‘বিগো লাইভে’ পরিচয় থেকে ত্রিভুজ প্রেম—বন্ধুর হাতে খুন আশরাফুল
জাগো বাংলা প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৪:২০ পিএম
কাঁচামাল ব্যবসায়ী আশরাফুল হক (৪২) হত্যার ঘটনায় দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ও র্যাব। শুক্রবার সন্ধ্যায় ঢাকা ও কুমিল্লায় অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় আশরাফুলের বন্ধু জরেজুল ইসলাম ও তার প্রেমিকা শামীমা আক্তারকে। কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে জরেজুলকে গ্রেপ্তার করে ঢাকায় আনে ডিবি পুলিশ। শামীমাকে গ্রেপ্তারের সময় তার কাছ থেকে হত্যাকাণ্ডের আলামতও উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে র্যাব।
র্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল ফায়েজুল আরেফীন বলেন, রংপুরের ব্যবসায়ী আশরাফুল হককে হত্যা এবং লাশ খণ্ড-বিখণ্ড করে জাতীয় ঈদগাহ ময়দানের পাশে দুটি ড্রামে ফেলার ঘটনায় প্রধান আসামি জরেজের প্রেমিকা শামীমাকে আলামতসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে নিহত আশরাফুলের সঙ্গে শামীমার সম্পর্ক ছিল, একইসঙ্গে শামীমা ছিলেন আশরাফুলের বন্ধু জরেজুলের প্রেমিকা—বিষয়টি জিজ্ঞাসাবাদে আরও স্পষ্ট করা হচ্ছে।
এদিকে পুলিশ ও র্যাব সূত্র জানায়, রংপুরের একই গ্রামের বাসিন্দা আশরাফুল ও মালয়েশিয়া প্রবাসী জরেজুল বাল্যবন্ধু। তিন বছর আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘বিগো লাইভে’ কুমিল্লার এক প্রবাসীর স্ত্রী শামীমা আক্তারের সঙ্গে জরেজুলের পরিচয় হয়। দুই সন্তান নিয়ে কুমিল্লায় থাকা শামীমার সঙ্গে জরেজুলের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মাঝে মাঝে মালয়েশিয়া থেকে দেশে এসে তিনি শামীমার সঙ্গে সময় কাটাতেন। এ সম্পর্কের কথা বন্ধু আশরাফুলকে জানান তিনি। পরে আশরাফুল শামীমার ফোন নম্বর নিয়ে তিনিও তার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন এবং তাদের মধ্যেও সম্পর্ক তৈরি হয়।
ডিবি সূত্র জানায়, গত ২৩ সেপ্টেম্বর মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফিরে ঢাকার দক্ষিণ দনিয়ায় একটি বাসা ভাড়া নেন জরেজুল—সেখানে ওঠেন শামীমাকে নিয়ে, তার (শামীমার) দুই সন্তানকে কুমিল্লায় রেখে আসেন। গত মঙ্গলবার জরেজুল তার বন্ধু আশরাফুলকে ওই বাসায় আনেন। সেখানে তিনি বুঝতে পারেন শামীমার সঙ্গে আশরাফুলের পরকীয়া সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।
এ মামলার তদন্ত তদারক করেছেন ডিবির যুগ্ম কমিশনার (দক্ষিণ) নাসিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের তথ্য অনুযায়ী এ ঘটনার জেরে জরেজুল প্রথমে বালিশ চাপা দিয়ে এবং পরে হাতুড়ি দিয়ে মাথায় আঘাত করে আশরাফুলকে হত্যা করা হয়। হত্যার পর মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার রাত পর্যন্ত দুদিন লাশটি বাসার ভেতরে রাখা হয়। পরে জরেজুল ও শামীমা বুধবার রাতে লাশ ২৬ টুকরো করে দুটি ড্রামে ভরে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় একটি ভ্যানে করে জাতীয় ঈদগাহ মাঠের গেটের কাছে ফেলে রেখে কুমিল্লায় পালিয়ে যান।
এর আগে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জাতীয় ঈদগাহ মাঠের সামনে নীল রঙের দুটি ড্রাম পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয়রা পুলিশে খবর দেন। পুলিশ গিয়ে ড্রাম থেকে ২৬ টুকরো মরদেহ উদ্ধার করে। সিআইডি পরে আঙুলের ছাপ মিলিয়ে পরিচয় নিশ্চিত করে আশরাফুল হক হিসেবে।
ডিবি সূত্রে জানা যায়, রংপুরে একই গ্রামের বাসিন্দা হওয়ায় আশরাফুল ও জরেজুলের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল। জরেজুলের মাধ্যমে আশরাফুলের সঙ্গে শামীমার পরিচয় হয় এবং তাদের মধ্যেও পরকীয়া সম্পর্ক তৈরি হয়। দক্ষিণ ধনিয়ার ওই বাসায় জরেজুল ও শামীমার শারীরিক সম্পর্কের পর আশরাফুলও শামীমার সঙ্গে সম্পর্ক করেন—এ তথ্য জানতে পেরে উত্তেজিত হয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটান জরেজুল।
ঘটনার রাতে জরেজুল বাসার বাইরে গিয়ে ভুলে আশরাফুলের মোবাইলও সঙ্গে নিয়ে যান। মোবাইল ফেরত দিতে ফিরে এসে তিনি শামীমা ও আশরাফুলকে একসঙ্গে ঘুমিয়ে থাকতে দেখেন এবং বাসার ভেতরে লুকিয়ে রাতের জন্য অপেক্ষা করেন। পরে শামীমা ও আশরাফুল আবার শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বালিশ চাপা দেন এবং হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করলে আশরাফুল মারা যান।
হত্যার পর মরদেহ দুই দিন বাসার ভেতরে রাখেন দুজন। এরপর মরদেহ ২৬ টুকরো করে দুটি ড্রামে ভরে হাইকোর্ট সংলগ্ন ঈদগাহ মাঠের সামনে ফেলে দেন এবং কুমিল্লায় পালিয়ে যান। স্থানীয়দের ফোনে পুলিশ গিয়ে লাশ উদ্ধার করে। মরদেহ শনাক্তের পর ডিবি তদন্ত শুরু করে।
পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক ডা. দীপিকা রায় ময়নাতদন্ত করেন। সুরতহাল প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়—মরদেহ গলা থেকে নিচ পর্যন্ত ২৫ টুকরো এবং মাথাসহ মোট ২৬ টুকরো। চুল ও দাঁত স্বাভাবিক থাকলেও গলার নিচের অংশের বহু অংশ মেলে না। ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
এ ঘটনায় শুক্রবার আশরাফুলের বোন আনজিনা বেগম শাহবাগ থানায় মামলা করেন। মামলায় জরেজুল ইসলামকে প্রধান আসামি করা হয়। এজাহারে তিনি অভিযোগ করেন, গত ১১ নভেম্বর রাতে আশরাফুল ও জরেজুল রংপুরের বদরগঞ্জের গোপালপাড়া থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন। এরপর থেকে আশরাফুলের মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায় এবং সম্ভাব্য সব স্থানে খোঁজ করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
আনজিনা এজাহারে আরও উল্লেখ করেন, ১৩ নভেম্বর রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢাকা মেডিকেল কলেজে উদ্ধার হওয়া খণ্ডিত মরদেহের খবর দেখে তিনি থানায় গিয়ে মরদেহ শনাক্ত করেন। তাঁর অভিযোগ, জরেজ ও তার সহযোগীরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করে মরদেহ ২৬ টুকরো করে দুটি নীল ড্রামে ভরে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়।
আশরাফুলের স্ত্রী লাকী বেগম জানান, বিদেশ যেতে ১০ লাখ টাকা ধার চেয়েছিলেন জরেজ। ‘মঙ্গলবার জরেজুল আমার স্বামীকে ঢাকায় নিয়ে যায়। এরপর স্বামীকে ফোনে পাই না। জরেজুল ফোন ধরে বলেন, আপনার স্বামী কালেকশনে গেছে। আমি কি বাচ্চা? কিছুই বুঝি না। আমার স্বামীকে খুন করেছে ওই জরেজুল। তার কঠোর বিচার চাই।’
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, আশরাফুল রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের নয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। তিনি হিলি থেকে কাঁচামাল কিনে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করতেন। বন্ধুত্বের সূত্রে জরেজ তাঁর সব ব্যবসার হিসাব-নিকাশ দেখাশোনা করতেন। গত মঙ্গলবার আশরাফুল জরেজকে নিয়ে ব্যবসার কাজে ঢাকায় আসেন। বুধবার বিকেলে স্ত্রীর সঙ্গে তার শেষ কথা হয়। এরপর থেকে আর যোগাযোগ পাওয়া যায়নি। বৃহস্পতিবার পরিবার বদরগঞ্জ থানায় জিডি করতে গেলে জানতে পারে—আশরাফুলকে ঢাকায় নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে।
নিহত আশরাফুল ভারত ও মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ ও আলু আমদানির লাইসেন্সধারী ব্যবসায়ী ছিলেন বলে জানান ডিএমপির রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলম।