সাবেক এমপিদের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা ৩০টি গাড়ি নিয়ে নাটক চলছেই। বারবার আলোচনায় আসছে নামিদামি ব্র্যান্ডের গাড়িগুলো। কোনোভাবেই প্রসঙ্গটির নিষ্পত্তি হচ্ছে না। এবার চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের শুল্ক ছাড়ের গ্যাঁড়াকলে আটকে গেল যানবাহন অধিদপ্তরে হস্তান্তরের সরকারি নিদের্শনা।
জানা গেছে, গত মাসের শেষদিকে সরকার সিদ্ধান্ত নেয় সাবেক এমপিদের শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা ৩০টি গাড়ি সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরে দেওয়ার। এ জন্য একটি লিখিত নির্দেশনা এসেছিল চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে। সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অন্য একটি নির্দেশনায় আগের সেই আদেশ স্থগিত করেছে। ফলে সামনে চলে এসেছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের শুল্ক এবং চট্টগ্রাম বন্দরের ডেমারেজ ও বন্দর চার্জ পরিশোধের বিষয়টি। এতেই আটকে গেল রাষ্ট্রায়ত্ত যানবাহন অধিদপ্তরে গাড়িগুলো যাওয়ার রাস্তা।
এর আগে গাড়িগুলো একবার নিলামে তোলা হয়েছিল। নিলাম থেকে সেগুলো হাতিয়ে নিতে কারসাজি করছিল একটি সিন্ডিকেট। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে পরে নিলাম স্থগিত করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সে সময় সরকারি সংস্থাকে গাড়িগুলো দিয়ে দেওয়ার বিষয়টি সামনে আসে। এনবিআরের ওই নির্দেশনায় গাড়িগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত যানবাহন অধিদপ্তরে জমা দেওয়া কথা ছিল গত অক্টোবর মাসেই। গত ২৮ সেপ্টেম্বর এনবিআর থেকে এ-সংক্রান্ত চিঠি আসে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে। চিঠিতে বলা হয়, ‘দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম বন্দরে পড়ে থাকা শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা মূল্যবান ৩০টি গাড়ি বিকল্প উপায়ে নিষ্পত্তির সুযোগ থাকায় অর্থ বিভাগের সিদ্ধান্তে ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে কর্তৃক গাড়িগুলো সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত হয়। নিলামের স্থায়ী আদেশ ২০২২-এর অনুচ্ছেদ ৭-এর (১)-এর ক্লজ(ট)-এর বিধান অনুযায়ী গাড়িগুলো সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরে হস্তান্তরের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসকে নির্দেশ প্রদান করা হলো।’
গত সপ্তাহে অন্য আরেকটি চিঠিতে ওই আদেশ স্থগিত করে এনবিআর। তবে স্থগিত হওয়ার কোনো কারণ চিঠিতে উল্লেখ করা হয়নি।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের একটি সূত্র জানিয়েছে, সাবেক এমপিদের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা বিলাসবহুল ৩০টি গাড়ি নিলামে বিক্রি হলে ১৭৫ কোটি টাকা রাজস্ব পেত চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। এই টাকা সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের কাছে দাবি করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা হলেও চট্টগ্রাম বন্দরের চার্জ এবং ডেমারেজ দিতে হবে সংশ্লিষ্ট গাড়ির মালিক বা কর্তৃপক্ষকে। বন্দর ও কাস্টমস- এই দুই সংস্থা তাদের চার্জ দাবি করায় গাড়ি খালাসের প্রক্রিয়াটি আটকে গেছে বলে জানা গেছে।
কাস্টম হাউসের উপ-কমিশনার (নিলাম) মো. রাসেল আহমেদ বলেন, ‘এমপিদের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা ৩০টি গাড়ি রাষ্ট্রায়ত্ত যানবাহন অধিদপ্তরে হস্তান্তরের চিঠি পেয়েছি। পরে সেই চিঠির আদেশ স্থগিত করে আরেকটি চিঠি পেয়েছি। শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা ৩০টি গাড়ি রাষ্ট্রায়ত্ত যানবাহন অধিদপ্তরে যাওয়ার প্রক্রিয়া আপাতত বন্ধ। কিন্তু পরে আবার নির্দেশ আসতে পারে। এখানে আইনগত কিছু বিষয় রয়েছে। কাস্টম হাউসের শুল্ক ও বন্দর চার্জের বিষয়টি সামনে এসেছে। নিয়ম ও বিধি অনুসারে শুল্ক ও বন্দর চার্জ পরিশোধ করতে হবে, অন্যথায় গাড়িগুলো সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করতে হবে।’
কাস্টমসের নিলাম সূত্রমতে, এর আগে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি গাড়িগুলোর ই-নিলাম অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে নামেমাত্র দর দেওয়ার কথা বলে কারসাজিতে জড়িত সিন্ডিকেটের সদস্যরা। পরের নিলামে প্রথম নিলাম থেকে আর একটু বেশি দর দিলেই গাড়িগুলোর মালিক বনে যেত তারা।
