শ্রমিকের ভিসায় রাশিয়ায়, পরে ইউক্রেন যুদ্ধে বাংলাদেশিরা
জাগো বাংলা প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৭ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:১৬ পিএম
ইউক্রেনে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বাংলাদেশের তরুণ সোহেল সরদার নীরবের ভিডিও নিয়মিত ফেসবুকে আসছে। সেই তরুণ রাশিয়ার সেনাবাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করছেন।
কীভাবে ইউক্রেন সেনাবাহিনীর ড্রোন অকার্যকর করা হচ্ছে, আত্মরক্ষায় কী প্রযুক্তি ও অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে—সেগুলোরও বর্ণনা দিচ্ছেন তিনি। জানিয়েছেন, রুশ বাহিনীতে যোগ দিয়েই বাংলাদেশি টাকায় ৪০ লাখ টাকা পেয়েছেন; মাসে মাসে বেতনও বেশ আকর্ষণীয়। এই যুদ্ধ তাঁর কাছে একই সঙ্গে ঝুঁকির ও রোমাঞ্চের। মৃত্যুঝুঁকিকে জীবনের সাধারণ একটি বিষয় হিসেবে দেখতে চান সোহেল।
কেবল সোহেল না—বাংলাদেশের হুমায়ুন কবির, রহমত আলী, আয়ন মণ্ডল ও অমিত বড়ুয়াসহ অনেক তরুণ এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছেন। তবে স্বেচ্ছায় নয়, প্রতারণার শিকার হয়ে।
বাংলাদেশের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে—তেল কোম্পানি, নির্মাণকাজ বা লজিস্টিক খাতে ভালো বেতনের চাকরির লোভ দেখিয়ে রাশিয়ার ফাঁদে পড়ছেন অনেক বাংলাদেশি। বৈধভাবে কাজের জন্য রাশিয়ায় যাওয়ার সুযোগ দেখানো হলেও সেখানে পৌঁছে বাধ্য হয়ে যেতে হচ্ছে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের ময়দানে।
তরুণদের এভাবে যুদ্ধের ময়দানে ঠেলে দেওয়ার ঘটনায় দেশে অন্তত ছয়টি মামলার তথ্য মিলেছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থা সিআইডি গত দুই বছরে এভাবে অন্তত ১০ জন বাংলাদেশিকে যুদ্ধে পাঠানোর খবর নিশ্চিত করেছে। তাঁদের মধ্যে চার থেকে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে বলেও জানা যায়।
তবে এ সংখ্যা যে ১০ জনেই সীমাবদ্ধ নয়—এ ব্যাপারে বেশ নিশ্চিত সিআইডি।
আবার ওমরা হজের ভিসা নিয়ে সেখান থেকেও রাশিয়ায় পাঠানোর তথ্য পেয়েছে সংস্থাটি।
যেভাবে সামনে আসে প্রতারণা
যুদ্ধে যেতে বাধ্য হওয়ার পর নানা উপায়ে চেষ্টা করে রাশিয়া থেকে ফিরতে পেরেছেন কয়েকজন তরুণ। ভুক্তভোগী ও তাঁদের স্বজনদের সাক্ষ্য নিয়ে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম ‘প্রমিসেস রিটেন ইন ব্লাড: হাউ লিগ্যাল মাইগ্রেশন টার্ন্ড ইন্টু ফোর্সড রিক্রুটমেন্ট ইন দ্য রাশিয়া–ইউক্রেন ওয়ার’শিরোনামে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
ভুক্তভোগীদের ভাষ্য—যাওয়ার আগে সবাই ভেবেছিলেন নিরাপদ ও ভালো বেতনের কাজ পাবেন। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর পর তাঁদের পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে জোর করে সামরিক প্রশিক্ষণ শিবিরে পাঠানো হয়, যেখান থেকে ধাপে ধাপে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়।
২০২৪ সালের শেষ দিক থেকে ব্র্যাক কমপক্ষে ১০টি পরিবার থেকে নিখোঁজ হওয়ার তথ্য পেয়েছে।
কেবল সোহেল না—বাংলাদেশের হুমায়ুন কবির, রহমত আলীসহ আরও তরুণ এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছেন।
কারও বৈধ ভিসা, বৈধ চুক্তিপত্র, সরকারি বিমানবন্দর দিয়ে যাত্রা—সব ঠিক থাকলেও রাশিয়ায় পৌঁছে তাদের পাসপোর্ট ও ফোন ‘প্রসেসিংয়ের জন্য’ নিয়ে নেওয়া হয়। এরপর জোর করে ‘স্বেচ্ছাসেবক চুক্তিপত্র’ সই করিয়ে গোপন সামরিক ঘাঁটিতে পাঠানো হয়।
