যৌন নিপীড়নের অভিযোগে আটক, বৃদ্ধের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় নিয়ে তোলপাড়
জাগো বাংলা প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২৫, ০১:৫০ পিএম
ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে কিশোরীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে আব্দুল করিম (৭৬) নামের একজনকে আটক করে গাছে বেঁধে ও জুতার মালা পরিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে ক্ষুব্ধ জনতা। পুলিশ তাকে হেফাজতে নেওয়ার পর নিজেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবি করেন আব্দুল করিম। আর সেখানেই ঘটে বিপত্তি।
গফরগাঁও উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সাইফুল আলম সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানান, আব্দুল করিম মুক্তিযোদ্ধা নন। তবে ভালুকা উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. জামাল হোসেন নিশ্চিত করেছেন, গ্রেফতার আব্দুল করিম ভালুকার তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা।
যেভাবে ঘটনার শুরু
মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গফরগাঁওয়ের মুখী গ্রামে এক কিশোরীকে বাড়িতে একা পেয়ে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ওঠে আব্দুল করিমের বিরুদ্ধে। এসময় ক্ষুব্ধ জনতা তাকে আটক করে গাছে বেঁধে-জুতার মালা পরিয়ে পুলিশে সোপর্দ করেন। পুলিশের কাছে তিনি নিজেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবি করেন।
গফরগাঁও ও পাগলা থানা নিয়ে গফরগাঁও উপজেলা গঠিত। এই উপজেলার কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধাকে গাছে বেঁধে-জুতার মালা পরিয়ে রাখা হয়েছে- এমন ঘটনা জানতে পেরে মনটা বিষণ্ন হয়ে যায়। পরে আমার কাছে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তিনটি তালিকা যাচাই-বাছাই করি। কিন্তু কোথাও আব্দুল করিমের নাম পাওয়া যায়নি। তার মানে, তিনি মুক্তিযোদ্ধা নন। এমতাবস্থায় সবাইকে জানাতে আমি একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি।’
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) ওয়েবসাইট থেকে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই’-এর গফরগাঁওয়ের তালিকায় দেখা গেছে, সেখানে ৩৯৫ জনের নাম এবং তাদের বাবার নাম, গ্রামের নাম, ডাকঘর ও বেসামরিক গেজেট নম্বর দেওয়া আছে। এই তালিকায় শুধু একজন আব্দুল করিম পাওয়া গেছে। তালিকার ২৬১ নম্বরে ‘মো. আব্দুল করিম’ নামে একজনের নাম পাওয়া গেলেও তিনি ভিন্ন ব্যক্তি। তার গ্রামের বাড়ি গফরগাঁওয়ের মহিরখারুয়া। বাবার নাম মৃত গিয়াস উদ্দিন আহাম্মদ। আর গ্রেফতার হওয়া আব্দুল করিম থাকতেন গফরগাঁওয়ের পাগলা থানাধীন মশাখালী ইউনিয়নের মুখী গ্রামে। তার বাবার নাম মৃত কেরামত আলী।
অপরদিকে ভালুকা উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. জামাল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘গ্রেফতার আব্দুল করিম ভালুকার বাসিন্দা। তিনি এখানকার তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা। তবে তিনি ২০ বছর যাবৎ গফরগাঁওয়ে ঘরজামাই হিসেবে বসবাস করেন। এলাকায় তেমন একটা আসেন না।’
ভালুকা উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় আব্দুল করিমের নাম পাওয়া গেছে। সেখানে তার বাবার নাম উল্লেখ আছে কেরামত আলী। বাড়ি বিরুনীয়া ইউনিয়নের চান্দরাটি গ্রামে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সনদপত্রে দেখা যায়, গ্রেফতার আব্দুল করিম একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তার বাবার নাম কেরামত আলী শেখ। গ্রাম- নামা মাহমুদপুর, ডাকঘর চান্দরহাটী, উপজেলা- ভালুকা, জেলা-ময়মনসিংহ।
বক্তব্য জানতে চাইলে ময়মনসিংহ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সদস্য সচিব মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল খালেক বলেন, ‘ঘটনাটি জানার পরপরই গফরগাঁও উপজেলার কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল আলমকে নথিপত্র যাচাই করতে বলি। তিনি আব্দুল করিম মুক্তিযোদ্ধা না বলে জানান। তবে এখন ভালুকা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বলছেন, আব্দুল করিম ভালুকার মুক্তিযোদ্ধা।’
আব্দুল করিম ভালুকার মুক্তিযোদ্ধা
ভালুকার বিরুনিয়া ইউনিয়নের কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা নূরুল হক বলেন, ‘প্রায় ৩৫ বছর যাবত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল করিম ভালুকার পার্শ্ববর্তী গফরগাঁও উপজেলার মুখী গ্রামে বসবাস করেন। তাই গফরগাঁওয়ের লোকজন তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চেনেন না। ফলে বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল করিমকে মব সৃষ্টি করে পুলিশের হাতে সোপর্দ করা হয়েছে। তিনি ওই কিশোরীকে যৌন নিপীড়ন করেছে কি না, তা আমরাও যাচাই-বাছাই করছি।’
ভালুকা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার নাজিম উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্রে মো. আবদুল করিম, পিতার নাম- কেরামত আলী শেখ লেখা আছে। আর অনলাইন তালিকায় মো. আব্দুল করিম, পিতার নাম- কেরামত আলী লেখা আছে। হয়ত লেখার সময় একটু গড়মিল হয়েছে। তবে আব্দুল করিম প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযোদ্ধা। তিনি সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন।’
একই উপজেলা সংসদের কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা মো. জামাল হোসেন বলেন, ‘গফরগাঁওয়ের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল আলম মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল করিমকে চিনতে না পারায় বলেছিলেন- আব্দুল করিম মুক্তিযোদ্ধা না। এটি ঠিক- আব্দুল করিম গফরগাঁওয়ের মুক্তিযোদ্ধা না, তবে তিনি ভালুকার মুক্তিযোদ্ধা।’
ময়মনসিংহ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সদস্য সচিব কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক বলেন, ‘অপরাধী যেই হোক আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান। তবে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল করিমের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, প্রকৃতপক্ষে তার সত্যতা রয়েছে কি না, পুলিশ তা সঠিকভাবে তদন্ত করবে বলে আশা করছি।’
যা বলছে পুলিশ
এ বিষয়ে পাগলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফেরদৌস আলম বলেন, ‘আব্দুল করিম আমাদের কাছে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবি করেছিলেন। তবে আমরা তা যাচাই-বাছাই করার সুযোগ পাইনি। পরে ওই কিশোরীর বাবার অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা হিসেবে নথিবদ্ধ করে তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।’
গফরগাঁও সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মনোতোষ বিশ্বাস বলেন, ‘গ্রেফতার আব্দুল করিম মুক্তিযোদ্ধা কিনা তা মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট না দেখে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। তিনি মামলার আসামি। সে হিসেবেই তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।’