এই সরকারের আমলে নতুন পে স্কেল কার্যকর নিয়ে ‘শঙ্কা’
জাগো বাংলা প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৬:২৪ পিএম
সরকারি চাকরিজীবীদের নতুন বেতন কাঠামো চূড়ান্ত করতে শেষ মুহূর্তে ব্যস্ত সময় পার করছেন পে কমিশনের সদস্যরা। গত ৩০ অক্টোবর বিভিন্ন সমিতি ও অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে মতবিনিময় শেষ করেছে কমিশন। এখন সব প্রস্তাব ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে চূড়ান্ত সুপারিশের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। তবে এই সরকারের আমলে নতুন পে স্কেল কার্যকর নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ।
তাদের যুক্তি, কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, পে স্কেলের সুপারিশ আগামী ডিসেম্বর কিংবা জানুয়ারির মধ্যে ঘোষণা হতে পারে। কিন্তু নির্বাচনী মহাযজ্ঞ বিশেষ করে তপসিল, রোডম্যাপ ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে মধ্য ডিসেম্বর থেকেই সরকারের ব্যস্ততা যে পরিমাণ বাড়বে; তাতে পে স্কেলে নজর দেওয়া সরকারের পক্ষে কতটা সম্ভব হবে— তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। শঙ্কা রয়েছে পে স্কেল বাস্তবায়নে বাজেট নিয়েও। এ ক্ষেত্রে সর্বশেষ শিক্ষক আন্দোলন দমাতে অতিরিক্ত সাড়ে ৭ শতাংশ বাড়ি ভাড়া বাস্তবায়নে শিক্ষা মন্ত্রণালয়-অর্থ মন্ত্রণালয় যে পরিমাণ লুকোচুরি করেছে; তাতে সহজেই অনুমেয়- সরকারের হাতে বাড়তি অর্থ নেই। বিষয়টি নিয়ে সে সময় খোলাখুলি বক্তব্যও দিয়েছিল খোদ দুই মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্তারা।
এর আগে পে কমিশনের সভাপতি ও সাবেক অর্থ সচিব জাকির আহমেদ খান জানিয়েছিলেন, ‘কার্যক্রম দ্রুতগতিতে চলছে। আশা করি নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই কমিশন সুপারিশ জমা দিতে পারবে।’ নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক সদস্য জানিয়েছিলেন, তাদের দায়িত্ব সুপারিশ পর্যন্ত, বাস্তবায়নের নয়।
কী হবে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার? বিষয়টি নিয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আইনুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘পে কমিশন প্রস্তাব দিলেও আমার মনে হয় রাজনৈতিক কৌশলও থাকতে পারে। সরকার আলোচনা করে হয়তো বাস্তবায়নের দায়িত্ব আগামী সরকারের কাছেই ঠেলে দিতে পারে। তখন বলা হবে, এই জিনিসটা বাস্তবায়ন করবে আগামীর নির্বাচিত সরকার। শেষ মুহূর্তে এসে এরকম সিদ্ধান্ত আসতে পারে। কারণ সময় খুবই কম’।
তিনি বলেন, “ফেব্রুয়ারিতে যদি নির্বাচন হয় কমিশনের মেয়াদ আছে ফেব্রুয়ারি ১৪ তারিখ পর্যন্ত। প্রত্যেকেরই কিন্তু একটা কৌশল আছে, সরকার যেমন তার একটা কৌশলে কাজ করবে রাজনৈতিক দলগুলোরও কৌশল আছে। রাজনৈতিক কৌশল এমন হতে পারে যে, আসলে আলোচনা করে কিংবা অন্যভাবে এই সময়টা পার হয়ে যাবে। আলোচনা করতে করতে হয়তো দেখা যাবে, নির্বাচন চলে আসবে তখন আমরা সবাই নির্বাচনের দিকে মনোযোগী হবো। সবাই ভোটার এবং নির্বাচনের উপর গুরুত্ব দেবে। ফলস্বরূপ এটা আসলে নির্বাচিত সরকারের কাছেই চলে যেতে পারে বলে”।
বেতন-ভাতা দ্বিগুণ করা হলে বছরে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হবে। এছাড়া, গড়ে ৯০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হলেও প্রায় ৭০-৭৫ হাজার কোটি এবং ৮০ শতাংশ বৃদ্ধি করলে প্রায় ৬৫-৭০ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ হবে। এই অতিরিক্ত টাকার যোগান দিতে সরকারের বেগ পেতে হতে পারে।
ইতোপূর্বে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, এই সরকারই নতুন পে স্কেল কার্যকর করতে চায়। সে হিসেবে আগামী ডিসেম্বর বা জানুয়ারির মধ্যে কমিশনের সুপারিশ পেলে দ্রুত সময়ের মধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকার পে স্কেল কার্যকর করতে পারবে।
নতুন পে স্কেল কার্যকর করা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার সরকারি কর্মচারীদের চাপের মুখে রয়েছে বলেও মনে করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই অধ্যাপক। তার কথায়, তারা (সরকার) ইতোমধ্যে বলেছেন— আমরা ছয় মাসের মধ্যে কমিশন সুপারিশ দেবে এবং অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, আগামী বছর আমাদের আমলেই নতুন স্কেল কার্যকর করে। সরকার একদিকে যেমন নির্বাচনের বিষয়গুলো নিয়ে প্রচণ্ড রকমের চাপের মধ্যে আছে, আবার কর্মচারীদের কাছ থেকেও বেতনভাতা বৃদ্ধি নিয়ে বহুমুখী চাপের মধ্যে আছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার উন্নয়ন বাজেটে কাটছাঁট করতে পারে। সেক্ষেত্রে উন্নয়ন বাজেট যদি কমিয়ে আনা যায়, তাহলে অতিরিক্ত ব্যয় বহন করা সহজ হবে। কিন্তু সরকার যদি উন্নয়নের সাথে নেগোশিয়েট করে সেটাও আবার মানুষ মানতে চায় না। বাংলাদেশের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, মানুষ উন্নয়ন চায় দ্রুতগতিতে আবার তাদের বেতন-ভাতাও বেশি করতে চায়।
পে কমিশন সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, নতুন স্কেলে বেতন দ্বিগুণ হতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে পে স্কেল না পেয়ে কর্মজীবীরা একাধিকবার আন্দোলনেও নেমেছেন। এখন বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধিতে তৎপর চাকরিজীবীদের সংগঠনগুলো। নতুন স্কেল অনুযায়ী কর্মজীবীদের বেতন-ভাতা দিতে সরকারকে গুনতে হবে বাড়তি টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার জন্য বরাদ্দ ছিল প্রায় ৮২ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যার মধ্যে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ইনক্রিমেন্টসহ এই ব্যয় বেড়েছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৮৪ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা। তবে নতুন পে স্কেল কার্যকর করতে হলে বাড়তি টাকা লাগবে সরকারের।
এদিকে সরকারি চাকরিজীবীদের নতুন পে স্কেল নিয়ে আলোচনা জোরদার হলেও এই সরকারের আমলে তা কার্যকর হওয়ার শঙ্কা উত্থাপিত হয়েছে বিশেষজ্ঞ মহলে। পে কমিশন সকল প্রস্তাব পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত সুপারিশের কাজ প্রায় শেষ করলেও রাজনৈতিক সময়সূচি, নির্বাচন এবং বাজেটের চাপ বিবেচনায় বাস্তবায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে বেতন-ভাতা দ্বিগুণ হলে বছরে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা বাড়তি ব্যয়ের বিষয়টি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগামী নির্বাচনের প্রাক্কালে সরকার একদিকে রাজনৈতিক চাপের মুখে, অন্যদিকে কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দাবিতেও জর্জরিত। যার ফলে এই সিদ্ধান্ত নতুন নির্বাচিত সরকারের উপর ন্যস্ত হওয়ার সম্ভাবনার কথাই উঠে আসছে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলে তবে এ স্বল্প সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দ্রুত সময়ে এই স্কেল বাস্তবায়ন করতে পারবে না বলে অনেকেরে মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
প্রসঙ্গত, বেতন-ভাতা দ্বিগুণ করা হলে বছরে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হবে। এছাড়া, গড়ে ৯০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হলেও প্রায় ৭০-৭৫ হাজার কোটি এবং ৮০ শতাংশ বৃদ্ধি করলে প্রায় ৬৫-৭০ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ হবে। এই অতিরিক্ত টাকার যোগান দিতে সরকারের বেগ পেতে হতে পারে।