রাজধানীতে ধরা পড়ছে বিষধর গোখরা, রাসেল ভাইপার
জাগো বাংলা প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২৫, ০২:৫৭ পিএম
ভাবুন তো—সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলেন ঘরে একটি গোখরা সাপ, অথবা শুনলেন বাসার গ্যারেজে সাপ ঘুরছে! নিশ্চয়ই ভয় আর আতঙ্কে জমে যাবেন। সম্প্রতি ঢাকার অনেক এলাকাতেই এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
গত চার মাসে রাজধানীর বিভিন্ন জনবহুল এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে তিন শতাধিক বিষধর সাপ। কারও বাসার ভেতর, কারও গ্যারেজে, আবার কোথাও বহুতল ভবনের নয়তলা পর্যন্তও সাপ পাওয়া গেছে। এসবের মধ্যে পদ্মগোখরা, রাসেল ভাইপার, খৈয়া গোখরা, রাজ কেউটের মতো মারাত্মক বিষধর প্রজাতিও রয়েছে।
সাধারণত বর্ষাকালেই সাপ বেশি দেখা যায়। বৃষ্টির পানিতে তাদের গর্ত ভরে গেলে শুকনো জায়গার সন্ধানে সাপ আশ্রয় নেয় মানুষের ঘর বা উঁচু জায়গায়। তবে ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে এত সংখ্যক বিষধর সাপের উপস্থিতি গবেষকদেরও অবাক করছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ আহসান বিষয়টিকে ‘অস্বাভাবিক এবং উদ্বেগজনক’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ঢাকায় কিছু ঝোপঝাড় থাকলে সাপ থাকতে পারে, কিন্তু এত সংখ্যায় পাওয়া সত্যিই চিন্তার বিষয়।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ভেনম রিসার্চ সেন্টারের গবেষণা সহযোগী মো. মিজানুর রহমান মনে করেন, শহরের জলাশয়, খাল-বিল ভরাট করে মানুষ সাপের আবাস ধ্বংস করেছে, তাই তারা আশ্রয়ের খোঁজে মানুষের ঘরে ঢুকছে।
বাংলাদেশ অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন নামের একটি সংস্থার বরাত দিয়ে বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়, গত চার মাসে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে তারা ৩৫১টি সাপ উদ্ধার করেছে। এর মধ্যে মাত্র তিনটি নির্বিষ, বাকিগুলো বিষধর। সংস্থার আহ্বায়ক আদনান আজাদ বলেন, সবচেয়ে বেশি সাপ পেয়েছি উত্তরার ১৮ নম্বর সেক্টরের রাজউকের ফ্ল্যাট এলাকায়। সাততলা ও নয়তলা ভবন থেকেও সাপ উদ্ধার করেছি।
তিনি ধারণা করেন, এসব ভবনের নিচের অংশে লতানো গাছ থাকায় সেগুলো বেয়ে সাপ উপরে উঠেছে। উদ্ধার হওয়া সাপগুলোর মধ্যে পদ্মগোখরা সবচেয়ে বেশি—৩৫১টির মধ্যে প্রায় দুইশ’ই পদ্মগোখরা। শুধু গত দুই দিনেই খিলগাঁওয়ের কয়েকটি বাসা থেকে ৩৮টি পদ্মগোখরা উদ্ধার করা হয়েছে, যার মধ্যে বড় সাপ, বাচ্চা এবং ডিমও রয়েছে।
অধ্যাপক ফরিদ আহসান বলেন, পদ্মগোখরা মূলত পানিপ্রেমী সাপ। নদী, জলাশয়, খাল-বিলে থাকতে ভালোবাসে, তবে আশপাশের ঝোপঝাড় ও গর্তেও দেখা যায়।
তাহলে হঠাৎ এত সাপ কেন?
বিশেষজ্ঞদের মতে, সাপের প্রজননকাল এখন চলমান, পাশাপাশি তাদের বাসস্থান সংকুচিত হয়েছে। মিজানুর রহমান বলেন, আমরা আসলে সাপের জায়গায় গিয়েছি। আগে এসব সাপ মানুষ মেরে ফেলত, এখন উদ্ধারকারী সংগঠন থাকায় ঘটনাগুলো সামনে আসছে।
আদনান আজাদ জানান, নভেম্বর পর্যন্ত আরও বেশি সাপ পাওয়া যেতে পারে, কারণ অক্টোবর-নভেম্বর পদ্মগোখরার প্রজননকাল। আগস্টে খৈয়া গোখরার প্রজননকাল ছিল, তখনও একটি বাসা থেকে মা গোখরাসহ ২৭টি বাচ্চা উদ্ধার করেছেন তারা।
তিনি আরও বলেন, আগে আফতাবনগর, উত্তরা, দিয়াবাড়ি এলাকায় জলাশয় ছিল—সেগুলোই ছিল সাপের আবাস। এখন মানুষ সেসব জায়গায় ভবন তৈরি করেছে। ফলে সাপ পেছনের অব্যবহৃত জমি বা ফাঁকা প্লটে চলে গেছে। ভারী বৃষ্টিতে গর্তে পানি ঢুকলে তারা আশ্রয়ের খোঁজে ঘরে ঢুকে পড়ে।
আইন অনুযায়ী, উদ্ধারকৃত বন্যপ্রাণী প্রকৃতিতে ছেড়ে দিতে হয়। মিজানুর রহমান জানান, উদ্ধার হওয়া সাপ কারও কাছে রাখার অনুমতি নেই, কেবল গবেষণার জন্য ভেনম রিসার্চ সেন্টারের অনুমোদন রয়েছে।
আদনান আজাদ জানান, উদ্ধার করা সাপগুলো সাধারণত শহরের বাইরে বনাঞ্চলে ছেড়ে দেওয়া হয়, যেখানে তারা মানুষের সংস্পর্শে না এসে নিজস্ব পরিবেশে ফিরে যেতে পারে। প্রতিটি অভিযান শেষে তারা বন বিভাগকে অবহিত করেন, যদিও সবসময় তা জানানো সম্ভব হয় না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জলাশয় ও খাল-বিল রক্ষা না করলে এমন সাপের উপদ্রব আরও বাড়বে। তাই মানুষের পাশাপাশি প্রাণিকুলের নিরাপদ বাসস্থান রক্ষায় এখনই কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন।