Logo
Logo
×

জাতীয়

কেবিন ক্রুদের জন্য ১৭শ’ টাকার শাড়ি কেনা হয় ১৭ হাজারে

Icon

জাগো বাংলা প্রতিবেদন

প্রকাশ: ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:৩৬ এএম

কেবিন ক্রুদের জন্য ১৭শ’ টাকার শাড়ি কেনা হয় ১৭ হাজারে

দরপত্রের শর্ত ছিল শতভাগ সিল্কের শাড়ি হতে হবে। কখনো এর ব্যত্যয় ঘটলে শাড়ি ফেরত নিয়ে ক্ষতিপূরণসহ শর্ত মানতে হবে। এমন সুস্পষ্ট শর্ত লঙ্ঘন করে অনেকটা প্রকাশ্যেই সিল্কের পরিবর্তে ভারতীয় পলেস্টার শাড়ি সরবরাহ করা হয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে। যেই শাড়ির দরদাম ঠিক করা ছিল ১৭ হাজার ১০০ টাকা, সেটাই সরবরাহ করা হয়েছে মাত্র ১ হাজার ৭০০ টাকায় কেনা নিম্নমানের শাড়িতে। অর্থাৎ ১৭০০ টাকার শাড়ি ১৭ হাজার ১০০ টাকায় কিনেছে বিমান। এমন ভয়াবহ জালিয়াতি ফাঁস হওয়ায় এখন চলছে তোলপাড়। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সবার এই দুর্নীতির কথা স্বীকার করেছেন। তবে কেউই বিস্তারিত জানাতে রাজি হননি। ব্যবস্থাও নিতে পারছে না। কারণ জালিয়াতির হোতা বিমানের ভেতরের একটি সিন্ডিকেটের আশীর্বাদেই এমন অপরাধ করেছে। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এহেন জালিয়াতি চক্র বিমানে এখনো সক্রিয়। বিমানের স্টোর শাখার পরিচালক মমিনুল, জিএম মহীউদ্দিন, ম্যানেজার জাহাঙ্গীর তালুকদার, নিপা, শিপ্রা, ও শরীফের নেতৃত্বে গঠিত সিন্ডিকেট এই শাড়ি কেলেংকারির মূল হোতা হিসেবে কাজ করেছে। এতে ক্ষুব্ধ কেবিন ক্রুরা। এ ধরনের নিম্নমানের শাড়িতে তারা শুধু সামাজিকভাবেই হেয়প্রতিপন্ন হননি, দেশি-বিদেশি যাত্রী সাধারণের কাছেও বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন। বাংলাদেশ বিমানের কেবিন ক্রু এত নিম্নমানের শাড়িতে ফ্লাইটে ডিউটি করে, সেটা অবিশ্বাস্য। 

বিক্ষুব্ধ কেবিন ক্রুদের অভিযোগ, শুধু মানেরই হানি হচ্ছে না, শরীরেরও ক্ষতি হচ্ছে। দীর্ঘক্ষণ পলেস্টার শাড়ি গায়ে থাকায় তাদের শরীরে চৃুলকানিসহ নানা ধরনের জটিলতা দেখা দিচ্ছে। যেই শাড়ির গ্যারান্টি ছিল কমপক্ষে দুবছর, সেটা দুমাসেই বিবর্ণ ও ছিঁড়ে যাচ্ছে। দুবার ব্যবহারের পর ধুইতে গেলে রং উঠে যায়, ছিঁড়ে যায়, কুঁচকে যায়। সেটাই কোনোক্রমে ইস্ত্রি করে পরতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। এ নিয়ে প্রশ্নও তোলা যায়  না, মুখও খোলা যায় না।

নীরবে সহ্য করতে হচ্ছে বিমানের দুর্নীতিবাজদের শাড়ি কেলেঙ্কারি। এটা শুধু এক দুবছর নয়, বিগত পনেরো বছর ধরেই ওই সিন্ডিকেটের ভয়াবহ জালিয়াতি, দুর্নীতি ও অনিয়ম চলে আসছে। মাহী আলম নামে বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দের ঘনিষ্ঠ সহযোগী বিমানে একচেটিয়া শাড়ি সরবরাহ দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে শত শত কোটি টাকা। 

একটানা পনেরো বছর কিভাবে একই প্রতিষ্ঠান এভাবে শাড়ি  সরবরাহের ঠিকাদারি পাচ্ছে প্রশ্ন করা হলে, পরিচালক (অর্থ ও প্রশাসন) মো. নওশেদ আলম একটি পত্রিকাকে বলেন, আমরা এ ধরনের অভিযোগ পেয়েছি। আমি এখানে জয়েন করার আগে থেকেই এভাবে চলে আসছে। আমি এখন এটা তদন্ত করব। প্রয়োজনে ভুক্তভোগী কেবিন ক্রুদের সঙ্গে কথা বলব। তদন্ত করার পর ব্যবস্থা নেব। 

