নামজারি একটি আইনি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে জমির মালিকানা আগের মালিক থেকে নতুন মালিকের নামে সরকারিভাবে রেকর্ডভুক্ত হয়। নামজারি না করালে ভবিষ্যতে জমি নিয়ে বিরোধ বা জালিয়াতির শিকার হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। নামজারির মাধ্যমে জমির আগের জোতজমা থেকে খারিজ (কর্তন) হয়ে আবেদনকারীর নামে নতুন হোল্ডিং বা জোতের সৃষ্টি হয়। সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসে নামজারির (মিউটেশন) জন্য আবেদন করতে হয়।
তিনটি পদ্ধতিতে অনলাইন নামজারি-
১. জমা ভাগ না করেই নামজারি (যৌথ মালিকানা): ওয়ারিশ সূত্রে প্রাপ্ত জমিতে যদি কোনো আপোষ বণ্টন না হয়, তবে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ওয়ারিশ কায়েম সনদ, জমির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও জাতীয় পরিচয়পত্র অনলাইনে জমা দিয়ে সবাই মিলে যৌথভাবে নামজারি করা যাবে। এতে করে প্রত্যেকে তার অংশ অনুযায়ী মালিকানা পাবেন।
২. জমা ভাগ করে নামজারি (একক মালিকানা): যদি ওয়ারিশগণ নিজেদের মধ্যে জমি ভাগ করে নিতে চান, তবে আপোষ বণ্টননামা দলিল করে তা নির্দিষ্ট করে নিতে হবে। এরপর সেই দলিলের ভিত্তিতে প্রত্যেকে তার নিজ নিজ অংশে একক মালিকানার নামজারি করতে পারবেন।
৩. স্বয়ংক্রিয় নামজারি (অটোমেটেড সিস্টেম): বর্তমানে দেশের ২১টি উপজেলায় পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছে স্বয়ংক্রিয় নামজারি ব্যবস্থা। এতে করে সাবরেজিস্ট্রার অফিসে দলিল রেজিস্ট্রির সময়ই সমস্ত তথ্য এসিল্যান্ড অফিসে চলে যাবে এবং নতুন মালিকের নামে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নামজারি হয়ে যাবে—আবেদন ছাড়াই।
প্রথমে নাগরিকদের land.gov.bd ওয়েবসাইটে প্রবেশ করতে হবে। পূর্বে রেজিস্ট্রেশন থাকলে লগইন করে আবেদনকৃত জমির অবস্থা দেখা যাবে। লগইনের সময় অবশ্যই নিজের মোবাইল নাম্বার ব্যবহার করতে হবে। অন্য কারো মোবাইল নাম্বার দিলে ওটিপি সেই ব্যক্তির কাছে যাবে এবং আইনগত জটিলতা তৈরি হতে পারে।
মিউটেশন আবেদন করতে হলে প্রথমে প্রোফাইল আপডেট করতে হবে। এরপর মিউটেশন সিস্টেমে প্রবেশ করে আবেদন ফর্ম পূরণ, ফি পরিশোধ এবং খতিয়ান গ্রহণ করা যাবে। আবেদনকারী মোবাইল ওয়ালেট, ইন্টারনেট ব্যাংকিং বা বিকাশ, নগদ, রকেট ইত্যাদি মাধ্যমে ফি পরিশোধ করতে পারবেন।
প্রক্রিয়াটি নিম্নরূপ-
১. রেজিস্ট্রেশন ও প্রোফাইল আপডেট।
২. মিউটেশন সিস্টেমে প্রবেশ।
৩. নামজারি আবেদন ফর্ম পূরণ ও প্রয়োজনীয় দলিল সংযুক্তি।
৪. ২০ টাকা কোর্ট ফি এবং ৫০ টাকা নোটিশ ফি পরিশোধ।
৫. ট্র্যাকিং নাম্বার পাওয়ার মাধ্যমে আবেদন অবস্থান পর্যবেক্ষণ।
৬. শুনানি ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অনুসারে ১০০ টাকা খতিয়ান ফি ও ১০০০ টাকা রেকর্ড কারেকশন ফি দাখিল।
প্রতি ধাপই নাগরিকরা সহজে অনলাইনে করতে পারবে, এবং সব তথ্য সংরক্ষণ ও যাচাই করা হবে। মূল মোবাইল নাম্বার ব্যবহার করলে আবেদনকারীর সুবিধা নিশ্চিত হবে এবং খতিয়ান ডাউনলোড সহজ হবে।
নাগরিকরা স্বাধীনভাবে নিজেই এই সেবা গ্রহণ করতে পারবেন, কোন ভেন্ডর বা দোকানের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে না। এছাড়াও নাগরিক সেবা কেন্দ্রে বিনা পয়সায় আবেদন করার সুযোগ আছে। এই পদ্ধতি জানা থাকলে জমি মালিকানা সংক্রান্ত ঝামেলা ও আইনগত জটিলতা কমানো সম্ভব।
নামজারি যেভাবে সম্পন্ন হয়
নামজারি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত বা যাচাই-বাছাই হয়। নামজারির জন্য প্রস্তাবিত জমি দখলে আছে কি না, এটি খাসজমি কি না, অধিগ্রহণ করা হয়েছে কি না, সম্পত্তির মূল পরিমাণ ঠিক আছে কি না, মামলা–মোকদ্দমা চলছে কি না—সাধারণত এগুলো যাচাই করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর সহকারী কমিশনার (ভূমি) তা যাচাই-বাছাই করে দেখেন। প্রয়োজনে তিনি আবারও তদন্তে প্রেরণ করতে পারেন। পরে যাবতীয় কাগজপত্র, দলিল মিলিয়ে দেখে মিউটেশনের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়। অনুমোদন হলে খতিয়ান খোলা হয়। পক্ষগণ হাজির হতে হয় এবং শুনানিকালে যাবতীয় দলিল পরীক্ষা করা হয়। এর ভিত্তিতে আবেদন মঞ্জুর বা নামঞ্জুর হয়।
নামজারি করানোর সময় নির্ধারিত জমি পরিমাপ করে নেওয়া উচিত। নামজারির আবেদন করার পর জমির সহশরিক এবং ক্রেতা-বিক্রেতাকে নোটিশ দেওয়ার নিয়ম আছে। কোনো ধরনের অভিযোগ থাকলে তখন আপত্তি দিতে হয়। কিন্তু অনেক সময় নোটিশ যথাযথভাবে পৌঁছায় না। এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
নামজারি করাতে নির্দিষ্ট ফি আছে। এ ফির বাইরে অতিরিক্ত ফি কেউ দাবি করলে তা বেআইনি। নামজারিতে অনেক সময় দাগ নম্বর ভুল হতে পারে। এটি অনিচ্ছাকৃতও হতে পারে। অনেক সময় সঠিক তদন্তের অভাবে দাগ নম্বর ভুল হয়। এ ক্ষেত্রে যদি মনে হয় যে কর্মকর্তা ইচ্ছে করে ভুল করেছেন কিংবা কোনো প্রকার দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন, তাহলে তাঁদের বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ উত্থাপন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, নামজারি সংশোধনের জন্য আবেদন করতে হবে কিংবা সংশোধনের জন্য প্রয়োজনে মিস কেস দায়ের করতে হবে।
নামজারির আবেদন ভুল বা নামঞ্জুর হলে যা করবেন
নামজারি করার ক্ষেত্রে কোনো ‘করনিক’ ভুল হলে সহকারী কমিশনার( ভূমি) নিজেই সংশোধন করতে পারেন। আর যদি ভুলটি গুরুতর হয়, তাহলে মিস কেস দাখিল করতে হয়ে তার কাছেই। তিনি এর পরিপ্রেক্ষিতে আদেশ দিতে পারেন। যেকোনো কারণেই নামজারি আবেদন নামঞ্জুর হতে পারে। আবেদন নামঞ্জুর হলে প্রতিকারের সুযোগ রয়েছে। আবেদন নামঞ্জুর হলে সহকারী কমিশনারের (ভূমি) আদেশের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) কাছে আদেশের ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করতে হবে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ আছে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারের (রাজস্ব) কাছে এবং তা করতে হয় আদেশের ৩০ দিনের মধ্যে। অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারের (রাজস্ব) আদেশের বিরুদ্ধে ভূমি আপিল বোর্ডে আদেশের ৯০ দিনের মধ্যে আপিল করা যায়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে দেওয়ানি আদালতেও মামলা করা যায়।