উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমির বণ্টন ও নামজারি নিয়ে দীর্ঘদিনের জটিলতা, প্রতারণা এবং পারিবারিক সংঘাত নিরসনে বড় ধরনের কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। ভূমি মন্ত্রণালয় এক নতুন পরিপত্র জারি করেছে, যার ফলে এখন থেকে বণ্টননামা দলিল (Partition Deed) ছাড়া কোনো ওয়ারিশ এককভাবে জমির নামজারি (মিউটেশন) করতে পারবেন না।
এই পরিপত্র জারির পর থেকে সারা দেশে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমির নামজারি কার্যক্রম কার্যত স্থগিত হয়ে গেছে। এই পদক্ষেপের প্রধান লক্ষ্য হলো, একক ওয়ারিশ দ্বারা অন্যদের সম্পত্তি গ্রাস করার সুযোগ চিরতরে বন্ধ করা।
একক নামজারি কেন বন্ধ?
ভূমি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে স্পষ্ট বলা হয়েছে, একাধিক ওয়ারিশ থাকলে তারা যৌথভাবে নামজারির জন্য আবেদন না করা পর্যন্ত সহকারী কমিশনার (ভূমি) বা এসিল্যান্ড কোনোভাবেই নামজারি সম্পন্ন করতে পারবেন না।
নতুন নিয়মে নামজারি করা হবে যৌথ খতিয়ানের ভিত্তিতে, যাতে কোনো ওয়ারিশ একক মালিকানা দাবি করে অন্যদের বঞ্চিত করতে না পারে।
সরকারের ভাষ্যমতে, বণ্টননামা দলিল না থাকায় উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমি নিয়ে ওয়ারিশদের মধ্যে বিরোধ, মামলা-মোকাদ্দমা এবং সহিংসতার ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছিল। এক ওয়ারিশের বিক্রি করা জমি নিয়ে অন্য ওয়ারিশের আপত্তি বা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ প্রায় নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। এই জটিলতা দূর করতেই সরকার এই কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে।
দালালচক্র ও দুর্নীতি দমনে প্রভাব
দীর্ঘদিন ধরে নামজারি প্রক্রিয়া দালালচক্র ও দুর্নীতির কারণে সাধারণ ভূমি মালিকদের জন্য চরম হয়রানির প্রতীক হয়ে উঠেছিল।
সরকারি নির্ধারিত ফি ১,১৭০ টাকা থাকা সত্ত্বেও দালালচক্র সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ৫,০০০ থেকে ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছিল।
বিভিন্ন অঞ্চলে এসব দালাল সরকারি কর্মকর্তা না হয়েও নিজেদের 'নামজারি করিয়ে দেওয়ার বিশেষজ্ঞ' পরিচয়ে জনগণকে প্রতারিত করত, যেখানে স্থানীয় কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীও জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল।
নতুন নিয়মে নামজারি প্রক্রিয়ায় কঠোরতা আসায়, একক ব্যক্তির মাধ্যমে জালিয়াতির সুযোগ কমবে এবং দালালদের প্রভাব অনেকটাই হ্রাস পাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ওয়ারিশদের জন্য সমাধানের পথ
ভূমি মন্ত্রণালয় ওয়ারিশদের সম্পত্তি বৈধভাবে বণ্টনের জন্য দুটি স্পষ্ট পথ দেখিয়েছে:
আপস ও পারিবারিক বণ্টননামা: ওয়ারিশরা নিজেদের মধ্যে আপসের ভিত্তিতে আলোচনা করে একটি পারিবারিক বণ্টননামা দলিল তৈরি করে নিতে পারবেন।
আদালতের মাধ্যমে বাটোয়ারা: কেউ আপসে রাজি না হলে বিজ্ঞ আদালতে বণ্টননামা বা বাটোয়ারা মামলা দায়েরের সুযোগ থাকবে।
আদালতের রায় অনুযায়ী বণ্টন সম্পন্ন হওয়ার পর, সংশ্লিষ্ট এসিল্যান্ড সেই অনুযায়ী নামজারি অনুমোদন দেবেন।
বিশেষজ্ঞদের অভিমতে, ভূমি বিশেষজ্ঞরা সরকারের এই পদক্ষেপকে যুগান্তকারী আখ্যা দিয়েছেন। তাদের মতে, এই সিদ্ধান্তে স্বল্পমেয়াদে নামজারি কার্যক্রমে কিছুটা ধীরগতি এলেও, দীর্ঘমেয়াদে এর ফল সুদূরপ্রসারী হবে। এটি ভূমি জালিয়াতি, ওয়ারিশদের মধ্যে সংঘাত এবং একাধিক মালিকানাজনিত জটিলতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে ভূমি ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনবে।