেছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: মহিউদ্দিন সরকার