জনশক্তি রপ্তানির অন্যতম গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্য। অনেকের পছন্দের তালিকায় ইউরোপও রয়েছে। তবে কর্মীদের অপরাধের মাত্রা, অবৈধ অভিবাসন এবং কিছু গন্তব্যে শ্রমিক চাহিদা পূরণ হয়ে যাওয়ার কারণে অনেক দেশের শ্রমবাজার এখন বন্ধ হয়ে গেছে।
অন্যদিকে, গত ১০ মাসে বিভিন্ন দেশ থেকে দেশে ফিরেছেন ৬৩ হাজার ৯৫২ জন বাংলাদেশি কর্মী। অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক চাহিদা অনুযায়ী মানসম্পন্ন কর্মী তৈরি করতে না পারলে এই সংকট আরও ঘনীভূত হবে।
২০১২ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত শ্রমিক নেয়া স্থগিত করে। দীর্ঘসময় বন্ধ থাকা এই শ্রমবাজারে ভ্রমণ ভিসায় কিছু কর্মী গেলেও এখনো বাংলাদেশিদের জন্য শ্রমিক ভিসা পুরোপুরি চালু হয়নি।
প্রায় সাত বছর ধরে বন্ধ রয়েছে বাহরাইনের শ্রমবাজার। দুই বছর আগে শ্রমিক নেয়া বন্ধ করেছে মধ্যপ্রাচ্যের আরেক দেশ ওমান। গত বছর থেকে শ্রমিক নেয়া বন্ধ রেখেছে লিবিয়া।
মালয়েশিয়ায়ও শ্রমিক পাঠানো অনিয়মিত হয়ে গেছে। চাহিদার তুলনায় অদক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় আরও কিছু দেশ আগ্রহ হারিয়েছে।
আবুধাবিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত তারেক আহমেদ বলেন, ‘২০১২ সালে সর্বপ্রথম আরব আমিরাতে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর বিভিন্ন সময়ে কিছুটা খুললেও পুরোপুরি আর কখনোই চালু হয়নি।’
ওমান বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব (কল্যাণ) আছাদুল হক বলেন, ‘ওমান সরকার শ্রমবাজার পুনর্গঠন ও ‘‘ওমানাইজেশন’’ নীতির অংশ হিসেবে ২০২৩ সালের ৩০ অক্টোবর থেকে সব দেশের জন্য যেকোনো ভিসাকে কর্মভিসায় রূপান্তরের সুযোগ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেয়।
একই সঙ্গে বাংলাদেশের জন্য ভিসা ইস্যু সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়। তবে দূতাবাসের ধারাবাহিক যোগাযোগ, কূটনৈতিক উদ্যোগ ও ইতিবাচক আলোচনার ফলে ওমান সরকার বিশেষ বিবেচনায় পাঁচটি ক্যাটাগরিতে মোট ১৩টি ভিসা পুনরায় চালু করেছে।’
অভিবাসন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিছু দেশে এরইমধ্যে শ্রমিক চাহিদা পূরণ হয়ে গেছে। আবার অনেক দেশ কর্মীদের ভাষা, দক্ষতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়েও গুরুত্ব দিচ্ছে।
দেশিয় শ্রমিকদের ছোট-বড় অপরাধ, অপহরণের ঘটনায় সম্পৃক্ততা এবং অবৈধ অভিবাসনের কারণেও বড় শ্রমবাজারগুলো মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) সচিব মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘দেখা গেছে, আমরা অনেক সময় সুযোগের অপব্যবহার করেছি।
ভুয়া সার্টিফিকেটের মাধ্যমে শ্রমবাজারে প্রবেশের চেষ্টা করেছি, যা ভিসা ইস্যুর ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।’
বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘যেসব বিদেশি নাগরিককে ভিসা দেয়া হচ্ছে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশিদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেড়ে গেছে।’
ইউরোপের গন্তব্য দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে দক্ষতার প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়াও শ্রমবাজার সংকুচিত হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের অনেক কর্মী এখনো ‘‘ডার্টি, ডেঞ্জারাস, ডিজিটাল’’—এই তিন ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছেন।
বিশ্বের অন্যান্য স্থানে এসব কাজ ধীরে ধীরে প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে যাচ্ছে। ফলে সাধারণ শ্রমিকের কাজ সংকুচিত হচ্ছে।’
নতুন কর্মী নেয়া বন্ধ রাখলেও গত ১০ মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ৬৪ হাজার বাংলাদেশি কর্মী দেশে ফিরেছেন। এর মধ্যে সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতার থেকে একাই ফিরেছেন প্রায় ৫০ হাজারের বেশি প্রবাসী।
ফেরত আসা কর্মীদের বড় অংশ প্রতারণা, অবৈধ নিয়োগ, চুক্তিভঙ্গ ও অমানবিক কর্মপরিবেশের শিকার হয়েছেন।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশে যাওয়া ও ফিরে আসা কর্মীর সংখ্যা যদি কাছাকাছি হয়ে যায়, তাহলে রেমিট্যান্সে প্রভাব পড়বে। একইসঙ্গে ফিরে আসা কর্মীদের স্থানীয় শ্রমবাজারে পুনর্বাসনের ক্ষেত্রেও বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, ‘বিদেশে কতজন যাচ্ছে আর কতজন ফিরছে, এই অনুপাতই গুরুত্বপূর্ণ। যদি দেখা যায় যে, যাওয়া ও ফেরা প্রায় সমান হয়ে যাচ্ছে, সেটা অত্যন্ত বিপজ্জনক অবস্থা হবে। মধ্যপ্রাচ্যে তো রাস্তায় নেমে আন্দোলন করার সুযোগও নেই।’
একদিকে গুরুত্বপূর্ণ শ্রমবাজারের দুয়ার বন্ধ, অন্যদিকে বাড়ছে ফেরত আসা কর্মীর সংখ্যা—এই দুই প্রবণতা সমান্তরালভাবে চললে অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি সামাজিক ও মানবিক সংকটও তৈরি হতে পারে।