Logo
Logo
×

জাতীয়

ফাঁদে পড়ে রাশিয়ার যুদ্ধে বাংলাদেশি যুবকরা

Icon

জাগো বাংলা প্রতিবেদন

প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৬:১৭ পিএম

ফাঁদে পড়ে রাশিয়ার যুদ্ধে বাংলাদেশি যুবকরা

রাশিয়ায় বৈধভাবে চাকরির উদ্দেশ্যে যাওয়া অন্তত ১০ জন বাংলাদেশি এখন বাধ্য হয়েছেন ইউক্রেন যুদ্ধে অংশ নিতে। তাঁদের পরিবার মরিয়া হয়ে স্বজনদের দেশে ফেরানোর দাবি জানাচ্ছে।

এমন ঘটনা বেশ পুরানো কিন্তু সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধ করা বেশ কিছু ভিডিও ভাইরাল হয়ে। তাদেরকে বাংলায় কথা বলতে শোনা যায়। তারা যুদ্ধে ব্যবহার করা বিভিন্ন অস্ত্র ভিডিওতে দেখাচ্ছে, কিভাবে সেগুলো ব্যবহার করা এবং কোন কোন কাজে সে গুলো ব্যবহার করা হয়।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির সর্বশেষ প্রতিবেদনে, যার শিরোনাম- ‘Promises Written in Blood: How Legal Migration Turned into Forced Recruitment in the Russia-Ukraine War’। এক তথ্য উঠে এসেছে।

গত সোমবার (৩ নভেম্বর) প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুদ্ধক্ষেত্রে নিখোঁজ বা আটকে পড়া বাংলাদেশিদের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে, তবে সঠিক পরিসংখ্যান এখনো জানা যায়নি।

ব্র্যাকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দালালচক্রের সদস্যরা উচ্চ বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে এসব শ্রমিককে রাশিয়ায় পাঠায়। কেউ কেউ তেল, নির্মাণ বা পরিবহন খাতে কাজের কথা শুনে যান। কিন্তু সেখানে পৌঁছে তাঁদের পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করে সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়।

সংস্থার সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, আমাদের কাছে অন্তত ১০টি পরিবার আবেদন করেছে তাদের প্রিয়জনকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য। তাঁরা বৈধ ভিসায় রাশিয়া গিয়েছিলেন, কিন্তু প্রতারণার শিকার হয়েছেন।

তিনি আরও জানান, এসব শ্রমিকের বেশিরভাগই ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা খরচ করে রাশিয়া যান, আর প্রতারণার সঙ্গে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় দালালচক্রই জড়িত।

ব্র্যাক জানায়, তারা ইতিমধ্যেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সিআইডির কাছে অভিযোগ জমা দিয়েছে এবং ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে আইনি ও মানসিক সহায়তা প্রদান করছে।

প্রতিবেদনে বাগেরহাটের অয়ন মণ্ডল ও কুমিল্লার অমিত বড়ুয়ার ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। অয়ন শেষবার তাঁর পরিবারকে জানিয়েছিলেন, তাঁকে ইউক্রেন সীমান্তের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এরপর তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

অমিত বড়ুয়ার একটি ছবিতে দেখা যায়, তিনি রুশ সেনা পোশাকে রয়েছেন-এর পর থেকেই তিনি নিখোঁজ।

ময়মনসিংহের আলী হোসেন জানান, তাঁর ছেলে আফজাল হোসেন এক ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে রাশিয়ায় যান। পরে তাকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয় এবং মাইন বিস্ফোরণে আহত হন। পরে মস্কোর বাংলাদেশ দূতাবাসের সহযোগিতায় দেশে ফেরেন তিনি।বাংলা ভাষার বই

অভিবাসন গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরু (Refugee and Migratory Movements Research Unit) জানায়, অনেককে সরাসরি রাশিয়া নয়, বরং সৌদি আরব হয়ে ট্যুরিস্ট বা ওমরাহ ভিসায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে-পরে তাঁদের যুদ্ধের ময়দানে পাঠানো হচ্ছে।

রামরুর নির্বাহী পরিচালক তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, রাশিয়ায় কতজন বাংলাদেশি যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয়েছে, কতজন নিহত বা আহত হয়েছেন-এ বিষয়ে সরকারি উদ্যোগেই তথ্য সংগ্রহ করতে হবে।

এদিকে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মানবপাচারকারীদের মাধ্যমে যুদ্ধের ফাঁদে পড়া কয়েকজন বাংলাদেশি ইতিমধ্যেই শনাক্ত হয়েছেন। রাশিয়ায় মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত একজন দালাল গ্রেপ্তারও হয়েছে।

চলতি বছরের এপ্রিলে এএফপি জানিয়েছিল, ইউক্রেনের যুদ্ধে রাশিয়ার হয়ে লড়তে গিয়ে ২২ বছর বয়সী এক বাংলাদেশি যুবক নিহত হয়েছেন। এরপর থেকে মস্কোয় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে অন্তত ডজনখানেক পরিবার নিখোঁজদের খোঁজে আবেদন করেছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রফিকুল আলম বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় অনেকেই প্রতারণার মাধ্যমে সেখানে পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি গভীরভাবে তদন্ত করা হচ্ছে এবং বিমানবন্দরগুলোতে বাড়তি সতর্কতা জারি করা হয়েছে।

এ বিষয়ে এ বছর রোববার (৯ ফেব্রুয়ারি) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মোহাম্মদ রফিকুল আলম এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি যে একটি বাংলাদেশি এজেন্সি রাশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কাজ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কয়েকজন বাংলাদেশিকে রাশিয়ায় পাঠিয়েছে। একপর্যায়ে তাঁদের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে জড়াতে বাধ্য করা হয়। ইতিমধ্যেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে মস্কোতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের কাছ থেকে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাওয়া হয়েছে।’

১৪ জুনে ওই চক্রের মূল হোতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই চক্র চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে লোকজনকে রাশিয়ায় নিয়ে যুদ্ধ অংশ নিতে বাধ্য করে।

আকর্ষণীয় বেতনে চকলেট কারখানায় পরিচ্ছন্নতাকর্মী বা বাবুর্চির কাজের প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশ থেকে লোকজনকে রাশিয়ায় নিয়ে যায় একটি চক্র। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর তাঁদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিতে বাধ্য করে। ওই যুদ্ধে অংশ নিয়ে কয়েকজন নিহতও হয়েছেন।

সিআইডির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ৪ ফেব্রুয়ারি বনানী থানায় হওয়া মানব পাচার আইনের মামলায় আলমগীরকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তিনি ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। আদালত জবানবন্দি নিয়ে তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। আলমগীরের বাড়ি চট্টগ্রামের লোহাগড়া থানার আমতলী মাঝেরপাড়া গ্রামে।

তদন্তে সিআইডি আরও জানতে পারে, ১০ জনের আরেকটি দল সৌদি আরবে অবস্থান করছে। রাশিয়ায় নিয়ে তাঁদের জোরপূর্বক যুদ্ধে অংশ নেওয়ার বিষয়ে জানাজানি হওয়ায়, তাঁরা রাশিয়ায় যেতে অস্বীকৃতি জানান। এ কারণে সেখান থেকে তাঁদের পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়। তাই তাঁরা সৌদি আরবে কোনো কাজ করতে পারছেন না এবং দেশে ফিরতেও পারছেন না।

দ্য ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভুক্তভোগীদের একজন আফজাল হোসেন মেরাজ, যিনি ২০২৩ সালের আগস্টে রাশিয়া যান ওয়েল্ডার (ঝালাইমিস্ত্রী) হিসেবে। মাসে ৭০ হাজার টাকা বেতনের চাকরির প্রলোভনে তিনি উত্তরা এলাকার এক রিক্রুটিং এজেন্টকে ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেন, যার মধ্যে প্রশিক্ষণ খরচও ছিল।

চার মাস পর রাশিয়ায় এক দালাল তাকে নতুন কাজের প্রস্তাব দেয়। দালাল জানায়—যুদ্ধে যোগ দিলে ২৬ লাখ টাকার সাইনিং বোনাস, মাসে ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা বেতন, আহত হলে ১৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ আর রাশিয়া যুদ্ধ জিতলে নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতি।

মেরাজ রাজি হয়ে যান। কিন্তু পরে তার পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয় এবং তাকে ফ্রন্টলাইনে পাঠানো হয়।

মেরাজের বাবা আলী হোসেন বলেন, 'আমার ছেলে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে গোপনে হোয়াটসঅ্যাপ আর ইমোতে ফোন করে। বলে—যেকোনো সময় সে মারা যেতে পারে। আমরা নিরুপায় হয়ে সব শুনেছি শুধু।'

মেরাজ নিজের চোখে দুজন বাংলাদেশিকে যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যেতেও দেখেছেন বলে জানিয়েছেন। জুন মাসে উরুতে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। পরে হাসপাতালে থেকে পালিয়ে মস্কোতে বাংলাদেশ দূতাবাসে পৌঁছান। দূতাবাস তার দেশে ফেরার ব্যবস্থা করে সেপ্টেম্বর মাসে।

আলী হোসেন বলেন, 'হ্যাঁ, আমরা কিছু টাকা পেয়েছিলাম। কিন্তু তারা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমার ছেলেকে যুদ্ধে পাঠিয়েছে। জীবনের চেয়ে বড় কিছু নাই।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: মহিউদ্দিন সরকার