ওই নিলামে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা এমপিদের ২৪টি বিলাসবহুল গাড়িসহ মোট ৪৪টি গাড়ি নিলামে দিয়েছিল চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। ওই নিলামে ৪৪টি লটে ১৩৩টি দরপত্র জমা পড়েছিল। ১১টি গাড়ির লটের দরপত্র জমা পড়েনি।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের ফলে ১০ কোটি টাকা মূল্যের প্রতিটি গাড়ি শুল্কমুক্ত সুবিধায় খালাস করতে পারেননি দ্বাদশ সংসদের সদস্যরা। সংসদ ভেঙে দেওয়ায় ‘কপাল পুড়েছে’ ওই এমপিদের।
প্রথম নিলামে কাস্টমস কর্মকর্তারা দেখেন, ১০ কোটি টাকার বেশি দামের ব্র্যান্ডের গাড়ির নামমাত্র দাম বলা হচ্ছে। কোনো কোনো গাড়ির দাম দেওয়া হয়েছে মাত্র ৫০ হাজার টাকা। অনেক গাড়ির দরও দেওয়া হয়নি। কিছু গাড়ির সর্বোচ্চ দর দেওয়া হয়েছে এক লাখ টাকা থেকে পাঁচ লাখ টাকার মধ্যে। অথচ গাড়িগুলোর প্রকৃত দাম ১০ কোটি টাকার মতো।
কাস্টমস কর্মকর্তারা জানান, প্রথম নিলামে সংসদ সদস্যদের গাড়িতে যে দর পড়েছিল, সেগুলো দ্বিতীয়বার নিলামে তুলে বিক্রির সুযোগ আছে। সে ক্ষেত্রে প্রথমবারের চেয়ে বেশি দর বলতে হবে এবং সর্বোচ্চ দরদাতা হতে হবে। সে হিসাবে পরের বার নিলামে তোলা হলে আর সামান্য বেশি দাম বললেই বিক্রি হয়ে যেত গাড়িগুলো। নিলামে অংশগ্রহণকারীদের এই কারসাজি বুঝে ফেলে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। এর পর জোর দাবি ওঠে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে গাড়িগুলো দেওয়ার।
এদিকে কাস্টমস আইনে নিলামের ক্ষেত্রে লটের বেঁধে দেওয়া মূল্যের ৬০ শতাংশ পূর্ণ হওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু প্রথম নিলামে ওই শর্ত পূরণ না হলে দ্বিতীয় নিলামে প্রথম নিলাম থেকে বেশি দর দিলেই পণ্য চালান খালাস করার বিধান রাখা হয়েছে। এই সুযোগকেই কাজে লাগাতে চেয়েছিল নিলামে অংশ নেওয়া সিন্ডিকেট।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস থেকে গত ১১ মার্চ সিন্ডিকেটের এই কারসাজি সম্পর্কে চিঠি দেওয়া হলে ২৪ মার্চ এনবিআর থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, গাড়ি নিলামের যাবতীয় কার্যক্রম স্থগিত থাকবে। এর ফলে এখন সাবেক এমপিদের গাড়িসহ সব ধরনের গাড়ির নিলাম স্থগিত হয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং এনবিআর থেকে পুনরায় নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হবে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসকে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের নিলাম শাখার কাগজ ঘেঁটে দেখা যায়, গাড়িগুলোর মধ্যে টয়োটা ব্র্যান্ডের ল্যান্ড ক্রুজার গাড়ি রয়েছে ২৬টি। জাপানে তৈরি টয়োটা হ্যারিয়ার গাড়ি আছে চারটি।
এসব গাড়ি আমদানি করেছিলেন সুনামগঞ্জ-৪ আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি মোহাম্মদ সাদিক, ময়মনসিংহ-৭ আসনের সাবেক এমপি এ বি এম আনিসুজ্জামান, আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি মজিবুর রহমান ও জান্নাত আরা হেনরী, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, সানজিদা খানম, এস এম কামাল হোসেন, মো. আসাদুজ্জামান, নাদিয়া বিনতে আমিন, মুহাম্মদ শাহজাহান ওমর, অনুপম শাহজাহান জয়, সাজ্জাদুল হাসান, মো. সাদ্দাম হোসেন (পাভেল), তারানা হালিম, সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, নাসের শাহরিয়ার জাহেদী, আখতারউজ্জামান, মো. আবুল কালাম আজাদ, রুনু রেজা, মো. তৌহিদুজ্জামান, শাহ সারোয়ার কবীর, এস এ কে একরামুজ্জামান, এস এম আল মামুন, আবদুল মোতালেব, শাম্মী আহমেদ ও মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহেদ।
এর মধ্যে ২০২৪ সালে জাপানে তৈরি ৩৩৪৬ সিসি ল্যান্ড ক্রুজার জেডএক্স মডেলের ব্র্যান্ড নিউ গাড়ি রয়েছে ২৪টি। এর প্রতিটির সংরক্ষিত মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৯ কোটি ৬৭ লাখ ৩ হাজার ৮৯৯ টাকা। এ ছাড়া ২০২১ সালে জাপানে তৈরি ২৬৯৩ সিসি ল্যান্ড ক্রুজার টিএক্স মডেলের গাড়ি রয়েছে দুটি। এর একটির সংরক্ষিত মূল্য ১ কোটি ৬২ লাখ ৭৩ হাজার ৮৪ টাকা এবং অন্যটির ১ কোটি ৩৭ লাখ ৯৬ হাজার ১২১ টাকা।