অবৈধ মানবপাচারের ঘটনাও ঘটছে। বাংলাদেশে কিছু রিক্রুটিং এজেন্ট বেশি বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে মানুষ পাঠাচ্ছে। রাশিয়ায় গিয়ে এসব মানুষ দালালদের হাতে পড়েন, যারা তাঁদের সৈন্য বা শ্রমিক হিসেবে রুশ সামরিক বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। আবার কেউ কেউ লোভের কারণেও স্বেচ্ছায় যুদ্ধে যোগ দিচ্ছেন।
ব্র্যাকের ধারণা—বর্তমানে কয়েক শ বাংলাদেশি রাশিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে থাকতে পারেন।
সিআইডির তথ্যমতে, গত কয়েক বছরে প্রায় ২ হাজার মানুষ কাজের ভিসা নিয়ে রাশিয়ায় গেছেন।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, “কেউ যদি পড়াশোনা করতে গিয়ে লোভে পড়ে বা অন্য কারণে যুদ্ধক্ষেত্রে হাজির হয়, তাকে ঠেকানো আসলে কঠিন। তবে আমরা শুধু দেখব—আমাদের কাউকে জোর করে পাঠানো হচ্ছে কি না। কিন্তু আমরা সে রকম কিছু পাইনি।”
যুদ্ধক্ষেত্রের ভিডিও দিয়ে ভাইরাল সোহেল
সোহেল সরদার নীরব ফেসবুক–ইউটিউবে ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে নিয়মিত ভিডিও পোস্ট করছেন। সেসব ভিডিও লাখ লাখ ভিউ পাচ্ছে।
সম্প্রতি এক ভিডিওতে তিনি বলেন, “গতকাল আমি মারা যাইতাম, আমরা যে পজিশনে আছি। একটা ড্রোন আসছে, আমরা সেটা ফালায়ে দিছি। ওইটা গিয়া পড়ছে ৫ হাত দূরে। পরে দুই ঘণ্টা পর আরেকটা ড্রোন আসছে। পরে সেইটা আমরা দেইখা ফালাইছি দূরবীন দিয়া। আমরা মেশিন তো সেটআপ কইরা রাখছি, যখনই সামনে আইছে অটোমেটিকালি নিচে পইড়া গেছে গা।”
সোহেল সরদার নীরব ফেসবুক–ইউটিউবে ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্র পড়ে থাকা ড্রোন দেখাচ্ছেন।
পরে তিনি ক্যামেরায় ড্রোনটি দেখিয়ে জানান—এটি বাংলাদেশে নিয়ে আসবেন।
সোহেলের ফলোয়ার বাড়ছে দ্রুত। নেটিজেনরা তাঁকে গোলাগুলির ভিডিও দিতেও অনুরোধ করছেন।
মেরাজ–মোহসিনরা যেভাবে যুদ্ধে জড়ান
ভুক্তভোগীদের একজন তরুণ আফজাল হোসেন মেরাজ ২০২৪ সালের ১০ আগস্ট রাশিয়া যান ঝালাই মিস্ত্রি হিসেবে। মাসিক বেতন নির্ধারিত হয় ৭০ হাজার টাকা। এজন্য তিনি ফ্রেন্ডশিপ অ্যান্ড কো-অপারেটিভ রিক্রুটমেন্ট নামে একটি ট্রাভেল এজেন্সিকে সাড়ে ৬ লাখ টাকা দেন।
চার মাস চাকরির পর রাশিয়ায় এক দালাল তাঁকে জানান—যুদ্ধে যোগ দিলে ২৬ লাখ টাকার সাইনিং বোনাস, মাসে ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা বেতন, আহত হলে ১৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ আর রাশিয়া যুদ্ধ জিতলে নাগরিকত্ব। প্রলোভনে রাজি হলেও তাঁর পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে ফ্রন্টলাইনে পাঠানো হয়।
মেরাজের বাবা আলী হোসেন চলতি বছরের ২২ এপ্রিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তাঁর ছেলেকে দেশে ফিরিয়ে আনার আবেদন জানান। চিঠিতে তিনি অভিযোগ করেন—তাঁর ছেলেকে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
রাশিয়ান সৈন্যের সঙ্গে সোহেলের সেলফি।
আলী হোসেন বলেন,“ছেলেটা যুদ্ধ থেকে গোপনে হোয়াটসঅ্যাপ আর ইমোতে ফোন করে বলত, যে কোনো সময় সে মারা যেতে পারে। আমরা অসহায়ের মতো শুনেছি আর হাহাকার করেছি।”
যুদ্ধক্ষেত্রে মেরাজ দুজন বাংলাদেশিকে মারা যেতে দেখেছেন বলেও জানান তিনি।
১১ মাস রাশিয়ায় থাকার পর তিনি দেশে ফিরেছেন। উত্তরা থেকে চার মাস ওয়েল্ডিং প্রশিক্ষণ নিয়ে চায়না কোম্পানির মাধ্যমে রাশিয়ায় যান। চার মাস চাকরির পর অতিরিক্ত ঠান্ডায় কয়েক দিন অনুপস্থিত থাকায় তাঁকে চাকরি থেকে বের করে দেওয়া হয়। এরপর তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দিলে ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে তাঁকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়।