জানা গেছে, সর্বশেষ দুটো দরপত্রেই বেশি ঘাপলা হয়েছে। দরপত্রের শর্ত ছিল বিমান ১২ হাজার পিস রাজশাহী সিল্কের শাড়ি কিনবে। শাড়ির সঙ্গে প্যাকেজে থাকতে হবে ব্লাউজ, পেটিকোট। প্রতি সেটের দর হাঁকানো হয়, ১৬ হাজার টাকা। দরপত্রে অন্তত ৫টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিলে মাহী আলমের ওয়েস্টার্ন ফ্যাশনসকেই  কাজের কার্যাদেশ প্রদান করা হয়। তাতে প্রথম দফায় সরবরাহ করা হয় ২ হাজার সেট। যার দাম ১৭ হাজার ১০০ টাকা। কিন্তু দেখা গেছে কেবিন ক্রুদের সেই শাড়ি বিতরণ করার পরই বেরিয়ে আসে আসল কাহিনী। তারা এ শাড়ি হাতে নিয়েই অসন্তোষ প্রকাশ করেন। বেশ কজন কেবিন ক্রু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শাড়ির মান ও দাম নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ১৭ হাজার টাকার শাড়ি এত নিম্নমানের হওয়ায় তাদের মনে সন্দেহ দেখা দেয়। 

বেশ কজন কেবিন ক্রু নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই পত্রিকাকে জানান, শাড়িগুলো হাতে নিলেই বোঝা যায়, এটা একেবারের বস্তিমার্কা। প্রথম ধোয়াতেই রং উঠে ঝলসে যায়, মাত্র দুমাস ব্যবহার করার পরই অনেকগুলো ছিঁড়ে গেছে। এমন শাড়ি পরে ক্রুরা ঘর থেকে বের হতেও অস্বস্তি বোধ করেন। অনেক ক্রুর শরীরে চুলকানি দেখা দেয়।

বিমান সূত্র জানিয়েছে, মাহী আলম নামের ওই ঠিকাদার নিজেকে ফ্যাসিবাদী সরকারের মন্ত্রী মাদারীপুরের শাহজাহান খানের ভাই পরিচয়ে বিমানে একতরফা গত দুই দশক ধরে এই জালিয়াতি ব্যবসা করে আসছে। তার সহযোগী হিসেবে অপকর্মে সহযোগিতা করেছে বিমানের প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। ওই সিন্ডিকেট এতটাই প্রভাবশালী যে, সর্বশেষ অন্য এক ঠিকাদার তার চেয়ে পাঁচ হাজার কমে দরদাম দিয়ে শাড়ি সরবরাহের কাজ পেলেও তাকে বাধাগ্রস্ত করছে মাহী সিন্ডিকেট। 

এ সম্পর্কে বিমানের ক্রয় শাখা থেকে জানা গেছে, আগে এক সময় জর্জেট শাড়ি দেওয়া হতো কেবিনক্রুদের। কিন্তু বিগত ২০২২ থেকে জর্জেটের পরিবর্তে শতভাগ সিল্কের শাড়ি ক্রুদের দেওয়ার সিদ্বান্ত নেওয়া হয়। একজন ক্রুর জন্য বছরে ৬ সেট শাড়ি বরাদ্দ। বিমানে বর্তমানে ৩৪৭ জন নারী ক্রু রয়েছে। এদের জন্য বছরে লাগে কমপক্ষে দুহাজার শাড়ির সেট। একটি সেটে শাড়ির সঙ্গে একটি পেটিকোট ও ব্লাউজ থাকে। সবই সিল্কের। তখন দরপত্র ডাকা হয়। তাতে ওয়েস্টার্ন ফ্যাশনের সর্বনিম্ম দরদাতা প্রতি সেট শাড়ির মূল্য ১৭ হাজার ১০০ টাকা করে কার্যাদেশ পায়। দ্রুত সময়ে যথারীতি শাড়িগুলো বিমানকে ডেলিভারিও দেওয়া হয়। বিপত্তি ঘটে তখনই। এসব শাড়ি কেবিন ক্রুদের বিতরণের পর বেরিয়ে আসে গুণগত মান ও মর্যাদা নিয়ে। 

এদিকে শাড়িগুলো গুণগত নাম ও দাম সম্পর্কে অনুসন্ধান করে দেখা যায়, এগুলোতে এক শতাংশও সিল্ক নেই। শতভাগ ভারতীয় পলেস্টার। যার বাজার দর সর্বোচ্চ ১২০ টাকা গজ। সেই হিসেবে বার গজের একটি শাড়ির দাম বড়জোর পড়ে সাড়ে ১৪শ’ টাকা। যেই মানের ব্লাাউজ ও পেটিকোট দেওয়া হয়েছে সেটার দাম বড় দুই থেকে আড়াই শত টাকা। এ হিসেবে এক সেট শাড়ির দাম পড়ে সর্বোচ্চ ১৭ শত টাকা। অথচ এর জন্য ওয়েস্টার্ন ফ্যাশন দাম নিয়েছে ১৭ হাজার ১০০ টাকা। অর্থাৎ বিমান তার কাছ থেকে ১৭শ’ টাকার শাড়ি কিনেছে ১৭ হাজার একশ’ টাকায়। 

জানা গেছে, শুধু ২৩ সাল থেকে সিল্কের শাড়িতেই সীমাবদ্ধ নয় এই জালিয়াতি। এটা চলে আসছে ১৯৯৬ সাল থেকেই। তখনো দুহাজার টাকার জর্জেট শাড়ি দিয়ে বিল নিয়েছে সাড়ে ৫ হাজার টাকা। এই হারে হাজার হাজার শাড়ি ডেলিভারি দিয়েছে ওয়েস্টার্ন ফ্যাশন। শুধু এই শাড়ি জালিয়াতি করেই ওয়েস্টার্ন ফ্যাশন হাতিয়ে নিয়েছে কমপক্ষে অর্ধ শত কোটি টাকা। এ টাকার ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়েও একাধিকবার বিরোধ দেখা দিয়েছে বিমানের সিন্ডিকেট সদস্যদের মাঝে। 

বিমানের বর্তমান পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মো. নওশাদ হোসেন বলেন, এটা তো স্পষ্ট বোঝা যায় একটা সিন্ডিকেট করেই যুগের পর যুগ একই কায়দায় একটি প্রতিষ্ঠানই একচেটিয়া এখানে শাড়ি সরবরাহ করছে। তাকে কেউ বাদ দিতে পারেনি। আমিও সর্বশেষ দরপত্রে তাকে বাদ দিয়ে নতুন কাউকে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এবার সে নিম্ন দরদাতা না হতে পারলেও সর্বনিম্ন দরদাতা যাতে কাজ না পায় সেই অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। তবে আমি এটা নিশ্চিত করতে পারি অতীতে কে করেছে সেটা নিয়ে কথা বলতে চাই না। তবে এবার আর এ ধরনের অনিয়ম জালিয়াতি হবে না। ইতোমধ্যেই আমি আগের শাড়িগুলো সম্পর্কে খোঁজ খবর নিচ্ছি। প্রয়োজনে তদন্ত করব। 

ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. সাফিকুর রহমান বলেন, এটা তো চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরেই। আমি একবার ক্রয় শাখায় থাকার সময় ওয়েস্টার্নের শাড়িগুলো ফেরত দিয়েছিলাম। তবে এসবের তদন্ত করা হবে। 

এদিকে সর্বশেষ বিমানের দরপত্রে মাহী আলমের একটি কাজ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েন। তিনি যে কোনো মূল্যে ওই কাজের ক্রয়াদেশ ঠেকানোর সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে তার ব্যবসা অব্যাহত রাখার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। এ বিষয়ে বিমানের সংশ্লিষ্ট শাখার ও প্রশাসন পরিচালক মো. নওশাদ বলেন, ‘আর সম্ভব নয়  তার পক্ষে কোনো কিছু করার। সে যে অপরাধ করেছে, তার তদন্ত হবে, বিচার হবে যাতে এমন জালিয়াতি ও লুটপাট ভবিষ্যতে আর কেউ করতে না পারে।’ 

এ বিষয়ে ক্রয় শাাখার কর্মকর্তারা জানান, দুবছর আগে ডাকা যেই দরপত্রের মাধ্যমে মাহী একটি সিল্ক শাড়ি সেটের দাম নিয়েছে ১৭ হাজার ১শ’ টাকা, এবার ঠিক একই শাড়ির দাম দিয়েছেন মাত্র সাড়ে বার হাজার টাকায়। বিষয়টি তিনি নিজেই জালিয়াতি প্রমাণ করেছেন, দুবছর পর পাঁচ হাজার টাকা কম দাম দেওয়ায়।  

বিমানের এমডি ড.সাফিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা কোনো  অনিয়ম জালিয়াতির প্রশ্রয় দিচ্ছি না। যে অভিয়োগ উঠেছে, সেটার তদন্ত হবে, অ্যাকশান নেওয়া হবে। বিমানে আগে কি হয়েছে, সেটা নিয়ে কথা বলতে চাই না। কিন্তু এখন আর এধরনের জালিয়াতি করে কেউ পার পাবে না। ব্যবসাও করতে পারবে না।’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: মহিউদ্দিন সরকার