তিন মাস যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে আহত হলে তাঁকে হাসপাতালে ২৫ দিন চিকিৎসা দেওয়া হয়। এরপর দুই মাসের বিশ্রাম শেষে তিনি দূতাবাসের সহায়তায় দেশে ফেরেন।
পরিবার জানায়—মেরাজের এককালীন ৩০ লাখ টাকা, আহত হওয়ার পর ১৫ লাখ টাকা এবং মাসে ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা বেতন ব্যাংকে এসেছে।
যদিও তাঁকে নাগরিকত্ব দেওয়ার কাগজ জমা নেওয়া হয়েছিল—এখন আর তিনি তা নিতে চান না। বাবার ভাষায়—“সে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে চায়।”
ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের মোহসিন আহমেদও ঝালাই কাজের জন্য রাশিয়া গিয়েছিলেন। পরে নিজের ইচ্ছায় যুদ্ধে যোগ দেন। এখনও তিনি যুদ্ধক্ষেত্রেই আছেন।
ভাই মাহফুজ আহমেদ বলেন,“আমার ভাই নিজের ইচ্ছায় গেছে। তবে এখন সে প্রাণ বাঁচাতে দেশে ফিরতে চায়; কিন্তু আসার উপায় নাই। মাঝে মাঝে যোগাযোগ হয়। তার মতো আরও অনেক বাংলাদেশি সেখানে আটকা পড়ে আছে।” ৮ মাস ধরে মোহসিন রাশিয়ায় আছেন। তাঁকে ফিরিয়ে আনতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এবারের এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে আবেদন করা হয়েছে।
আয়ন–অমিতদের মণ্ডলের কী হয়েছে
যুদ্ধে থাকা বাগেরহাটের আয়ন মণ্ডল পরিবারকে কয়েক মাস আগে বলেছিলেন—তাঁকে ইউক্রেন সীমান্তে নেওয়া হচ্ছে। এরপর যোগাযোগ নেই। কুমিল্লার অমিত বড়ুয়ার একটি ছবিতে দেখা যায়—তিনি রুশ সামরিক পোশাকে। এরপর থেকে নিখোঁজ।
ব্র্যাক জানায়—তারা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ভুক্তভোগীদের উদ্ধারের আবেদন করেছে এবং সিআইডিতে মামলার নথি দিয়েছে। পরিবারগুলোকে আইনি ও মানসিক সহায়তাও দেওয়া হচ্ছে।
ইউক্রেনে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বাংলাদেশের তরুণ সোহেলের ভিডিও নিয়মিত ফেসবুকে আসছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্যদের রাশিয়ার যুদ্ধে যোগ দিতে উৎসাহ দিচ্ছেন।
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের সহযোগী পরিচালক বলেন—“মো. সোহেল নামে একজন বাংলাদেশি তরুণ তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে অন্যদের রাশিয়ার যুদ্ধে যোগ দিতে উৎসাহ দিচ্ছেন। কিন্তু এ বিষয়ে সরকার সচেতনতা তৈরির কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেয়নি।”
ওমরাহ ভিসা—সৌদি থেকে রাশিয়া
সিআইডির মানবপাচার দমন বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান জানান—গ্রিন হোম ট্রাভেলস নামে একটি এজেন্সি ২০ জনকে সৌদি আরবে ওমরা ভিসায় নিয়ে সেখান থেকে নথিপত্র প্রস্তুত করে রাশিয়ায় পাঠিয়েছে।
রাশিয়ায় মানবপাচারের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ছয়টি মামলা হয়েছে বলে জানান তিনি। মামলা হওয়ার পর থেকে গ্রিন হোম ট্রাভেলসের কর্তাব্যক্তিরা গা ঢাকা দিয়েছেন।
সিআইডি রাশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে নাগরিকদের সন্ধানের চেষ্টা করছে। তবে তথ্য খুব বেশি মিলছে না।
মোস্তাফিজুর বলেন—“রাশিয়ার অবস্থা এখন স্থিতিশীল না হওয়াতে ভালো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।”
তিনি জানান—চলতি বছরের জুন থেকে রাশিয়া আর কর্মী নিচ্ছে না—এটি ইতিবাচক দিক।
এখন পর্যন্ত কতজন বাংলাদেশি নিহত বা আহত হয়েছেন—সে বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য নেই।
সিআইডি কর্মকর্তা বলেন—“কোনো মৃতদেহ এখনও দেশে আনা যায়নি।”